Dr. Aminul Islam

Published:
2024-03-12 11:38:21 BdST

মলাশয়ের ক্যান্সার: কয়েকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং ডাক্তারি পরামর্শ


লেখক

 

ডা. সুরেশ তুলসান
___________________


RECTAL CANCER / মলাশয়ের ক্যান্সার - প্রয়োজন সচেতনতার।
------------------
মলাশয় ক্যান্সার বা RECTAL CANCER বিষয়ে কিছু কথা বলার আগে কয়েকটি হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা করতে চাই।

ঘটনা - (১),

এক পঞ্চাশোর্ধ একেবারেই সিধে-সাধা গ্রাম্য এক নারী। দুই মেয়েকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন। ছেলেরা রাগ করে সাথে আসে নাই। কারণ, কিছুদিন পুর্বেই তারা মায়ের অপারেশন করিয়েছে অনেক টাকা পয়সা খরচ করে। রোগ ভালো না হলে তাদের কি দোষ ?? তারা বারে বারে ডাক্তার দেখাতে বা অপারেশন করাতে পারবে না।
বেশ মায়াই লাগছিলো সব দেখে এবং শুনে। বললাম,-----

মা আপনার সমস্যাটা বলেন।

উত্তরে তিনি বললেন, তিন মাস হয়ে গেলো অপারেশন করিয়েছি। সমস্যা যেমন ছিলো তেমনই আছে, কিছুই ভালো হয় নাই, বলতে গেলে একটু বেড়েছেই।

বললাম, আপনার সমস্যাটা কি সেটাই তো আমাকে বললেন না এখনও , কি করে বুঝবো আপনার কি সমস্যা ছিলো আর এখন কি অবস্থা ?

তিনি উত্তর দিলেন, আজ দুই বছর ধরে রক্ত ভাংগছে। তিন মাস হলো অপারেশন করালাম। কিন্তু, যা ছিলো তাই। এখনও আগের মতোই ভাংগছে। বরং, আগের চাইতে একটু বেশি।

আমি বললাম। রক্ত ভাংগছে ভাল কথা, কিন্তু কোন রাস্তা দিয়ে ভাংগছে ? মাসিকের রাস্তা দিয়ে, না পায়খানার রাস্তা দিয়ে ?

রোগী উত্তর দিলেন, পায়খানার রাস্তা দিয়ে।

আপনার রক্ত ভাংগছে পায়খানার রাস্তা দিয়ে। জরায়ুর অপারেশন করালেন কেন ??

রোগী উত্তর দিলেন গ্রামের সব মহিলারা বলাবলি করে, জরায়ুর অপারেশন করালে নাকি রক্ত ভাংগা সেরে ( Cure ) যায়।

আমাদের গ্রামেরই একজন মানুষ। ছোটখাটো ডাক্তারিও করে। খুব ভালো মানুষ। বিপদে-আপদে ডাকলে, এমনকি রাত-বিরেতে ডাকলেও কাছে পাওয়া যায়। তিনিই সাথে করে নিয়ে যেয়ে অপারেশন করিয়ে দিয়েছেন। ( দালাল কিনা জানিনা ?? )

আমি বললাম যে ডাক্তার আপনার অপারেশন করেছে তাকে কি আপনি বলেছিলেন আপনার কোন রাস্তা দিয়ে রক্ত ভাংগছে।

রোগী বললেন, ডাক্তার কে বললাম রক্ত ভাংগছে। শুনে ডাক্তার বলেছেন অপারেশন করলে ভালো হয়ে যাবে। তিনি তো জিজ্ঞেস করেন নাই কোন রাস্তা দিয়ে রক্ত ভাংগছে।

রোগীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কি মাসিক ঠিকমতো হয় ?? তিনি উত্তর দিলেন মাসিক তো আজ ৮-৯ বছর ধরে বন্ধ। তা সে কবেই সেরে গেছে। বুঝলাম মেনোপজ অনেকদিন।

আমি রোগীর অন্যান্য যা যা অসুবিধা সব শুনে মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, মলাশয়ের ক্যান্সার।

এবার রোগীকে পরীক্ষা করার পালা। মলদ্বারে আংগুল দিতেই আংগুলের মাথায় পেলাম অনেক বড় এডভান্সড ফিক্সড একটা গ্রোথ ( অনেক বড় টিউমার অর্থাৎ গুরুতর আকার ধারণ করা ক্যান্সার )

একেতো ক্যান্সার তার উপর বিনা প্রয়োজনে মেনোপজ ( নারীদের মাসিক বন্ধ হওয়ার পরের জীবনকাল ) পরবর্তীতে জরায়ু কাটার ( Total abdominal hysterectomy ) - র মত এত বড় একটা অপারেশন, যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ।

ঘটনা - (২),

ঘটনাটা একই রকম তবে, এক্ষেত্রে রোগী অঘটন ঘটার পুর্বেই আমার কাছে এসে হাজির। একজন মহিলা রোগী, বয়স ৪৩-৪৪ বৎসর হতে পারে। স্বামী ছেলেমেয়ে সহ আমার চেম্বারে এসেছেন। হাতে আল্ট্রাসনো সহ অন্যান্য অনেকগুলো রিপোর্ট। একটা হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন হয়তো কিছুদিন পুর্বে। কারণ হাতে দেখতে পেলাম সেই হাসপাতালের ভর্তি টিকেট। বললাম হাসপাতালের টিকেট কেন বাড়িতে নিয়েছেন। এটা তো হাসপাতালের সম্পত্তি, বাড়িতে নেয়ার নিয়ম নাই।
কি বুঝলেন জানিনা তবে একগাল হাসি দিলেন।

জিজ্ঞাসা করলাম আপনার কি অসুবিধা ??

প্রায় সমস্বরে সকলেই একসাথে বলে উঠলো জরায়ুতে ইনফেকশন, অপারেশন করা লাগবে। কুষ্টিয়ার একজন ডাক্তারের নাম বললেন, তিনি নাকি জরায়ুর অপারেশন করতে পরামর্শ দিয়েছেন। গতকালই অপারেশন করার কথা ছিলো। ছেলে ঢাকা থেকে এসে বলেছে বড় ডাক্তার ছাড়া করাবে না, তাই গতকাল অপারেশন হয় নাই। তাই আজ আপনার কাছে আসা।

আমি বললাম জরায়ুতে ইনফেকশন হয়েছে ভালো কথা, কিন্তু আপনার কি কি শারীরিক অসুবিধা সেটা আমাকে আগে বলেন।

উত্তরে বললেন জরায়ুতে ইনফেকশন ছাড়া উনার আর কোন অসুবিধা নাই। জরায়ুর অপারেশন করলেই উনি ভালো হয়ে যাবেন।

রিপোর্ট গুলো হাতে নিলাম, আলট্রাসনো রিপোর্টে PID ( Pelvic inflamtory disease, অর্থাৎ তলপেটে প্রদাহজনিত রোগ ) এবং রক্তে হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ বেশ কম, এছাড়া আর তেমন কিছু পজিটিভ ফাইন্ডিংস চোখে পড়লো না।

মনে মনে কিছুটা বিরক্ত নিয়েই রোগীকে বললাম, ঔষধ লিখে দিচ্ছি, খান ভালো হয়ে যাবেন। অপারেশন লাগবে না।

আবারও সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, আমরা অপারেশন করানোর সিদ্ধান্তঃ নিয়েই বাড়ি থেকে এসেছি। গতকালই অপারেশন হয়ে যেতো। ছোট ছেলেটা ঢাকা থেকে এসে বাধা দিয়েছে, অপারেশন যদি করাই লাগে তাহলে বড় ডাক্তার দিয়ে করাবো। তাই আপনার কাছে আসা। আপনি দয়া করে অপারেশনটা করে দেন।

বললাম তাহলে VIA ( জরায়ু মুখ ক্যান্সারের পরীক্ষা) পরীক্ষা করে আসেন। আগামীকাল VIA - র রিপোর্ট দেখে তারপর কথা বলবো। সবাই নাছোড়বান্দা বান্দা। বললেন, VIA করাই আছে রিপোর্ট নরমাল। আপনি আজই অপারেশন করে দিন। ছেলে ঢাকা যাবে। ওর ছুটি নাই।

আচ্ছা বিপদ। বললাম অপারেশন করতে রাজি আছি তবে, জরায়ুর ইনফেকশনের কথা ভুলে যান এবং তার আগে আপনার আর কি কি অসুবিধা সেগুলো আমাকে ভালো করে বলতে হবে।

বললাম, আপনি তো একেবারেই রক্ত শুন্য, আপনার কি মাসিক অনিয়মিত বা বেশি হয় ? উত্তর দিলেন, মাসিক স্বাভাবিক।

আপনার আর কোনো অসুবিধা আছে কি ?? বললেন শরীলে ব্যাথা ( শরীল বলতে আমাদের এই অঞ্চলে সাধারণত External Genitalia কে বোঝানো হয় )।

এছাড়া আর কি কি সমস্যা আপনার ?? আর আপনি এত রক্তশুণ্যই বা কেন ??

তখন উত্তর দিলেন। আমার দিনে ২০ - ২৫ বার পায়খানায় যাওয়া লাগে গত কয়েক বছর ধরে। পায়খানা তো আসে না, শুধু আম আসে, আর আমের সাথে অল্পস্বল্প বদ রক্ত আসে।
( মেডিকেল পরিভাষায় বলে Spurious diarrhoea বা নকল ডায়রিয়া ) । তবে তাতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয় না। এটা আমার অনেক পুরাতন আমাশা। তাই আপনকে এতক্ষণ বলা হয় নাই। মাঝেমাঝে একটা-দুটা এমোডিস বড়ি খাই কম থাকে।

মেজাজটা বিগড়ে টক হয়ে গেলো। বহু কষ্টে আচরণটা ভালো রাখলাম।

রোগী কে পরীক্ষা করা শুরু করলাম। গুরুতর রক্তশুণ্য। রিপোর্টে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ যা লেখা আছে, বাস্তবে তার অর্ধেকেরও নিচে হবে হয়তো। 4gm/dl এর কম ছাড়া বেশি হওয়ার কথা না।

মলদ্বারে আংগুল দিয়ে পরীক্ষা করলাম। যথারীতি যা আশা করছিলাম। মলাশয়ের ক্যান্সার।
যথেষ্ট এডভান্সড স্টেজ। Sacrum এর সাথে fixed. ( গুরুতর আকার ধারণ করা ক্যান্সার যা তলপেটের হাড়েও ধরেছে )

মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। ফাঁদে পড়া বিপদের থেকে উদ্ধার করে দেওয়ায় জন্য।

ঘটনা - (৩),

একজন পুরুষ রোগী। বয়স বাহান্নো বৎসর। ভারী শরীর। স্বাস্থ্য আরও ভালো ছিলো। গত ছয় মাসে ওজন কমেছে বেশ খানিকটা।

জিজ্ঞাসা করলাম সমস্যা কি ? উত্তর দিলেন পাইলসের সমস্যা ছিলো। অর্শ গেজ ভগন্দর চিকিৎসালয়ে গিয়েছিলেন ৪ মাস পুর্বে। ওরা কি একটা যেনো মলমের মত কিছু মলদ্বারে লাগিয়ে দেয়। তারপর সম্পুর্ণ মলদ্বারে পুড়ে দগদগে ঘা।
৪ মাসে ঘা শুকিয়েছে ঠিকই তবে মলদ্বার সরু হয়ে প্রায় একেবারেই বুজে ( বন্ধ হয়ে যাওয়া ) গেছে।

রোগীর কবিরাজি চিকিৎসা পূর্ববর্তী সমস্যার কথা শুনে মনে হলো যে তার পাইলস বা HEMORRHOID ছিলো না, অন্য কোন গুরুতর রোগ ছিলো হয়তো।

মলদ্বার পরীক্ষা করে দেখলাম। চামড়া পুড়ে যাওয়া ঘা শুকানোর পর মলদ্বার এবং এর চারপাশটা একেবারে এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। মলদ্বারে আংগুল দেয়ার চেষ্টা করলাম। মলদ্বার বলতে ছোট্ট একটা ছিদ্র। আমরা কেনো আংগুলের ( কনিষ্ঠ তর্জনী ) মাথাও ভিতরে প্রবেশ করাতে পারলাম না। এরকম অবস্থা কে আমরা বলি Severe anal stenosis. (মলদ্বার গুরুতর ভাবে সংকুচিত হয়ে যাওয়া)

রোগীকে বললাম Anoplasty নামক একটি অপারেশন করে মলদ্বার ঠিক করতে হবে।

আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো। Anoplasty অপারেশন করার সময় মলদ্বারের ভিতরে আংগুল দিয়ে এবং PROCTOSCOOY (মলদ্বারের রোগ নির্নয়ের একটি পরীক্ষা) করে দেখলাম মলাশয়ের ক্যান্সার। এবং যথারীতি বেশ এডভান্সড (গুরুতর) ।

এক্ষেত্রে রোগীর কি কি ক্ষতি হলো হিসাব করা যাক।

(১),একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর মলদ্বার কবিরাজি মলমের অন্তরালে এসিড দিয়ে পোড়ানো হলো।

(২), রোগীর ক্যান্সারের মূল চিকিৎসার জন্য দেরি হওয়ায় ক্যান্সার শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া।

(৩),চিকিৎসাটা জটিল ও ব্যয়বহুল হওয়া, এবং চিকিৎসার ফলাফলে এর বিরূপ প্রভাব।

(৩),মলদ্বার পুড়ে যাওয়ায় ক্যান্সারের জন্য প্রয়োজনীয় অপারেশনটা আরও কঠিন হয়ে গেলো।

(৪), আর্থিক ক্ষতি, এই টাকাগুলো তিনি ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যয় করতে পারতেন।

ডা. সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়