ডা শাহাদাত হোসেন

Published:
2022-11-14 21:53:24 BdST

হুমায়ুন আহমেদ : নির্মোহ বিশ্লেষণ




রাজিক হাসান ,
লন্ডন প্রবাসী মুক্ত লেখক
___________________________

হুমায়ুন আহমেদ লিখিত শতাধিক বই আমি পড়েছি। এক সময় সত্যি গোগ্রাসে গিলেছি তাঁর লেখা বই। অপেক্ষায় থাকতাম কবে হুমায়ূনের নতুন বই আসবে। তখন তিনি লিখতেন রহস্য পত্রিকায়। বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে অমানুষ তিনি সেখানেই লিখেছিলেন। পরে অমানুষ বই টি বই আকারে বেরিয়েছে। বিদেশী বইটির নাম ছিল ম্যান অন ফায়ার। কাজী আনোয়ার হোসেন পরে নিজে লিখেছিলেন অগ্নি পুরুষ বইটি। একই কাহিনী দুইভাবে লেখা। দুইটি বইই আমি পড়েছি। অগ্নি পুরুষ বইয়ে যেই রোমাঞ্চ কাজী আনোয়ার হোসেন দিয়েছেন তার ছিঁটে ফোঁটাও অমানুষ বইটিতে আমি পাই নি।
লন্ডনের বাঙালি পাড়ার লাইব্রেরিতে পাই হুমায়ুন আহমেদ এর বাদশাহ নমদার বইটি। বহু বছর পর পড়ছি হুমায়ুন আহমদের বই। ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস। ইতিহাসে আগ্রহ আমার, তাই বইটি পড়ে আমি শেষ করি। মনে আছে, কলেজে যখন পড়তাম তখন দেখতাম ছাত্রশিবিরের ছেলেদের ইতিহাসের ঘটনার বিশ্লেষণ করেন এক রকম দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে, আবার একই ঘটনা ইউনিয়নের ছেলেরা বিশ্লেষণ করেন সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে। সম্রাট আকবরকে শিবিরের ছেলেরা চরিত্রহীন, লম্পট, বেঈমান হিসাবে চিহ্নিত করবে আবার ইউনিয়নের ছেলেরা সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা দেবে। ঔরঙ্গজেব, দারাশিকহ, সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। এখন প্রশ্ন হল, হুমায়ুন আহমদ কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বাদশাহ নমদার বইটি লিখেছেন। বইটি পড়ুন, উত্তর আছে সেখানে।
হুমায়ুন আহমেদ এর সমালোচক নই আমি। ওনার সম্পর্কে লেখার ইচ্ছেও আমার ছিল না বা নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার বন্ধুরা জানতে চান হুমায়ুন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি কী? সেই কারণে হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি আমি।
হুমায়ুন আহমেদ পাঠক সৃষ্টি করেছেন। কথাটি সত্যি। হুমায়ুন আহমেদ পড়ার আগেই আমি ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক্সের বহু বই পড়ে ফেলেছি। সুতরাং আমি এই ক্যাটাগরিতে পড়বো না। তবে আমি বহু হুমায়ুন ভক্ত পাঠক দেখেছি যারা ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক্স তো দূরের কথা নীল লোহিত, প্রফেসর শঙ্কু বা কুয়াশা পড়ে দেখেন নি, এমন কি নামও শোনেন নাই। রবীন্দ্র, তলস্তয়, মোপাসাঁ, গোর্কি পড়ার যোগ্যতা যে সব পাঠকের নাই সেই সব পাঠকদের তিনি বই পড়া শিখিয়েছেন, সন্দেহ নাই। তাই হিমু চরিত্র যে নীল লোহিত থেকে ধার করা সে কথা কেউ বলে না। মিসির আলী পড়ে আর যাই হোক বিজ্ঞান মনস্ক হওয়া যায় না। এই দুইটি ছাড়া হুমায়ুন আহমদের কোন শক্তিশালী চরিত্র নাই। অনেকে বলবেন বাকের ভাই, আমি বলবো এই বিষয় নিয়ে আলোচনার দরকার নাই। হুমায়ুন আহমেদর সৃষ্ট শক্তিশালী কোন নারী চরিত্র নাই। এক্সক্লুসিভভাবে হুমায়ুন আহমেদ এর পাঠকদের থেকে শুনতে পাই; ''ভাই,আমি অন্য কারো বই বুঝিনা। পড়তে ভাল লাগেনা। আমি ভাই আঁতেল না'' বলে অজ্ঞাত কারণে শ্লাঘাবোধ করেন।
ড. হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন হুমায়ূন: কারণ যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না।
হুমায়ুন আহমেদ মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একটি গল্পে হিন্দু নাম পরিবর্তন করে মুসলিম নাম বসিয়ে হুমায়ুন আজাদের কাছে নিয়ে বলেছিলেন তিনি গল্পটি লিখেছন। হুমায়ুন আজাদ নাকি বলেছিলেন গল্পের গভীৰতা নেই। এই কথাটি শুধু হুমায়ুন ভক্তরাই বিশ্বাস করবেন। যদি বলি গল্পের নাম কী? কেউ বলতে পারবেন না সেই গল্পের নাম। কারণ হিন্দু নামের জায়গায় মুসলিম নাম বসালে সেই গল্পটি তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। কথাটি ডাহা মিথ্যা সন্দেহ নেই।
সে যাই হোক, আমাদের সাংস্কৃতি আমাদের সাহিত্যের নিজশ্বতা গড়ে না ওঠার কারনে আমরা অপসাংস্কৃতিকেও ভ্রমকরে সাংস্কৃতি ভেবে বসি। সমাজে শুধু একটা শ্রেনী নিয়েই গঠিত হয় না বিভিন্ন মানের বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতা নিয়েই একটি সমাজ পুর্নাঙ্গতা পায়। হুমায়ুন আহাম্মেদ মধ্যবিত্তের জীবনকে উপজিব্য করে রশালো কিছু উপাদান ধরিয়ে দিয়েছেন সাধারন পাবলিককে। তাকে সাহিত্য মানে বিবেচনা করলে সহিত্যের প্রতি অবিচার করা হবে।
জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ আমাদের চিন্তা ধারার ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন করে দিয়ে গেছেন তা শোধরাতে সময় লাগবে অনেক বছর। আমরা এখন সব কিছুইকেই খুব হালকা এবং কৌতুক হিসেবে নেই। তার কারণেই হয়তোবা জীবনের গভীরতাকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। তিনি কৌতুক প্রিয় ছিলেন - তিনি আমাদের হাসিয়েছেন। তিনি আমাদের কাঁদিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাদের ভাবতে শেখান নি কখনও।
তিনি আমুদিত করেছেন কোটি-কোটি পাঠকপ্রাণ। আমাদের নিরস মধ্যবিত্ত জীবনে ছিল না কোন কমেডি; সেখানে তিনি কমেডি এনে দিয়েছেন। এটা তাঁর অবদান। ভাষার জাদুকর তিনি ছিলেন না; ছিলেন তিনি কাহিনীর জাদুকর। আমরা মধ্যবিত্তরা; যে কাহিনী শুনতে চেয়েছি; তিনি শোনাতে পেরেছেন তাই। তিনি যতোটা ভেবেছেন সাহিত্যভাবনা ; তারচেয়ে বেশি ভেবেছেন বিপণনের কথা। তিনি শব্দের ফেরিওয়ালা, মধ্যবিত্তের মনস্তত্ত্ব ছিলো তাঁর সাহিত্য ব্যবসার কাঁচামাল। তার গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমায় তিনি তা উজাড় করে দিয়েছেন পাঠক-দর্শক মনে। সেই অর্থে, তিনি কালজয়ী হতে চান নি; তিনি চেয়েছিলেন; তার লেখনীর ভেতর কালকে ধরে রাখতে। নিঃসন্দেহে তিনি তা পেরেছেন। শিল্পজগতে ছিল না তাঁর কোন দায়বদ্ধতা। যে কারণে তিনি পেয়েছিলেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা।#

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়