SAHA ANTAR

Published:
2022-05-30 22:03:09 BdST

কলকাতায় ১৩ দিনে ৪ মডেলের ঝুলন্ত মৃতদেহ, সম্পর্কের টানাপোড়েন নাকি অন্যকিছু : মনোবিশেষজ্ঞ যা বলছেন


মঞ্জুষার তুলনায় বয়সে পনেরো বছরের বড় ছিলেন রামনাথ


সংবাদদাতা
_________________________

মাত্র ১৩ দিনে কলকাতা শহরে ৪ উঠতি মডেলের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। যেভাবে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং পেশাদারির দুনিয়ার চাপ সামলাতে না পারায় একের পর এক উঠতি মডেল-অভিনেত্রীরা চরম সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
পল্লবী-বিদিশা-মঞ্জুষার পর শনিবার গভীর রাতে কলকাতার কসবায় নিজের বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হল এক তরুণী। পুলিশের অনুমান, সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরেই এই আত্মহত্যা । তিনিও মডেল ছিলেন।

 


জনমনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ডা. সুলতানা এলগিন এ বিষয়ে বলেন, সমাজ-মানস বিশ্লেষণে কোথাও সম্ভবত বেখেয়াল হয়ে পড়ছি আমরা। পত্রিকার কাটতি বাড়াতে সাংবাদিকরা ঢালাও ভাবে তাদের উঠতি মডেল, অভিনেত্রী , অসম জীবন ; অন্য লাইফস্টাইল এসব সস্তা পরিচয় তুলে ধরছেন।
মৃত মেয়েদের নিয়ে রিপোর্ট বিস্তারিত পড়লে দেখা যায়, করুণ সব মৃত্যু। অর্থনৈতিক টানাপড়েন, সম্পর্কের টানাপোড়েন, অনিশ্চিত পেশা ও জীবিকা; এসবে জেরবার ছিলেন এই জীবনসংগ্রামে লড়াকু নারীরা। প্রতিকূলতায় দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল তাদের নবীন জীবন। এই সমস্যাগুলোতে আলো ফেলতে হবে। এই নানামাত্রিক সঙ্কটগুলো তাদের মন ও মনোজগতকে অসুস্থ করে তুলছিল। বিষন্ন ও বিপন্ন করছিল। মানসিক সমস্যা নিয়ে এখনও সমাজে প্রয়োজনীয় সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। এটা দরকার। একদল অসুস্থ মনমানসিকতার লোক নিয়মিত বিকৃত সব কথা কাহিনি , বিশ্বাস অবিরাম প্রচার করে চলছে। তাতে সমাজ মানসে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের বিকৃত চিন্তা ও প্রচার সমাজকে আরও বিকল করে তুলছে।


ডা. সুলতানা এলগিন ;
অধ্যাপক
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ
কনসালটেন্ট , ওসিডি ক্লিনিক ও জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা

 

কেসস্টোরি :সরস্বতী দাস


শনিবার
মৃতের নাম সরস্বতী দাস (১৮)। কসবার বেদিয়াডাঙা এলাকার বাসিন্দা। ছেলেবেলায় বাবা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। মা-মাসির কাছে বড় হয়ে উঠেছেন সরস্বতী। তাঁর মা এবং মাসি দু’ জনেই আয়ার কাজ করতেন। শনিবার রাতে তাঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী হন সরস্বতী। ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁকে দেখতে পান তাঁর দিদা। তিনিই বঁটি দিয়ে গলার ফাঁস কেটে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

পরিবার সূত্রে খবর, মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা করেননি সরস্বতী। বরং মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। কখনও কখনও ফটোশুটও করতেন। পাশাপাশি, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কাজও করতেন তিনি। ভবিষ্যতে অভিনয় জগতের তারকা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি সামনে এলেও পুলিশের তরফে এখনও স্পষ্টভাবে কিছু জানানো হয়নি। যদিও সরস্বতীর সঙ্গে কারওর সম্পর্ক রয়েছে তা স্বীকার করেনি তাঁর পরিবার।

পরিবারের দাবি, গত শনিবারও যথেষ্ট হাসিখুশি ছিলেন সরস্বতী। সকলের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। মাসির সঙ্গে ভিডিও কলেও কথা বলেছিলেন তিনি। তার পরেও কেন এই ঘটনা ঘটাল তা এখনও স্পষ্ট নয়, বলছে পরিবার।


কেস স্টোরি: প্রয়াত মডেল মঞ্জুষা:
কেরিয়ারে হোঁচট খাওয়ার ভয়? বিয়ের কথা ৩ মাস গোপনে রেখেছিলেন


বিয়ে হয়েছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু জানাননি সদ্যপ্রয়াত মডেল-অভিনেত্রী মঞ্জুষা নিয়োগী । ফেসবুকে রিলেশনসিপ স্টেটাস ছিল ‘সিঙ্গল’! সিঁদুর পরে বরের সঙ্গে প্রথম ছবি আরও তিন মাস পর। ফেব্রুয়ারির একেবারে শেষে। শুভেচ্ছা তো কোন ছার, সেসব ছবি দেখে চোখ কপালে তুলে ঢোঁক গিলেছিলেন বন্ধুরা।

 

প্রয়াত মডেল মঞ্জুষা নিয়োগীর বিয়ের খবর জানতেনই না তাঁর সঙ্গীসাথীরা। তার প্রমাণও মিলছে ফেসবুকে। বরের সঙ্গে মঞ্জুষার ছবি দেখে বান্ধবী অনন্যা সরকার সে পোস্টের তলায় লিখেছিলেন, ‘কী বলছিস! কবে করলি তুই বিয়ে?’ আরেক বন্ধু শুভদীপ দত্তর গলাতেও বিস্ময়ের ছোঁয়া। ‘তোদের বিয়েটা কবে হল রে?’ কেন নিজের বিয়ে লুকিয়েছিলেন মঞ্জুষা? ইন্ডাস্ট্রির উঠতি মডেলরা জানিয়েছেন, অভিনেত্রী মডেলদের কেরিয়ার সংক্ষিপ্ত। প্রথিতযশা অভিনেত্রীরাও প্রায়ই বলেন, বিয়ে হয়ে গেলে দাম কমে যায় রুপোলি জগতে।

মুম্বইয়ের এক বঙ্গতনয়াও সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বিয়ে মানে গ্ল্যামার জগতের কফিনে শেষ পেরেক। বক্স অফিসে নায়িকাদের আর দাম থাকে না। এছাড়া পুরুষদের তুলনায় নায়িকাদের লড়াইও অনেক বেশি। প্রতি পদক্ষেপে নিজেদের প্রমাণ করতে হয়। বিয়ে মানেই সন্তান, নানা সামাজিক দায়বদ্ধতা, তা পেরিয়ে কেরিয়ার নিয়ে আর ভাবার সময় থাকে না। বিয়ে হয়ে গেলে অভিনেত্রীর রূপ থেকে নাচ, পোশাক থেকে আচরণ সব কিছুই প্রতি মুহূর্তে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়। আর সেসব পেরিয়েই একজন অভিনেত্রী কিংবা মডেলকে এগোতে হয়।

মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে মঞ্জুষার ঘনিষ্ঠরা বলছেন, হয়তো এই কারণেই নিজের বিয়ের খবর লুকিয়ে ছিলেন উঠতি অভিনেত্রী-মডেল। এমনকী, মঞ্জুষা-রামনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফোটোগ্রাফার অভি চট্টোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, তাঁরা সেসময় কিছুই জানাননি। পরিচিত বন্ধুদের না জানিয়েই মালাবদল, সইসাবুদ করেছিলেন মঞ্জুষা-রামনাথ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর এই নিয়ে কিছু বলতে চাইছেন না রামনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পেশায় ফোটোগ্রাফার রামনাথ জানিয়েছেন, আমি পুরনো কিছু নিয়ে বলার অবস্থায় নেই। মঞ্জুষার তুলনায় বয়সে পনেরো বছরের বড় ছিলেন রামনাথ।

 

 

জানা গিয়েছে, বর বয়সে অনেকটাই বড়। প্রথমদিকে তাই বিয়েতে মত ছিল না অভিভাবকদের। পরে যদিও তাঁরা মেনে নেন। তবে সম্প্রতি বাড়ির লোকেরা পুরোদমে সংসার করতে বলছিলেন মঞ্জুষাকে। এদিকে কেরিয়ারকে মূলস্রোতে আনতে জেদ ধরেছিলেন মঞ্জুষা। তাই নিয়েই তৈরি হয়েছিল টানাপোড়েন।

অন্যদিকে, এও শোনা যাচ্ছে, স্ত্রীর পেশা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না রামনাথের। শুটিংয়ে সঙ্গ দেওয়ার প্রশ্ন নেই। বরং নিজের পেশা, অর্থাৎ ফোটোগ্রাফি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন রামনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নিয়েই কি ঘরণির সঙ্গে মন কষাকষির সুত্রপাত? পছন্দসই কাজ না পাওয়ার পাশাপাশি জীবনসঙ্গীর এহেন নিস্পৃহতাই কি হতাশার কালগহ্বরে ঠেলে দিয়েছিল মঞ্জুষা নিয়োগীকে, যার পরিণতিতে নিজেকে শেষ করে দিলেন তিনি? বছর ছাব্বিশের মডেল অভিনেত্রী মঞ্জুষার অপমৃত্যুর প্রেক্ষিতে এমন অনেক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। যার উত্তর পেতে যোগাযোগ করা হয়েছিল রামনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, ”মঞ্জুষা শুটিংয়ে যেতে চাইলে আমি অ্যাপ ক্যাব বুক করে দিতাম। কিন্তু কাজের ব্যস্ততার কারণে সেসব জায়গায় যেতাম না।”


কেসস্টোরি : অবসাদেই আত্মঘাতী হলেন বেহালার বৃদ্ধ


কাজ থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিন বছর আগে। তার পর থেকেই অবসাদে ভুগছিলেন একদা সদা কর্মব্যস্ত সরকারি আধিকারিক। শেষপর্যন্ত সেই অবসাদেই আত্মঘাতী হলেন বেহালার বৃদ্ধ। রবিবার নিজের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় তাঁর দেহ।

বেহালা থানা এলাকার পশুপতি ভট্টাচার্য লেনের বাসিন্দা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় (৬২)। সরকারি পদস্থ আধিকারিক ছিলেন। বছর তিনেক আগে কাজ থেকে অবসর নিয়েছিলেন আশিসবাবু। অভিযোগ, তার পর থেকেই অবসাদে ভুগতেন তিনি। এদিন সিঁড়ির রেলিং থেকে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় তাঁর। খবর পেয়ে পুলিশ এসে দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায়। প্রাথমিক তদন্তের পর বেহালা থানার পুলিশের অনুমান, অবসাদেই মৃত্যুর পথ বেছে নেন তিনি।

মনোবিদরা বারবার অবসাদ নিয়ে সতর্ক করছেন। সম্প্রতি কাজ এবং ব্যক্তিগত জগতে টানাপোড়েন এবং মানসিক অবসাদের জেরে একের পর এক মডেল অভিনেত্রীদের মৃত্যুর সাক্ষী থেকেছে শহর কলকাতা। পরপর আত্মহত্যা করেছেন মডেল-অভিনেত্রী পল্লবী দে, বিদিশা দে মজুমদার, মঞ্জুষা নিয়োগী। একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনায় মানসিক অবসাদ নিয়ে সতর্ক করছেন মনোবিদরা। তাঁদের পরামর্শ, মানসিক অবসাদে ভুগলে মনোবিদদের পরামর্শ নিন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই অবসাদকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন। ফলস্বরূপ একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে।

স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘদিন ধরে কর্মব্যস্ত থাকার পর অবসর একঘেয়ে হয়ে ওঠে অনেকের কাছেই। আশিসবাবুর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। আর সেই অবসাদেই সিঁড়ির রেলিং থেকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলেন তিনি।

তথ্য সংবাদ প্রতিদিন।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়