Ameen Qudir

Published:
2020-03-04 22:32:11 BdST

পাপিয়াকান্ড নিয়ে বহুমুখী প্রচার প্রসঙ্গে যে কথা বললেন মেধাবী বিসিএস কর্মকর্তা


 

ডেস্ক
___________________

পাপী পাপিয়াকান্ড নিয়ে বহুমুখী বিচিত্র সব প্রচার চলছেই। ওহি নাজিলের মত তালিকা প্রচার হচ্ছে আমলা সাংবাদিক জনপ্রতিনিধিদের। এক ধরণের মিডিয়া কোন রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই সেসব প্রচার করে চলছে।
এ নিয়ে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন মেধাবী অফিসার কাজী সায়েমুজ্জামান একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন ফেসবুকে তার ওয়ালে। তার লেখাটি লেখক ও ফেসবুকের সৌজন্যে প্রকাশ হল।
Kazi Saemuzzaman
কাজী সায়েমুজ্জামান -------------------------
একজন নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তার কর্মকান্ড নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে তার বিরুদ্ধে অপরাধ পাওয়া গেলে আদালতে অভিযোগ আনা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত তিনি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী নন। অথচ আদালতের আগেই তাকে চূড়ান্ত সাজা দিচ্ছে দেশের গণমাধ্যম। দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, শিল্পিপতিসহ বহু মানুষ এ ঘটনার ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। ওই নারী গ্রেপ্তারের পর থেকে প্রতিদিনই তাদেরকে নিয়ে মুখরোচক ঘটনা প্রকাশ করে চলছে সংবাপত্রগুলো। আমি সংবাদগুলো পড়ি। অবাক হই, কোন সংবাদে সূত্রের উল্লেখ নেই। পুরাটাই গল্প। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, বাঙালি সেক্সের গন্ধ পেলে চিংড়ি মাছের মতো লাফায়। এই লাফালাফিতে মশলার যোগান দিচ্ছে দেশের গণমাধ্যম।

দেশের গণমাধ্যমের জেন্ডার সেন্সিভিটিও দেখার মতো। এর আগে এক অভিনেত্রীর বিয়ের আগে তার ব্যক্তিগত ছবি ফাঁস হয়। তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ফোকাস ছিল ওই অভিনেত্রীর উপরে। অথচ তার সাথে যে পুরুষটি ছিলেন, অবাক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলাম, তিনি আলোচনায়ই ছিলেন না। যত দোষ ওই অভিনেত্রীর। এবারও দেখা গেলো গণমাধ্যমের একই চরিত্র। গ্রেপ্তারকৃত নারী বিবাহিত। তার স্বামীও একই কাণ্ডে জড়িত হলেও সে আলোচনার বাইরে। কারণ একটাই। নারী এ ধরণের খবরের ভীষণ এক্সাইটিং ‌উপাদান।

যাই হোক ওই নারী এখনো পুলিশ হেফাজতে আছেন। সাংবাদিকরা এটাকে বলে থাকেন পুলিশ রিমান্ড। আইনে কোথাও পুলিশ রিমান্ড বলতে কিছু নেই। এবার আসি, পুলিশ হেফাজতে থাকা একজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাবাদ করা হয়ে থাকে। তিনি নূতন নূতন তথ্য দেন। সেগুলো যাচাই করা হয়। তারপর তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ আনা হয়। আমার কথা হলো, অভিযোগ আনার পরও কী তার উপর নির্ভর করে সাংবাদিকরা খবর প্রকাশ করতে পারেন? পারেন না। প্রথমত: তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নেই। দ্বিতীয়ত: বিষয়টা বিচারাধীন। এসব অভিযোগ থেকে তিনি খালাসও তো পেতে পারেন। তৃতীয়ত: তাকে নিয়ে পত্রিকায় ছাপানোর খবরের ফলে তার সামাজিক, মানসিক যে ক্ষতি হয়েছে সেটা কে পূরণ করবে? সাংবাদিক নিজে অনুসন্ধান করে তথ্য প্রমাণসহ রিপোর্ট লিখতে পারেন। সেটা ভিন্ন কথা। সেজন্য তাকে অবশ্যই ক্রেডিট দেয়া উচিত। তবে একজন লোক পুলিশের হেফাজতে গেলেই যে রিপোর্টের নামে গল্প লেখা হয়- এটা সাংবাদিকতার কোন নীতি নৈতিকতায় পড়ে! একসময় সাংবাদিকতা করতাম বলে বিষয়টা আমার কাছে পীড়াদায়ক। অদ্ভুত ব্যাপার হলো সাংবাদিকতায় অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা আছেন, তারা কেউ এটা নিয়ে কথা বলছেন না। এটাই আমার আরো অবাক হওয়ার কারণ।

এর মধ্যে কয়েকটি পত্রিকা সচিবদের নিয়ে লিখছে। কেউ অপরাধ করলে বা দুর্নীতি করলে তা লিখতে পারেন, এতে কোন আপত্তি নেই। তবে ওই নারীকে কেন্দ্র করে ঢালাওভাবে সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে মুখরোচক, অশ্লীল, রুচিহীন সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। একজন বা দুই জন নন, বহু সচিবদের কথা বলা হচ্ছে। তবে কোন সচিবের নাম দেয়া হয়না। মন্ত্রণালয় কোনটা তা ইশারা দিয়ে লেখা হয়। কে বলেছে, তার কোন সূত্র নেই। ওই রিপোর্টারকে এই সংবাদের সোর্স কোথায় পেয়েছেন তা জিজ্ঞাসা করা হলে, রিপোর্টার তদন্তের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বরাতের কথা শতবার বললেও কী ওই তদন্তকারীরা তা স্বীকার করবেন? কখনোই করবেন না। আইনে তাকে এ সুযোগও দেয়া হয়নি। তারপরেও তারা প্রকাশ্যে কিছু বললে, সেটা না হয় পত্রিকায় লেখা যেতো। তাদের নামও তো নেই। সাংবাদিকরা যে ক্রীড়ানক হয়ে কোন পক্ষের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছেন না- এটাও বা বুঝি কী করে! এদেশের সিভিল প্রশাসনকে দক্ষতাহীন, চরিত্রহীন প্রমাণ করতে পারলে অনেকেই খুশি হন। তাহলে তারাই কী তাদের এসব সংবাদের উৎস?। না কী সাংবাদিক উদ্যোগী হয়ে গল্প প্রকাশ করে পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এ প্রশ্নের জবাব মিলছেনা। কোন ব্যক্তির পুলিশ হেফাতে থাকাকালীন সংবাদ প্রকাশে একটা গাইডলাইন থাকা উচিত। আশা করি, সাংবাদিকতার অগ্রজরা এবিষয়ে এগিয়ে আসবেন।

আমি তিনজন সচিবের পিএস ছিলাম। দিনরাত তাদের কীভাবে যায় তা জানি। কোন সচিবের পক্ষে যেভাবে পত্রিকায় লেখা হচ্ছে, দায়িত্ব পালনকালীন কোন ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়ে সময় কাটানো সম্ভব নয়। একটা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করা সহজ সাধ্য নয়। খাবার সময়ই তাদের হয়না। তাছাড়া তাদের সাথে পুলিশ থাকে সারাদিন। প্রতিটি ফাইভ স্টার হোটেলের সামনে গোয়েন্দারা বসে থাকেন। কারা যাচ্ছেন নোট করেন। বিনা প্রোগ্রামে সেখানে গেলেও তা রেকর্ড হয়ে যায়। এসব সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। তারা সংবাদপত্রে খবর দেখে সচিবদের নিয়ে মুখরোচক আলোচনায় অংশ নেন।

আমার কথা হলো, সংবাদপত্রে লিখতে চান, লিখবেন। তবে সোর্সটা তো দিতে হবে। সোর্স ছাড়া লিখে একজনের সম্মানহানী করা এটা কোন ধরণের কাজ। নৈতিকতার প্রশ্ন আছে। পেশাদারিত্বের প্রশ্ন আসবে। প্রত্যেক পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি থাকার কথা। সোর্স ছাড়া সংবাদ প্রকাশের সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করা হলে তা হবে জাতির জন্য ভয়াবহ। কারণ ব্রিটিশ-আইরিশ পার্লামেন্টেরিয়ান এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন, সাংবাদিকরা হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ ইন্দ্রিয়। আর সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একবার বলেছিলেন, আমি চারটি সংবাদপত্রকে এক লক্ষ বেয়োনেটের চেয়েও বেশি ভয় করি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেই বেয়োনেটগুলো এখন ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আত্মপক্ষ সমর্থনেরও কোন সুযোগ দেয়া হয়না।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম নিয়ে লেখালেখি করতেন। বিগত ৬ জানুয়ারি ২০১১ তে তিনি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সাংবাদিকের নৈতিকতা শীর্ষক একটা কলাম লিখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'ধনী লোক বা বড় শিল্পপতি, বিখ্যাত ব্যক্তি, বড় তারকা কোনো বিপদে পড়লে অনেক সাংবাদিক উল্লসিত হন। তাঁদের সেই উল্লাস প্রতিফলিত হয় তাঁদের লেখায়। এটা সাংবাদিকের বিকৃত মানসিকতা। অসুস্থ মানসিকতা। এ ধরনের মানসিকতা সাংবাদিকতা পেশার জন্য উপযুক্ত নয়। সাংবাদিকের দৃষ্টি হবে বস্তুনিষ্ঠ। তথ্য, প্রমাণ দিয়ে তিনি লিখবেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য প্রকাশ করা তাঁর প্রধান শর্ত। আমাদের দেশে এখনো অনেক সংবাদপত্র ও টিভি সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করে না। সাংবাদিকতা পেশায় তারা হয় মতলববাজ, নয় অদক্ষ। এদের হাত থেকে সাংবাদিকতা পেশাকে রক্ষা করতে হবে।'

কাজী সায়েমু্জ্জামান
দক্ষিণ কোরিয়া
০৪ মার্চ ২০২০
লেখার লিঙ্ক :https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=10220499834708560&id=1313340451

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়