Ameen Qudir
Published:2020-03-03 15:55:14 BdST
মন, সৃষ্টিশীলতা ও সাহিত্য মনস্তত্ত্ব
মোহিত কামাল
কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক ও সাবেক পরিচালক,
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট;সম্পাদক, শব্দঘর
__________________________
যুগযুগ ধরে চলে আসা সাহিত্যতত্ত্বের ভাববাদী ও যুক্তিবাদী ধারা, কল্পনাশক্তি-কবিকল্পনা, রিয়ালিজম বা বাস্তববাদী মতবাদ, সুররিয়ালিজম (Surrealism), রোমান্টিসিজম, সেন্টিমেন্টালিজম, হিউম্যানিজম ইত্যাদি সাহিত্য-মতবাদে প্রবলভাবে উপস্থিত রয়েছে মনস্তত্ত্বের অন্তর্লীন স্রোত। অপরদিকে যুগে যুগে মনোবিদরা মানুষ ও প্রাণীর আচরণ বোঝার জন্য নানা ধরনের গবেষণা করেছেন, করছেন। এসব গবেষণা বিজ্ঞাননির্ভর। তাই মনোবিজ্ঞান গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আর মনস্তত্ত্বেরও রয়েছে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত বা মতবাদ : নিউরোসায়েন্স, বিহেভিয়ারাল, হিউম্যানিস্টিক, কগনিটিভ ও সাইকোডাইনামিক ইত্যাদি। এসবের আলোয় আচরণ ও মনের নানা প্রসেস বা ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাহিত্যে সৃষ্ট চরিত্রের মনঃবিশ্লেষণে এসব মতবাদ ব্যবহার করা যায় নানাভাবে।
ভাববাদী সাহিত্যতত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ ও সুশৃঙ্খল আলোচনা প্রথম দেখা যায় প্লেটোর রচনায়। কবি ও তাত্ত্বিকদের দীর্ঘদিন প্রভাবিত করেছে ভাববাদী তত্ত্বকথা। অ্যারিস্টটলের যুক্তিবাদী ধারা আজও প্রবলভাবে সক্রিয়। ‘পোয়েটিক্স’ গ্রন্থে ট্রাজিডিকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন তিনি। একদিকে আছে বৃত্ত (fable বা plot), চরিত্র এবং চিন্তন; অন্যদিকে আছে বাচন, সংগীত ও দৃশ্যসজ্জা। অর্থাৎ একদিকে রয়েছে বিষয়বস্তু (content) অন্যদিকে রয়েছে আঙ্গিক (form)। বলা যায়, সাহিত্যের প্রকাশমাধ্যম, আঙ্গিক, স্টাইল এসব বিষয়ে অ্যারিস্টটলের কাছে উত্তরসুরিদের ঋণ অনেক বেশি। একই গ্রন্থে শব্দ ও রূপক (metaphor) ব্যবহারের বিশেষ ক্ষমতা সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, ‘দুটি অসম জিনিসের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পাবার বিরল প্রতিভা থাকে সার্থক রূপক-স্রষ্টার, এই গুণ ঠিক চেষ্টা করে আয়ত্ত করবার নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রূপক ব্যবহারে যদি কেউ দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, চরম উৎকর্ষ দেখা যাবে তার সৃষ্টিতে।’ দেখা যাচ্ছে প্লেটোর ভাববাদ বা ভাবনাতত্ত্বের উদগীরণ, অ্যারিস্টটলের যুক্তিবাদ- চিন্তন ও প্রতিভার নৈপুণ্য, রোমান্টিক যুগের কবিদের কল্পনাশক্তি, রবীন্দ্রনাথ কথিত মনের মিল- অনুভূতি-অনুভব, উপলব্ধির ভেতর থেকে গভীর সত্যকে উদঘাটন করার প্রণোদনা; প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাস্তববোধ ও জীবনবোধ সাহিত্য সৃজনে বড় ভূমিকা রাখে।
সৃষ্টিশীলতা ও সাহিত্য
ইংরেজিতে ‘ক্রিয়েটিভ’ শব্দটি বেশ প্রচলিত। আমরা জানি, ‘ক্রিয়েট’ থেকে এসেছে ‘ক্রিয়েটিভ’। ক্রিয়েট ক্রিয়াপদটির মানে হচ্ছে সৃষ্টি করা, মৌলিক কিছু সৃষ্টি করা, মৌলিক সত্যের উন্মোচন করা; মৌলিক পথ নির্মাণ করে সামনের জটিল পথ সহজ করা। সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে আরও কয়েকটি শব্দের রয়েছে যোগসূত্র। শব্দগুলো হচ্ছে প্রতিভা, মেধা, বুদ্ধি। প্রতিভাবানরাই সাধারণত হয়ে থাকেন মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত। প্রতিভার অন্তর্গত উপাদান হচ্ছে স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, অর্থপূর্ণ উপলব্ধি ও ধারণা বিশ্লেষণের নৈপুণ্য, যুক্তিপ্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। বলা যায়, প্রতিভাবানরাই সৃষ্টিশীল, সৃষ্টিশীলরাই প্রতিভাবান। প্রতিভার এসব মনঃক্রিয়া সাহিত্য মতবাদের কোথায় প্রভাব ফেলে? প্রশ্ন আসতে পারে মাথায়। উত্তরে বলা যায় ভাববাদীদের ভাবনাতত্ত্বের প্রতিক্রিয়ায় রিয়ালিজম বা বাস্তববাদী মতবাদের উদ্ভব ঘটে। চরিত্র এবং ঘটনা অতিরঞ্জিত ও আদর্শায়িত না করে যথাযথ উপস্থাপনা এই মতবাদের সারকথা। তাহলে কি সাহিত্যে ‘কল্পনা’র মূল্য গুরুত্বহীন? আমরা লক্ষ্য করেছি, অ্যারিস্টটল স্বীকার না করলেও প্লেটো কল্পনাশক্তিকে সাহিত্যে গ্রহণ করেছেন, মূল্যবান বিবেচনা করেছেন। রোমান্টিক যুগের কবিদের মতে, কবিতার প্রকৃত স্রষ্টা কবিকল্পনা- এটি ফ্যান্টাসি নয়, কল্পনাশক্তি। এই শক্তির সঙ্গে স্মৃতি, অভিজ্ঞতা বা পুনর্গঠন ক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁদের মতে কবিকল্পনা আসলে সৃজনশীল প্রক্রিয়া বা সৃজনশীল কল্পনা। আর রবীন্দ্রনাথ কল্পনাকে আরও বিশাল শক্তিধর মনঃক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন; কেবল কবিরই কল্পনা নয়, রোমান্টিক কবিদের দাবি মেনে নিয়েও কয়েকটি ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেছেন, প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে কল্পনাশক্তি। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘যে-শক্তির দ্বারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের মিলনটা কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের মিলন না হয়ে মনের হয়ে ওঠে, সে-শক্তি হচ্ছে কল্পনাশক্তি।’ অর্থাৎ স্মৃতি বা অভিজ্ঞতানির্ভরতা কিংবা কেবলমাত্র অলৌকিক বিরাট কবিকল্পনা ইত্যাদি বিতর্কের যেকোনো আঙ্গিক বিশ্লেষণ করে বলা যায় এই কল্পনা হচ্ছে মনেরই শক্তি, মনেরই অঙ্গ, মনেরই বিপুল বিস্ফোরণ; বিস্ফোরিত শক্তির উদগীরণ।
মনের কত যে রূপ
মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক কিংবা মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি শব্দগুলো এসেছে ‘মন’ শব্দ থেকেই। আসলে প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রোমান্টিক যুগের কবিকুল এবং রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য আলোচনায় মনের বাইরে যেতে পারেননি, মনস্তত্ত্বকে অস্বীকার করেননি। মতভেদ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে, জোর গলায় তাই বলা যায়, সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের বাইরে কিছু নেই। পরিবেশ-প্রকৃতি ঘিরে সাহিত্যে নির্মিত হয়ে থাকে প্লট, চরিত্র; এই নির্মাণশৈলীতে একাকার হয়ে যায় ভাবাবেগ, চিন্তন কিংবা সৃষ্টিশীলতার অন্তর্লীন শক্তি। কেউ যদি এ নিবন্ধটি পড়ে নতুন ভাবনায় আক্রান্ত হন, যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করতে উদ্যোগী হন, সেটাও হবে মনঃশক্তির পরিচর্যা, মনঃশক্তির ব্যবহার। সুতরাং প্লেটোর ভাবনা, অ্যারিস্টটলের যুক্তি চিন্তন প্রতিভা, কবির কল্পনাশক্তি সবই সাহিত্যতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত; মনস্তত্ত্বের প্রাণরসায়ন।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রবীন্দ্রসাহিত্য আলোচনায় একজন গুণী লেখক প্রাঞ্জল ভাষায় রবীন্দ্রপ্রতিভা বিশ্লেষণে কল্পনাতত্ত্বের প্রসঙ্গ টেনে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কল্পনাশক্তি মনস্ততত্ত্বের কোনো বিষয় নয়, তাঁর কল্পনাশক্তি সৌরজগতের চেয়ে বিশাল, বড়। বক্তার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, হ্যাঁ নিশ্চয়ই বড়। অবশ্যই বিশাল। তবে যত বড়ই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই শক্তির মাধ্যমে মনের মিলন বা মনস্তাত্ত্বিক সংযোগের কথা বলেছেন। কবির এই অসীম কল্পনাশক্তি বায়বীয় কোনো বিষয় নয়। বরং এই কল্পনাশক্তি মনস্তত্ত্বেরই বিষয়-আশয়, অশেষ সৃজনক্ষমতার উৎস-উপাদান।
নিউরোসায়েন্স মন ও সাহিত্য
উপন্যাস মানে জীবনচিত্র। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞান। উপন্যাসের পাতায় পাতায় উঠে আসে সৃষ্ট চরিত্রের জীবনযাপনের কাহিনি- আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রাগ-ক্রোধ, ঈর্ষা কিংবা প্রতিহিংসা। মনের এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করে দেয় কথাসাহিত্যের চরিত্রদের বাইরের আচরণ। প্রত্যক্ষণ অথবা চিন্তনের ত্রুটি-বিচ্যুতি কিংবা পরিস্থিতি মূল্যায়নে ভুলভ্রান্তি নির্মাণ করে ব্যক্তির মনোজগতের অন্তর্নিহিত রূপ, গড়ে তোলে চারপাশের আবহ। মানবমনের অন্তর্জগৎ ও চারপাশের বহির্জগতের মধ্যে রয়েছে সামঞ্জস্যপূর্ণ গোপন যোগসূত্র। মনের জানালা সেই যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়। এসব জানালা হচ্ছে পঞ্চইন্দ্রিয়- চোখ, কান, নাক, ত্বক ও জিহবা। বহির্জগতের পরিবর্তন হলে পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অন্তর্জগতে মানসিক প্রক্রিয়ায় বয়ে যায় বদলের হাওয়া। আবার অন্তর্জগতে ঝড় বইলে বহির্জগতের আবহও বদলে যায়, বদলে যায় অভিব্যক্তি। এই যোগসূত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক সূত্র। মনঃবিশ্লেষণের মাধ্যমে সাহিত্যের ভেতর থেকে খুঁজে পাওয়া যায় মনোবৈজ্ঞানিক কলাকৌশল- প্রত্যক্ষণ, আবেগ, চিন্তা, বুদ্ধি, প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, কগনিশন (অবহিতি বা সচেতনবোধ), অন্তর্গত প্রেষণা বা ভেতরের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা-উৎসাহ-উদ্দীপনা, শিক্ষণ, বিশ্বাস, স্বপ্ন ইত্যাদি। এগুলোও মনের স্বাস্থ্যের অংশ, মনঃক্রিয়া বা মনের অন্তর্লীন উপাদান। এছাড়াও রয়েছে সচেতন উপলব্ধি (কনশাস ওয়ার্ল্ড), ব্যক্তিত্ব, চেতন-প্রাকচেতন-অবচেতনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এসব উপাদান মনস্তত্ত্বের বিভিন্ন মতবাদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে নিউরোসায়েন্স মতবাদ সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে মানুষের মন ও আচরণ বিশ্লেষণে। নিউরোসায়েন্স-এর দৃষ্টিকোণ থেকে মূলত আচরণের বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক কারণ খোলাসা করা হয়েছে। ব্রেনের দুই গোলার্ধ আলাদাভাবে কাজ করে- এই গবেষণার জন্য ১৯৮১ সালে নোবেল প্রাইজ জয় করেছেন রোজার স্পেরি। দৃশ্যমান আচরণকে গুরুত্ব দিয়েছে বিহেভিয়ারাল পারস্পেকটিভ (আইভান প্যাভলভ, ১৯২৭; এডওয়ার্ড থর্নডিক, জন বি ওয়াটসন)। হিউম্যানিস্টিক মতবাদে (আব্রাহাম মাসলো, ১৯৫৪; কার্ল রোজার্স, ১৯৬১) বলা হয়েছে, মানুষ তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, নিজের সুপ্ত প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারে।
পরিপার্শ্ব ও কগনিটিভ মতবাদ
সমসাময়িককালে মনোচিকিৎসাবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট হচ্ছে কগনিটিভ ওয়ার্ল্ড- নিজের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত এবং চারপাশ ও বৈশ্বিক পরিবেশ নিয়ে মানুষ কী চিন্তা করছে, সচেতনভাবে কী উপলব্ধি করছে তা-ই মুখ্য কগনিটিভ মতবাদে। এ সময়ের একজন মনোবিদ-মনোচিকিৎসক হিসেবে আমি মনে করি, কগনিটিভ মনোজগতের যথাযথ ব্যবহার বিশ্বসাহিত্যকে ভবিষ্যতে আরও বেশি সমৃদ্ধ করবে। কারণ কগনিটিভ মনঃক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করা হয় কনশাস বা মনের সচেতন অভিজ্ঞতা, চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি-অনুভব, উপলব্ধি, আকাঙ্ক্ষা, স্মৃতি ইত্যাদি নিয়ে। মানুষের ভিতরের অনুভব বা অন্তর্গত অন্ধকারকে বাস্তবতা ও সত্যের আলোয় নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তোলাই হচ্ছে এই মতবাদের প্রধান কাজ। এটির প্রধান গবেষক মনোবিদ অ্যারন টি বেক। বেকের গবেষণার সাফল্য হিসেবে ১৯৬৭ সালে মনোচিকিৎসাবিদ্যায় বিষয়টি উঠে আসে লাইমলাইটে। রবীন্দ্রনাথের সময়কালে বিষয়টির গুরুত্ব আবিষ্কৃত হয়নি মনস্তত্ত্বে। কগনিটিভ বা কগনিশন বা অবহিতি শব্দটি ব্যবহার করেননি রবীন্দ্রনাথ। তবে, এ প্রজন্মের মনোবিদ হিসেবে বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করেছি, শব্দটির অর্থবহতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে রবীন্দ্রচিন্তা-ভাবনা-উপলব্ধি ও সচেতন মনের ঐন্দ্রজালিক অনুভব। ‘সমাপ্তি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ অপূর্ব চরিত্রের মাধ্যমে পাড়া-বেড়ানি মৃন্ময়ীকে বাস্তবতার আলোকে জাগিয়ে তোলেন নতুন রূপে। এখানে রবীন্দ্রনাথ নিজের অজান্তেই বর্তমান সময়ের সফল মনোচিকিৎসা-কৌশল, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি তাঁর সময়কালেই ব্যবহার করে নিজেকে স্বভাবগত বিজ্ঞানী হিসেবে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানী বলার এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এ ধরনের আরও অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর সৃজনশীল সাহিত্যকর্মযজ্ঞে।
ফ্রয়েড ও সাহিত্য
আচরণ সৃষ্টিতে অবচেতনের অন্তর্গত শক্তির কথা বলা হয়েছে সাইকোডাইনামিক মতবাদে (সিগমুন্ড ফ্রয়েড, ১৮৫৬-১৯৩৯)। অন্তর্গত এই গোপন শক্তিতে মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তুলে ধরা হয়েছে এমন ধারণা। মতবাদটি নানাভাবে আলোচিত, সমালোচিত। মার্কিন মুল্লুকে মনোবিজ্ঞান সমিতির বিবেচনায় কোনো স্থান না থাকলেও সাহিত্যসেবীদের অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব, নিউফ্রয়েডিয়ান মতবাদ। পুরো বিংশশতাব্দী জুড়ে শিল্পসাহিত্যে ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। ফ্রয়েডের মতে, মানবমনের সহজাত প্রবৃত্তি (ইনস্টিংক্ট) হচ্ছে জীবনপ্রবৃত্তি (ইরোস) ও মরণপ্রবৃত্তি (থেনাটোস)। ইরোস-এর আড়ালে আছে দেহভোগ বা দেহতৃপ্তির গোপন তাড়না। মানুষের সব ধরনের আচরণের শেকড় গেড়ে আছে ইরোসের মূলে; যৌনতৃপ্তিই সেই শেকড়ের অন্যতম চাহিদা। কিন্তু বিতর্ক আছে। মানুষ এমন অনেক আচরণ করে যার সঙ্গে দেহতৃপ্তির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ফ্রয়েড যুক্তি দেখিয়ে বলেন, দুই ধরনের বিধিনিষেধের কারণে দেহতৃপ্তির আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ দেরিতে হয়, অথবা ভিন্ন বা পরিবর্তিত অন্যপথে লালিত গোপন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে। বিধিনিষেধের একটি হচ্ছে বাস্তবতা- ‘রিয়েলিটি’, অন্যটি হচ্ছে নৈতিকতা- ‘মোরালিটি।’ আত্মধ্বংসী প্রবৃত্তির সঙ্গে যৌনপ্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, সংঘাত বাঁধে। এ কারণে ধ্বংসাত্মক তাড়নার প্রকাশ ঘটে অন্যের প্রতি সহিংস আচরণ বা অ্যাগ্রেশনের মধ্য দিয়ে। ফ্রয়েডের মতামত পরবর্তী সময়ে সবাই একশত ভাগ মেনে নেয়নি। নিরপেক্ষ পাঠকের মেনে নেওয়ার প্রয়োজনও নেই। এ বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। হেনরি মুর এবং আব্রাহাম মাসলো মনে করেন, সব মোটিভ শারীরবৃত্তীয় চাহিদানির্ভর নয়। কিছু কিছু মোটিভ অর্জিত হয় সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায়। মানুষের চাহিদাকে সাতটি প্রধান গ্রুপে ভাগ করেছেন মাসলো- ধাপে ধাপে সাজিয়েছেন চাহিদাগুলো। সর্বনিম্ন চাহিদা হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় চাহিদা এবং সবার উপরে আছে পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তির চাহিদা। ফ্রয়েডীয় মতামতের পাশাপাশি এই মতবাদ বিশ্বসাহিত্যকে প্রভাবিত করলেও সাহিত্যতত্ত্বের সুররিয়ালিজম বা অধিবাস্তববাদ প্রাধান্য দিয়েছে একসমগ্রতা বা অভিন্নতাকে- যে অভিন্নতা গড়ে উঠেছে সংজ্ঞান ও অবচেতন মনের স্তরকে কেন্দ্র করে। সুররিয়ালিজমে ফ্রয়েডের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে অবচেতন মনের রহস্য উদঘাটনের কৌশল, হেগেলের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের সংস্কার এবং মার্কসের কাছ থেকে এটি গ্রহণ করেছে দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার আবেগ। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সুররিয়ালিজম। এ তত্ত্বে চেতন-অবচেতনের সব মনঃক্রিয়া একাকার হয়ে যায়। ফ্রয়েডের সজ্ঞান ও অবচেতন মনের স্তর, হেগেলের দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের সংস্কার এবং দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার আবেগ; জীবনানন্দ দাশের কাব্যধ্বনি সর্বত্রই রয়েছে মনস্তত্ত্বের নিপুণ কারুকাজ, মনঃশক্তির উদগীরণ।
মনের কত যে রঙ কত যে প্রকাশ
রোমান্টিসিজম, সেন্টিমেন্টালিজম, হিউম্যানিজম ইত্যাদি সাহিত্য-মতবাদেও প্রবলভাবে উপস্থিত রয়েছে মনস্তত্ত্বের অন্তর্লীন অনুরণন। রোমান্টিসিজমের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে রোমান্সের মতো স্বতঃস্ফূর্ত মনস্তাত্ত্বিক বিষয়- উত্তেজনা, ভয় বা বিস্ময়ে গায়ে কাঁটা দেওয়া; শিহরণ; পুলক, কিংবা উগ্র বা অস্বাভাবিক প্রেমকাহিনি, যেকোনো প্রণয়ঘটিত ব্যাপার, অলীক কল্পনায় রং মাখানো বর্ণনা; রোমান্টিক মানসিকতা ইত্যাদি। নিউরোসায়েন্স-এর দৃষ্টিকোণ থেকে রয়েছে রোমাঞ্চ কিংবা রোমান্সের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্রেনের জৈবরাসায়নিক পদার্থের রহস্যময় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এই বিমূর্ত প্রতিক্রিয়াগুলো মূর্ত হয়ে ধরা দেয় আচরণে। একজন নিপুণ কথাশিল্পী শৈল্পিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করতে পারেন অন্তর্গত সেই সত্যের বাস্তবরূপ। আর আদর্শ ও নীতিবোধ নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত আতিশয্য ও আবেগপ্রবণতা দেখা যায় সেন্টিমেন্টালিজমে। এই আবেগ হচ্ছে মনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা উপাদান। এই উপাদান অন্তর্গত প্রেষণা ও চিন্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কবি ও সাহিত্যিকের মধ্যে জাগিয়ে তোলে সাহিত্য সৃষ্টির গতিময় ধারা। যথাযথভাবে মন জোগানো সম্ভব না হলে মনঃসংযোগ তৈরি হয় না, মন জাগে না। মন জোগানো সম্ভব হলে ভাবনাতত্ত্ব বা চিন্তনে টান লাগে, জটিল গিঁট খুলে খুলে তখন জেগে ওঠে মন [মনস্তত্ত্বের ‘ফাইভ ফ্যাক্টর সূত্র’ : পরিবেশ (অতীত ও বর্তমান), চিন্তন, আবেগ, আচরণ, শারীরিক প্রতিক্রিয়া]। আবেগের সঙ্গে চিন্তনের রয়েছে পারস্পরিক যোগসূত্র। আবেগ বা চিন্তনের যেকোনো একটি মনঃক্রিয়া নাড়া খেলে আলোড়িত হয় অন্যটিও, পৃথকভাবে মন জেগে ওঠার সুযোগ নেই মনস্তত্ত্বে, সাহিত্যসৃজনে। মন জাগাতে হলে জোগাতেও হবে মন; মনের খোরাক। মনের নানা ধরনের খোরাকের মধ্যে আবেগ হচ্ছে অন্তর্লীন এক বিশেষ উপাদান বা মনঃক্রিয়া। কেবলমাত্র সেন্টিমেন্টালিজমে নয়, অতীতকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত আলোচিত সব ধরনের সাহিত্য-মতবাদে সৃষ্টিশীল সাহিত্য নির্মাণে আবেগের রয়েছে দৌর্দণ্ডপ্রতাপ। আবেগকে আলাদা রেখে সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে না। এ কথা বিশ্বাস করে গেছেন সময়ের শক্তিমান সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। কোনো কোনো মতবাদে সুনির্দিষ্ট বিশেষ মনঃক্রিয়া প্রাধান্য পেলেও কখনো সাহিত্যসৃষ্টি কিংবা মূল্যায়নে আবেগের স্থানচ্যুতি ঘটেনি কোথাও। ভাববাদ কিংবা যুক্তিবাদ, যাই বলি না কেন, সর্বত্রই চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কের কারণে সাহিত্যের মূল প্লাটফর্মে রয়েছে আবেগের উজ্জ্বল উপস্থিতি। আবেগের শ্রেণিবিন্যাস করা যায় এভাবে : ইতিবাচক আবেগ (যেমন ভালোবাসা, আনন্দ, মায়ামমতা, সুখ, উল্লাস ইত্যাদি), নেতিবাচক আবেগ (রাগ, বিরক্তি, দুঃখ-কষ্ট, ভয়, ঘৃণা, লজ্জা ইত্যাদি), মিশ্র আবেগ (জেলাসি = ভালোবাসা + রাগ, নিরাশা = দুঃখ + বিস্ময় ইত্যাদি), ও তীব্রতার ভিত্তিতে আবেগের মাত্রাগত স্তর (ভয় : অস্বস্তি, খিটখিটে, সন্ত্রস্ত কম্পমান অবস্থা অতি ভীতি সন্ত্রস্ত অবস্থা- প্যানিক; বিরক্তি, রাগ, রাগে উন্মত্ততা ইত্যাদি)। ‘সস্তা আবেগ’ বলে কোনো শব্দ নেই বিজ্ঞানে, সাহিত্যেও নেই। অথচ কোনো কোনো সাহিত্য-সমালোচক ‘সস্তা’ শব্দটি ব্যবহার করে আবেগের মূল্যকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করেন। তবে লেখকের রচনায় আবেগ প্রকাশের ধরনটি হতে পারে সহজ; এটা বোঝাতে ‘সস্তা’ শব্দটির প্রয়োগ অযথার্থ হবে না। কিন্তু মানবীয় কোনো আবেগই ‘সস্তা’ হতে পারে না। আসলে শব্দটি ব্যবহার করে তাঁরা প্রকাশ করে থাকেন আবেগ-বিষয়ে নিজেদের অজ্ঞতা। সাহিত্যের কাঠামো বা আঙ্গিক, ভাষা, সংলাপ, বর্ণনা ভঙ্গি বা প্রকাশ মাধ্যম, রূপক-উপমা, ক্রিয়াপদের কালরূপ ব্যবহার, মনস্তাত্ত্বিক ও দর্শনতত্ত্বের উদঘাটন বা বিষয়-বৈচিত্র্যের গভীরে প্রবেশ না করে সাহিত্য-আলোচনায় ভাবোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হয়ে কোনো কোনো সমালোচক ব্র্যান্ডেড সাহিত্যিক কিংবা ঘনিষ্ট লেখকের সৃষ্টিকে মূল্যায়ন করেন চমকপ্রদ শব্দচয়নের মাধ্যমে। এই ভাবোচ্ছ্বাসের সময় সাধারণত ইতিবাচক আবেগে আক্রান্ত হয়ে আলোচনার নামে শুধুমাত্র গুণকীর্তন কিংবা প্রশংসায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন তাঁরা। এখানেও সমালোচকের আবেগের দোষ নেই। বলা যায়, এটি সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা। এটাকে মোটেও সুস্থ সাহিত্য-সমালোচনা বলা যায় না। অপরিচিত বা অপছন্দনীয় কোনো লেখকের সাহিত্যকর্মের আলোচনায় নেতিবাচক আবেগ ও চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে ধারাল শব্দের দ্বারা স্থূলভাবে আক্রমণ করেন অনেক সমালোচক। এটাও সমালোচনা-সাহিত্যের নেতিবাচক দিক। মূলত সমালোচনা-সাহিত্যের জন্য সাহিত্যের সবধরনের কলাকৈৗশল, কলকব্জা লেখকদের চেয়েও বেশি জানতে হবে সমালোচকদের; হতে হবে নিরপেক্ষ ও নির্মোহ। শক্তিমান সমালোচকরাই খুঁজে পান সৃষ্টিশীল সাহিত্য, সৃজনশীল কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের।
সাহিত্যতাত্ত্বিক মতবাদ হিউম্যানিজমে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মানুষকে। মানুষের জীবন, তার কর্মময়তা, তার ধর্ম এসবের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। জীবনের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে মনোবিজ্ঞানের কলকব্জা। জীবনের সেই কলকব্জা খুলে খুলে, কিংবা মৌলিকভাবে লেখক নির্মাণ করেন অবিস্মরণীয় সব চরিত্র। কালজয়ী সাহিত্যে সেই চরিত্ররা যুগ থেকে যুগে প্রভাবিত করে আসছেন চলমান সাহিত্যধারা, জীবনবোধ। তাই বলা যায় কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিকরা সৃজনশীল। তাঁরা জীবনের চিত্র খুঁড়ে খুঁড়ে, বিশ্লেষণ করে, শব্দের বুনটে প্রতিবিম্বিত করতে পারেন নতুন জীবন। শব্দ-বুননে স্বতঃস্ফূর্ত বা স্বভাবজাত গুণাবলীর কারণে তাঁরা ব্যবহার করেন প্রতিভা- কল্পনাশক্তি, স্মৃতিশক্তি, সৃজনশীলতা, অর্থপূর্ণ উপলব্ধি ও ধারণা বিশ্লেষণের নৈপুণ্য, যুক্তিপ্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা চিন্তনশক্তি, আবেগ, প্রত্যক্ষণ, সচেতনবোধ বা কগনিশন, অন্তর্গত প্রেষণা বা ভেতরের আকাঙ্ক্ষা চাহিদা-উৎসাহ-উদ্দীপনা ও শিক্ষণ- মনের স্বাস্থ্যের এসব কলকব্জা। এভাবেই সৃষ্টি হয়ে যায় সমৃদ্ধ, জীবনঘনিষ্ঠ মৌলিক সাহিত্যসম্ভার। ব্যঞ্জনাময় উপস্থাপনার মাধ্যমে সৃজনশীল মেধার স্ফূরণ ঘটে- সৃজনশীল সাহিত্য ও শিল্পকর্মের বিস্তৃতি এভাবেই ঘটে চলেছে সমকালে। ঘটতে থাকবে যুগ থেকে যুগান্তরে। তাই, আলোচ্য বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, কবি গল্পকার ঔপন্যাসিকরা কেবল সৃজনশীলই নয়, তাঁরা একধরনের বিজ্ঞানীও।
_______________________
আপনার মতামত দিন: