Ameen Qudir
Published:2016-12-24 20:16:37 BdST
কন্যা সন্তান কি শুধু মা জন্ম দেয় ! বাবা দেয় না?
________________________________
ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী
________________________
সারাটা জীবন ধরেই মিটি ওর বাবার সাথে বেশ উচ্ছল আর ভীষন প্রাণ খোলা।কিন্তু মায়ের সাথে তার কেমন যেন একটা চাপা দুরত্ব।তার মানে এই না যে মা তার প্রতি এক বিন্দু ও কম আন্তরিক বা ও ওর মাকে কম ভালবাসে।ব্যাপারটা এর থেকেও বেশী কিছু!মা যেন কেমন ভীষন গভীর।মিটি যেন কিছুতেই তার তল খুঁজে পায় না।তবু জীবনে যত বিপদ,যত জটিলতা এসেছে তার গাট ছড়া এই মা ই খুলে দিয়েছেন!তাই আজকের বিপদে ও উদ্ধারকর্তা মা ই হবেন!মিটি একটি সরকারী মেডিকেল কলেজের বায়োকেমিষ্ট্রির লেকচারার।ওখানকার ডরমেটরীতেই থাকে।বাবার জরুরী তলব পেয়ে তড়িঘড়ি এসেছে।এসে জানা গেল এখানকার বিশাল ব্যবসায়ী,স্থানীয় এমপির ছোট ভাইয়ের ছেলের সাথে ওর বিয়ের কথা পাকা।তাদের অনেক টাকা।বাড়ী,গাড়ী,মিল,ফ্যাক্টরী।শুধু একটাই শর্ত।বিয়ের পরে মিটি চাকরী করতে পারবে না।ওদের ডাক্তার বউ ছাড়া আর কিছু চাই না।মিটির মায়ের মত অত গভীরতা নেই।চাকরী না করাতে কোন আপত্তি ও নেই।মায়ের চাওয়া পূরন করতেই সে কষ্ট করে পড়েছে।বিয়ে হলে খাবে দাবে, ঘুরে বেড়াবে!বরাবরের মত এই জটিল ডিসিশনের ভার ও মায়ের উপর পড়ল!মা আজ আরো গম্ভীর!ভীষন চুপচাপ।
রাতের খাওয়া শেষে মা মিটির ঘরে এলেন।একটা কাল রংয়ের কাভার দেয়া মোটা ডায়েরী মিটির হাতে দিয়ে বললেন,এর মাঝেই তোমার সিদ্ধান্ত লুকিয়ে আছে।।
মা চলে গেলে মিটি গোটা গোটা হাতে লেখা ডায়েরীটা পড়তে লাগল............
. আজ প্রথম নয়।বিয়ের শুরু থেকেই দেখছি অত্যন্ত কদাচার ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলতে।আজ একটু প্রতিবাদ করেছিলেম মাত্র।এত ভয়ানক চিৎকার করল আসাদ যে ওর বাড়ীর সকলে ও ঘরে ভীড় জমাল।লজ্জায় আমি মারা যাচ্ছি।।
. নেহায়েত ই সামান্য বিষয়।আমার মন ভাল ছিল না।ছোট দেবর খুব খোঁচা দিয়ে কথা বলল - আমার মাছ কাটা তার পছন্দ হয়নি বলে।কখন যে নালিশ হয়েছে জানি না।বাবার বাসায় আসছিলাম।ভরা বাসে বসে সে কি চিৎকার!আমার ব্যাগ থেকে সব কাপড় গয়না ছুড়ে ফেলল।আমি নীচের দিকে চেয়ে ছিলাম।ক্রমাগত কাঁদছিলাম।খুব মরে যেতে
ইচ্ছে হচ্ছিল।।
. দিন যতই যাচ্ছে ততই রোগা হচ্ছি।হাত পা ফুলে যাচ্ছে।আমার চেহারা দেখে শ্বাশুড়ী মায়ের মনে হয়েছে আমার মেয়ে হবে।তাই আসাদ আমাকে বাপের বাড়ী রেখে গেল।এ বাড়ী থেকে স্কুল ও দুরে।বাচ্চা পেটে এত জার্নি করে স্কুল শিক্ষিকার চাকরী টা না হারাই।একটা খবর ও নিচ্ছে না ও বাড়ীর কেউ।আমি মরে গেলেই বা আমার বাবুটার কি হবে???
. চাঁদের মত ফুটফুটে একটি মেয়ে।নাম দিয়েছি মিটি।আট মাস বয়সে তার বাবা তাকে প্রথম দেখল।কিসের এত রাগ??মেয়ে জন্ম কি আমার হাতে???
. এত অপমান??মিটির জন্য কিছু দরকারী জিনিস কিনে নিজের জন্য ও একটা ক্রীম কিনলাম।দোকানদারকে আসাদ জিজ্ঞাসা করল বাচ্চার জিনিসের দাম কত?ঐ দামটা দিয়ে আমায় বলল,তোমার ক্রীমের দাম তুমি দাও!!!!আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
. নাহ!রোজ রোজ এই অশান্তি আর না!মিটি খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে।কি কুৎসিত গালি সকলের!আমার থেকে খারাপ মা নাকি আর নেই।আমি নাকি স্কুলে যাই ঢলাঢলি করতে।জানি ভীষন রকমের অর্থকষ্টে পরতে হবে আমাকে।তবু এই চাকরী আমি কাল ই ছেড়ে দিব।।
. আজ প্রথম বার নয়।এই নিয়ে বহুবার হলো আসাদ আমার গায়ে হাত তুলছে।তুই তোকারি করছে।লোভী আরো জঘন্য সব গালি দিচ্ছে।।আমি ই বা কেন এত উতলা হলাম??কেন বলতে গেলাম,বাড়ীর সকলের জন্য সে ঈদের পোষাক কিনেছে।শুধু আমার আর মিটির জন্যেই কিনেনি।মিটির চার চলছে।আমার চাকরী নেই।নতুন জামা ছাড়া ঈদ হবে ওর??নাহ!একটা শাড়ী কেটে দিব্যি ফোলানো জামা বানিয়ে দিব হাতে সেলাই করে।।কেন যে চাকরীটা ছাড়লাম।
. মিটি বড় হচ্ছে।স্বপ্ন ছিল ওকে বন্ধুর মত সব শেয়ার করব।নাহ!পারছি না।প্রতিদিন ই ঝগড়া।কথায় কথায় গায়ে হাত।ওর কাছে সযতনে সব লুকিয়ে যাচ্ছি।বাবা খুব অসুস্থ।টাকা দরকার।আসাদের কাছে চাইলে অনেক অপমান সইতে হবে।বোনের বিয়ে,ভাইয়ের ছেলের খাৎনাতে এক জোড়া কানের দুল বিক্রি করেছি।এবার চেইন টা বিক্রি করব।বাবা বিনে চিকিৎসায় মারা গেলে গয়না দিয়ে কি হবে?
. ছোট খালার মেয়ের বিয়ে।যেতেই হবে।কিন্তু টাকা নেই।আমার কোন ভাল শাড়ী নেই।উপহার কিনতে গেলে আসাদের মার খেতে হবে।তাই মিটির পরীক্ষা জানিয়ে চিঠি লিখেছি।ছেলেবেলার দিনগুলো খুব মনে পড়ছে।কত স্মৃতি এই নানা বাড়ীর সকলের সাথে।আর তো ভাল লাগে না।এ তো জীবন না।যেন এক জেলখানা।।এত অপমান!অত্যাচার!দারিদ্রতা!আমার স্বামীর অনেক টাকা।অথচ আমার মত গরীব কেউ নেই।যখন মিটি অনেক বড় হবে।চাকরী করবে.....!আমি অনেক দূরে চলে যাব।অনেক দূরে!
এই সব অনাস্থা,অপমান,কষ্টদের আড়ি দিয়ে স্বাধীনতার সাথে সখ্যতা গড়ব........!
এখন অনেক রাত।মিটির হাত পা কাঁপছে।তার স্নেহময়ী বাবাই তারা গম্ভীর মায়ের কান্নার কারন???চোখেমুখে পানি দিয়ে ব্যাগ গুছাতে লাগল মিটি।সে তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।মেডিকেল কলেজের আইটেম মেট নীরব সার্জারীতে এফসিপিএসে চান্স পেয়ে জানতে চেয়েছিল সার্জনের সাথে ঘর করতে আপত্তি আছে নাকি???হেসেই উড়িয়েছিল মিটি।আজ মনে হচ্ছে আপত্তি নেই।তবে এখন থেকে ওর মার জীবনের স্বাধীনতার আশ্রয় হবে ও।এই বাড়ীতে মা আর এক মুহুর্ত নয়।নীরবকে জিজ্ঞাসা করতে হবে হবু সার্জন নীরবের মেডিকেল কলেজের মাষ্টারনীর সাথে ঘর করতে আপত্তি আছে কিনা !!!!
_________________________________
লেখক
ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী । জনপ্রিয় কলামিস্ট। কথাশিল্পী। মেডিকেল অফিসার, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
আপনার মতামত দিন: