Ameen Qudir

Published:
2017-04-24 16:50:02 BdST

প্রাণ বাঁচাল হুইস্কি


 

 

 


শিশির রায়

_______________________


মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে নাকি নিজের আগাপাশতলা জীবনটাই শো-রিলের মতো ঘুরে যায় চোখের সামনে। অন্তত হলিউড-ছবি তা-ই দেখায়। কিন্তু এখন বেঁচে আছি, আর এই মেরেকেটে ঘণ্টা দুয়েক পর মরে যাব, জেনে গেলে, কী করতে ইচ্ছে হয় ওই মাঝের নো-ম্যান’স ল্যান্ড মার্কা সময়টুকুতে? প্রেমের কবিতা, বিরহী সুর মনে পড়ে শুধু? জীবনের যা কিছু গভীর গোপন, সেই সব স্বীকারোক্তি উগরোতে ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সামনে? উত্তরটা দিতে পারতেন চার্লস জকিন। গত ১৪ এপ্রিল ১০৫ বছর পূর্ণ হল টাইটানিক জাহাজডুবির, চার্লস ছিলেন সেই প্রমোদতরীর ‘চিফ বেকার’। দু’হাজারেরও ওপর যাত্রী আর কর্মী জাহাজে, তাদের জন্য রুটি-কেক-পেস্ট্রি বানানো আর জোগান দেওয়া মুখের কথা? সেই দায়িত্বেই ছিলেন চার্লস আর তাঁর সঙ্গী ডজন ‌খানেক লোক। ১৪ এপ্রিল রাতে টাইটানিক যখন ধাক্কা খেয়েছে হিমশৈলে, মস্ত ছ্যাঁদা হয়ে গিয়েছে জাহাজের খোলে আর হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে আটলান্টিকের বরফশীতল জল, চার্লস তখন দিনের কাজ শেষে নিজের বাঙ্কে। বিপদঘণ্টি শুনে যখন দুদ্দাড়িয়ে উঠে এলেন জাহাজের ডেক-এ, ক্যাপ্টেন তখন লাইফবোট ভাসানোর নির্দেশ দিচ্ছেন, বোঝাচ্ছেন কোন বোটে কী ভাবে তুলে দিতে হবে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধদের। চার্লস বুঝে গেলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত না যেতে পারে (তখনও একটাও বিশ্বযুদ্ধ হয়নি), কিন্তু ‘আরএমএস টাইটানিক’ ডুবতেই পারে।
পারে না, ডুবছেই।
দশ বছর বয়স থেকেই চার্লস খুব ভাল চেনেন দুটো জিনিস— জাহাজ আর জল। কাজ করেছেন একের পর এক জাহাজে, পরে ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ কোম্পানিতে (টাইটানিক যে সংস্থার জাহাজ) চাকরি পান। রাঁধুনি তো কী, জাহাজি তো। এত বছরের অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে, সমুদ্রের বুকে কোন বিপদের ধারভার কতটা। আর যাত্রীবাহী জাহাজে জীবন বিপন্ন হলে, কর্মীরা আগে প্রাণ বাঁচাবেন যাত্রীদের, এটাই নিয়ম। টাইটানিক ডুবতে বড়জোর দু’ঘণ্টা, জানার পর দেরি করার মতো সময় বা বিলাসিতা ছিল না চার্লসের হাতে।
ডেক-এ বাঁধা লাইফবোটগুলো তখন নামানো হচ্ছে সমুদ্রে। চার্লস প্রথমেই জাহাজের বেকারি থেকে পেটি পেটি রুটি এনে বোটগুলোয় ফেললেন। রাতের হিমশীতল সমুদ্রে মৃত্যুভয় ডিঙোতে শুধু মনে জোর না, পেটে খাবারও চাই যে! তার পর অন্য কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, শিশু ও মহিলাদের ডেকে তুলে দিলেন বোটে। ১০ নম্বর লাইফবোটে চার্লসেরও একটা আসন বরাদ্দ, কিন্তু চার্লস নিলেন না সেই আসন। লাইফবোটটা জলে নামানোর ঠিক আগে, নিজের জায়গা ছেড়ে দিলেন অন্য এক যাত্রীকে।
কেউ কস্মিনকালেও ভাবেনি, টাইটানিক কখনও জলে ডুবতে পারে। সেই দম্ভেই কি না জানা নেই, জাহাজের ভাঁড়ারে যাত্রীসংখ্যার তুলনায় ঢের কম লাইফবোট ছিল।
চার্লস চলে গেলেন জাহাজের মদের ভাঁড়ারে। টাইটানিকের মদের ভাঁড়ারে ছিল শ্রেষ্ঠ পানীয় সব— ১৫০০ বোতল ওয়াইন, ১৫,০০০ বোতল শ্যাম্পেন, ২০,০০০ বোতল বিয়ার, ৭০ পেটি কনিয়াক। চার্লসের প্রিয় হুইস্কি, তিনি একটা বোতল নিয়ে বসলেন। খেতে লাগলেন ধীরেসুস্থে। জানতেন, টাইটানিক ডুবছে। এপ্রিলের রাতে বরফ-ঠান্ডা আটলান্টিকের জলে লাইফবোটহীন নামা মানে মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা। অমোঘ, অবধারিত মৃত্যুকে আটকানো যাবে না, তবে বেহেড মাতাল হয়ে গেলে, মৃত্যুযন্ত্রণা যদি একটু কমে!
এক ঘণ্টা ধরে হুইস্কি খেয়ে, চার্লস ফিরে গেলেন জাহাজের ডেক-এ। সমুদ্র থেকে তখন ভেসে আসছে ত্রস্ত আর্তনাদ। চার্লস মদ খেলেও, মাতাল হননি। সেই সংকটমুহূর্তেও, টাইটানিকের ডেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চেয়ারগুলো ছুড়ে দিলেন জলে, সেগুলো আঁকড়ে যদি বাঁচতে পারে কেউ! জাহাজ তখন হেলে পড়ে, ডুবতে শুরু করেছে। চার্লস এক বার প্যান্ট্রিতেও যান জল খাবেন বলে, ঠিক তখনই টাইটানিকের এক দিকের অনেকটা অংশ ভুস করে ডুবে যায়। জাহাজের গায়ের ‘সেফটি রেল’ বেয়ে জলে নামেন চার্লস। ক্যামেরন সাহেবের ‘টাইটানিক’ ছবিতেও দেখা গিয়েছিল, ডুবন্ত জাহাজের রেলিঙে, জ্যাক আর রোজ-এর পাশেই ব্র্যান্ডির ফ্লাস্ক হাতে চার্লস-এর চরিত্রকে (অভিনয় করেছিলেন লিয়াম তুহি)।
চার্লসের বয়ান অনুযায়ী, টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পর প্রায় দু’ঘণ্টা জলেই ছিলেন তিনি। অথচ ডোবেননি, মাথার চুলও তেমন ভেজেনি! আরও আশ্চর্য, তাঁর একটুও ঠান্ডা লাগেনি! ভোরের আলো ফুটতে দূরে একটা লাইফবোট দেখতে পেয়ে সাঁতরে যান, কিন্তু তাতে চার্লসকে তুলে নেওয়ার মতো জায়গা ছিল না। সে অবস্থাতেই নৌকোর একটা পাশ আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যত ক্ষণ না আর একটা লাইফবোট আসে। চার্লস সাঁতরে গিয়ে ওঠেন সেটায়। আরও পরে, উদ্ধারকারী জাহাজ ‘আরএমএস কার্পেথিয়া’ তুলে নেয় চার্লস সহ টাইটানিকের বেঁচে যাওয়া অন্য মানুষদের।
আটলান্টিকের বরফঠান্ডা জলে যেখানে মরে যাওয়ার কথা, সেখানে চার্লসের পা দুটো ফুলে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। ডাক্তাররা বলেছিলেন, চার্লসের প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল ওই হুইস্কিই। অতটা অ্যালকোহল শরীরে ছিল বলেই তাঁর কিছু হয়নি। দেখা গিয়েছে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যালকোহল পেটে গেলে বরং ‘হিট লস’ কম হয়, প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। চার্লসের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল। দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের সলিলসমাধি ঘটেছিল যে দুর্ঘটনায়, সেটাই চার্লস এড়াতে পেরেছিলেন স্রেফ এক বোতল হুইস্কির দৌলতে!

_____________________________

শিশির রায়
। প্রবাসী মানবতাবাদী লেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়