Ameen Qudir

Published:
2017-01-16 17:27:16 BdST

ডাক্তাররাও তো মানুষ !


   


অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ

_________________________________


১৯৮০ সালের কথা। সবে ডাক্তারি পাস করে ইন্টার্নশিপ কমপ্লিট করার পর সরকারি চাকরি নিয়ে থানায় পোস্টিং পেলাম। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কারণ আগেই জানতাম থানায় পোস্টিং হওয়া মানেই নানারকম প্রতিকূলতা। থাকা-খাওয়ার সুবিধা নেই, নিরাপত্তার অভাব, চিকিৎসাব্যবস্থা, ওষুধ আর সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতা তো আছেই।


আমরা চিকিৎসকরা ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’-এর মতো জোড়াতালি দিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলাম। হাসপাতালে কী নেই, সে তালিকা করতে গেলে ফর্দ অনেক দীর্ঘ হবে, তার চেয়ে কী আছে সে হিসাব রাখাই ভালো। বহির্বিভাগে নানারকম রোগী আসে, সবারই চিকিৎসা দিতে হয়। দরিদ্র রোগীর সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি খোঁজ রাখতে হয় ভর্তি থাকা রোগীদেরও।

 

দু-এক দিন না যেতেই বহির্বিভাগে সকালে রোগী দেখছি, হঠাৎ কয়েকজন লোক আমার কাছে এসে হাজির। তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। খুব অনুনয়-বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলেন দ্রুত তাদের সঙ্গে যেতে। এক মহিলা প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন। ব্যথা উঠেছে অনেক আগেই, কিন্তু বাচ্চা আটকে আছে, বের হচ্ছে না। মায়ের অবস্থাও ভালো নয়। বাচ্চার অবস্থাও ক্রমে খারাপের দিকে যাচ্ছে। আরও দেরি হলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে। আমি নবীন ডাক্তার। তা ছাড়া পুরুষ হিসেবে ডেলিভারি করানোটা তখনো সামাজিকভাবে গ্রামে-গঞ্জে ততটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও মহিলা ডাক্তার কেউ ছিল না। তাই ইতস্তত করছিলাম।

অনেক অনুরোধের পর মনে অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর ভয়ভীতি নিয়েই রোগী দেখতে গেলাম। গিয়ে আঁতকে উঠলাম, দেখি বাচ্চার শরীর বের হয়ে আছে কিন্তু মাথা ভিতরে। এ অবস্থায় কোনো হাসপাতালে নেওয়াও সম্ভব ছিল না। খুব বিপদে পড়ে গেলাম, কী থেকে কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। মাথায় একটাই ভাবনা, কীভাবে ডেলিভারিটা করা যায়। হাতে যে এক জোড়া গ্লাভস পরব, সেই সুযোগ কই? নানা ঝক্কি-ঝামেলা করে নারিকেল তেল ব্যবহার করে বাচ্চা বের করে আনলাম। মা ও বাচ্চা দুজনই আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেল। আমার ডাক্তারি জীবনের প্রথম বড় কোনো সার্থকতার দিন সেটি। নবজাতকের স্বজনরা সেদিন আমায় যে কত কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছিলেন, তা বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমি যদি সেদিন সফল না হতাম, তাহলে? হয়তো বা নিশ্চিতভাবেই জুটত ধিক্কার, গালাগালি আর লাঞ্ছনা। কয়েক বছর আগে আমার বর্তমান কর্মস্থলে বসে কাজ করছি।

 

এমন সময় এক ভদ্রলোক খুব সুন্দর একটি ছেলেকে নিয়ে হাজির। চিনতে পারছিলাম না। ছেলেটাকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘এ আমার একমাত্র ছেলে, যাকে আপনি সেই ১৯৮০ সালে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন। ছেলেটি ডাক্তার হতে চলেছে। দোয়া করবেন, যেন আপনার মতো একজন ডাক্তার হয়ে দেশ ও দশের সেবা করতে পারে। ’ তাদের চোখের অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধার উষ্ণ প্রস্রবণ আমার কাছে বড় কোনো পদকের চেয়ে মোটেও কম মনে হয়নি। আমিও কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। এই দীর্ঘ জীবনে এমন অনেক মুহূর্তের সাক্ষী হতে হয়েছে আমাকে।

শুধু আমি নই, সব চিকিৎসককেই কর্মজীবনে কমবেশি এসব ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবেগের কাঁটাগুলো কিছুটা ভোঁতা হয়ে আসে। আবার কখনো কখনো প্রচ্ছন্ন অহংকারে বুকটাও ফুলে ওঠে! মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন কারও কিছু করার সামর্থ্য থাকে না, ঠিক সেই সময়টায় আমরা চিকিৎসক হিসেবে আগ বাড়িয়ে যাই। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সেবা করার যে দারুণ সুযোগ আমাদের দিয়েছেন, সেজন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

 


যে সময়ের ঘটনার কথা বললাম, তখন গ্রাম বাংলার চিকিৎসাব্যবস্থা এমনটাই ছিল। কঠিন রোগব্যাধি হলে একমাত্র আল্লাহ বা নিয়তির ওপর ভরসা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। গ্রাম্য কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ, মাজারে মানতসহ কুচিকিৎসা-অপচিকিৎসা— এসবের ওপরই মানুষ নির্ভরশীল ছিল। এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, হাতে হাতে আধুনিক প্রযুক্তির মুঠোফোন, ইন্টারনেট— সব জায়গায় দিন বদলের ছোঁয়া। একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও হয়েছে অগ্রগতি। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় ওষুধের আবিষ্কার— এক কথায় সব ক্ষেত্রে চিকিৎসাব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, জয় করা গেছে বহু দুরারোগ্য ব্যাধি। শল্যচিকিৎসায়ও অনেক অগ্রগতি হয়েছে। জিনতত্ত্ব জানার সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচন হয়েছে বহু জটিল রোগের কারণ ও ব্যাখ্যা। মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বাড়াতে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

 

সময়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক আর রোগীদের মূল্যবোধ ও চিন্তাধারাও কি কিছুটা বদলায়নি? এত উন্নতির মাঝেও রোগীদের প্রত্যাশা কি শতভাগ পূর্ণ হয়েছে? প্রায়ই রোগীরা অভিযোগ করেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারকে পাওয়া যায় না, তারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনেন না, ভালো করে রোগী দেখেন না, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন না। রোগী বা তার স্বজনদের প্রত্যাশা হলো, চিকিৎসকের কাছে গেলে বা হাসপাতালে এলেই যেন তত্ক্ষণাৎ ডাক্তার পাওয়া যায় এবং চিকিৎসাও শুরু হয়। অনেক সময় নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে রোগীকে ভালো করে দেখা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, চিকিৎসা শুরু হওয়া মাত্রই যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়া যায় ইত্যাদি। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের আরও অভিযোগ— ওষুধ নেই, বিছানাপত্র ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি ঠিক নেই, খাবারের মান ভালো নেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, এমনকি ডাক্তার-নার্স আসেন না, ভালো করে দেখেন না ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এগুলো রোগীদের আকাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত। অন্যদিকে চিকিৎসকের কথাই ধরা যাক। নানা সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতার কারণে চিকিৎসকরা এখনো সেবার জন্য নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। তাদেরও যে ভুলভ্রান্তি, দোষত্রুটি, অদক্ষতা বা অবহেলা নেই, তা নয়। রোগী আর তার স্বজনরাও স্বাভাবিকভাবেই সন্তুষ্ট নন, আস্থা বা ভরসা রাখতে পারছেন না চিকিৎসকের ওপর। নিতান্ত বাধ্য হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন একটা অপ্রাপ্তির রেশ আর বিশ্বাসের ফারাক। চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন, কিন্তু রোগীর প্রত্যাশা মিটছে না।

 

দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই রোগীও বেশি। হাসপাতালগুলোয় রোগীর অত্যধিক চাপ। গ্রামগঞ্জ, উপজেলা এমনকি জেলাসমূহেও প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার, জনবল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রচণ্ড অভাব। ফলে ডাক্তাররা, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা চাপের মধ্যে থাকেন, চিকিৎসা দিতে হিমশিম খান। আবার অসংখ্য রোগী আর দায়িত্বের চাপে পিষ্ট চিকিৎসকও রোগীর কথা সময় নিয়ে শোনার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। কারণ তিনিও তো মানুষ।


দ্র. অাগামী কাল পড়ুন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ স্যারের এই অনবদ্য কথামালার দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

 

_____________________________________________________


লেখক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ একুশে পদকপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চিকিৎসক। ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়