Ameen Qudir

Published:
2018-03-15 15:58:50 BdST

এখনও যে কত কাজ করা বাকি



শ্রাবণী বসু
কলকাতা

মৃত্যুর সান্নিধ্যে অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে বসবাস করতে করতে হয়তো মৃত্যুভয় কাটিয়ে উঠেছিলেন স্টিফেন হকিং। তাই বলতেন, ‘‘মরতে ভয় পাই না, কিন্তু মরার কোনও তাড়াও নেই। কত কাজ এখনও যে বাকি।’’

সেটা ১৯৬৩। ২২ বছর বয়সের এক উজ্জ্বল কলেজছাত্র তিনি, যখন চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, জটিল মোটর নিউরন রোগ বা ‘অ্যামিওট্রোপিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস’ (এএলএস)-এ আক্রান্ত স্টিফেন। আস্তে আস্তে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব বিকল হয়ে যাবে। দু’-তিন বছরের মধ্যে অবধারিত মৃত্যু। শুনেছিলেন। প্রথম কয়েক মাস গভীর হতাশায় ডুবেও গিয়েছিলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে তা কাটিয়ে ওঠেন। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি। কখনও বলেননি, ‘‘যদি আমার এই অসুখটা না-হত, তা হলে...।’’

এক সাক্ষাৎকারে লিখেছিলেন, ‘‘আমাকে হরহামেশাই জিজ্ঞাসা করা হয়, এএলএসে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে আমার মনের ভাবটা কী রকম। আমি সব সময়ে বলি, এ নিয়ে আমি তেমন কিছু ভাবি না। সাধারণ মানুষের মতোই বাঁচার চেষ্টা করি, এই অসুখের ফলে যা যা করতে পারি না, তা নিয়েও ভাবি না। আর সত্যি বলতে কী, না-পারার তালিকাটা বিশেষ বড়ও নয়।’’ শুধু এ-টুকুই নয়। হকিংয়ের কথায়, ‘‘অসুখ ধরা পড়ার আগে বেশ বোরিং জীবন কাটাতাম। সে দিক থেকে দেখলে, অসুখটা থেকে অনেক কিছু পেয়েওছি।’’ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আর তীক্ষ্ণ রসবোধ। এটাই স্টিফেন হকিং।

আর অবশ্যই পপতারকার মতো খ্যাতি। জনপ্রিয়তার নিরিখে আর কোনও বিজ্ঞানী তো তাঁর ধারেকাছে নেই। অস্কারজয়ী সিনেমা থেকে কার্টুন-সিরিয়ালে উপস্থিতি, পপুলার কালচারের অন্যতম আইকন ছিলেন হকিং। এই খ্যাতির কারিগর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত, এক কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হওয়া তাঁর ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। সব থেকে ‘না-পড়া’ বইয়ের তকমা কয়েক বছরের মধ্যেই সেঁটে দেওয়া হয় যার গায়ে। ‘‘না-পড়া? হবে হয়তো,’’ বলতেন হকিং। ‘‘তবে আমার নার্সদের বইটা পড়ে শোনাতাম। তাঁরা তো দিব্যি বুঝতে পারতেন।’’ ‘শোনাতাম’ কথাটাও ইঙ্গিতবহ। কারণ ইতিমধ্যেই ট্র্যাকিওটমির ফলে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন হকিং। স্বর বার হত শুধু ভয়েস সিন্থেসাইজারের সাহায্যে।

লড়াকু জীবনের প্রথম ২৫ বছর হকিংয়ের সফরসঙ্গী ছিলেন প্রথম স্ত্রী। কেমব্রিজে ছাত্রাবস্থায় আলাপ হয়েছিল বোনের বন্ধু জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে। প্রেমপর্বের কয়েক মাসের মধ্যেই ধরা পড়ে এএলএস। চিকিৎসকেরা দু’বছর সময় দিলেও সেই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে দেয় স্টিফেন-জেনের লড়াই। ১৯৬৫ সালে বিয়ে। পর পর তিনটি সন্তান। তারপর দু’দশক ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে জীবনসঙ্গীর দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন জেন।

১৯৮৫ সালে একটি মার্কিন স্কলারশিপের ফলে দিনভর সেবিকা রাখার ‘বিলাসিতা’র কথা ভাবতে শুরু করেন হকিং দম্পতি। নিজের জন্য কিছুটা সময় পেয়ে পড়াশোনার জগতে ফিরে যান ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্নাতক জেন। স্প্যানিশ কবিতা নিয়ে কাজ করে ১৯৯০ সালে পান পিএইচডি।

১৯৯৫ সালে আত্মীয়-বন্ধুদের চমকে দিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন স্টিফেন-জেন। তত দিনে হকিংয়ের জীবনে সেবিকা এলেইন মেসনের প্রবেশ ঘটে গিয়েছে। বিয়ের পর স্টিফেন বলেছিলেন, ‘‘আমি আজ ভালবাসার মেয়েটিকে বিয়ে করেছি। এর থেকে খুশির আর কী হতে পারে।’’ ১৯৯৭-এ বহু বছরের পুরনো প্রেমিক, পিয়ানোবাদক জোনাথন হেলিয়ার জোন্সকে বিয়ে করেন জেন-ও। হকিংদের পারিবারিক বন্ধু জোনাথনের সঙ্গে জেনের সম্পর্ক সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন স্টিফেন। জেনের কথায়, ‘‘স্টিফেন শুধু বলত, আমাকে ভালবাসা যেন থামিয়ে দিও না।’’

হকিংয়ের আকাশচুম্বী খ্যাতির প্রথম অনুঘটক যদি হয় ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ তা হলে দ্বিতীয় অনুঘটক অবশ্যই জেনের আত্মজীবনী— ‘ট্র্যাভেলিং টু ইনফিনিটি: মাই লাইফ উইথ স্টিফেন’। বইটি অবলম্বনে ২০১৪ সালে বানানো হয় ‘দ্য থিয়োরি অব এভরিথিং’। নামভূমিকার অভিনেতা এডি রেডমেইন অস্কার জিতে নিয়েছিলেন। আর একুশ শতকের প্রজন্ম, যারা হয়তো সেই ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ পড়েনি, তারা এই ছবি দেখে নতুন করে চিনেছিল হকিংকে।

প্রথমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও হকিংয়ের দ্বিতীয় বিয়ে কিন্তু আনন্দদায়ক বা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এমনকী, মেসনের বিরুদ্ধে হকিংকে শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগও উঠেছিল। সে সময়ে বেশ কয়েক বার নানা আঘাত নিয়ে কেমব্রিজের অ্যাডেনব্রুকস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন হকিং। তদন্ত শুরু করেছিল পুলিশ। কিন্তু হকিং নিজেই উড়িয়ে দেন সব অভিযোগ। বলেন, ‘‘দারুণ জোরে ইলেক্ট্রিক হুইলচেয়ার চালাই তো, হুটহাট লেগে যায়।’’ ২০০৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁদের।

যে হুইলচেয়ারে সেই ১৯৮৬ থেকে বন্দি, সেই হুইলচেয়ার নিয়েও কম রসিকতা করেননি হকিং। বলতেন, ‘‘খ্যাতির বড় বিড়ম্বনা। যখন যেখানে খুশি যেতে পারি না। অনেক সেলিব্রিটি পরচুলা আর কালো চশমা পরে দিব্যি ঘুরে বেড়ান। কিন্তু আমার তো সে গুড়েও বালি। এই হতচ্ছাড়া হুইলচেয়ারটা দেখেই সবাই চিনে ফেলে!’’

জন্ম ১৯৪২-এর ৮ জানুয়ারি। বাবাও বিজ্ঞানী ছিলেন, তবে তাঁর বিষয় ছিল জীববিজ্ঞান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, জার্মানদের বোমার হাত থেকে বাঁচতে, লন্ডন ছেড়ে সেন্ট অ্যালব্যান্সে চলে যায় হকিং পরিবার। কেমন ছিলেন কিশোর স্টিফেন? ২০০২ সালে এক সাক্ষাৎকারে স্টিফেনের মা ইসোবেল বলেছিলেন, ‘‘আর পাঁচটা কমবয়সি ছেলের মতোই। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। ঘোড়ায় চড়তে, নৌকো চালাতে ভালবাসত। পার্টিতে যেতে, মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতেও খুব পছন্দ করত। তবে শুধু মিষ্টি দেখতে মেয়েদের সঙ্গেই!’’

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় প্রথম শ্রেণির স্নাতক। তারপর ব্রহ্মাণ্ডবিজ্ঞান নিয়ে কেমব্রিজ থেকে স্নাতকোত্তর। ১৯৭৪-এ ব্রিটেনের সব থেকে সম্মাননীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ‘রয়্যাল সোসাইটি’র কনিষ্ঠতম ‘ফেলো’ নির্বাচিত হন। তখন তিনি অক্সফোর্ডের অধ্যাপক। পাঁচ বছর পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যুকেসিয়ান প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। আজীবন সেখানেই ছিলেন।

‘‘আমার শিশুদের খুব ভাল লাগে। কারণ ওরা সব সময়ে নানা প্রশ্ন করে। আর কোনও সমীকরণই সহজে মেনে নেয় না,’’ বলতেন স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। ‘মারণ রোগ=থেমে যাওয়া’ এই সমীকরণকে ভুল প্রমাণিত তিনিই করে দিয়ে গেলেন।
সৌজন্য আনন্দবাজার পত্রিকা

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়