Ameen Qudir

Published:
2018-02-15 16:19:18 BdST

পৃথিবীর দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবীর বাঙ্গালী ডাক্তার আত্মহত্যা করেন অপমান, উপহাস আর লাঞ্ছনায়


 

 

ডেস্ক রিপোর্ট
__________________


ঘটনাটি ঘটেছিল কলকাতার কাছেই ১৯৭৮ সালের ১৮ ই নভেম্বর। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে গঠিত একটি ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’কে নিযুক্ত করলেন ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামক এক অভিযুক্তের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য।


তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দাবি করেছেন তিনি দূর্গা নামে এক টেস্টটিউব বেবির স্থপতি।


দ্বিতীয় অভিযোগ তিনি তার গবেষণার কথা দপ্তরের আমলাদেরকে আগে না জানিয়ে কেন মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন?


অভিযোগ,

কীভাবে তিনি তার সার্দান অ্যাভিনিউর ছোট ফ্ল্যাটে সামান্য কিছু উপকরণ আর একটা ছোট ফ্রিজ ব্যবহার করে এমন একটি অসম্ভব কাজকে সম্ভব করলেন যেখানে অন্যরা গবেষণার সকল উন্নত সুযোগ-সুবিধা পেয়েও সে চিন্তা করতে পারছে না?

আর সবচেয়ে বড় অভিযোগ এই যে, তিনি কারো কাছে মাথা নোয়াতেন না। এই বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতি ছিলেন একজন রেডিওফিজিসিস্ট। কমিটির সদস্যদের মধ্যে একজন গাইনোকলোজিস্ট, একজন ফিজিওলজিস্ট আর একজন নিউরোফিজিওলজিস্ট ছিলেন।

মজার বিষয় হলো এদের কারোরই আধুনিক প্রজনন পদ্ধতি (আইভিএফ-ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।


একজন বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি ওই ভ্রূণগুলো কোথায় রেখেছিলেন?’ ডাঃ মুখোপাধ্যায় জবাব দিলেন, ‘সীল করা অ্যাম্পুলের মধ্যে’। উল্লেখ্য অ্যাম্পুল হলো ইনজেকশনের ওষুধ রাখার জন্য ছোট কাচের বোতল।

 

ফের প্রশ্ন করা হলো, ‘অ্যাম্পুলটাকে সীল করেছেন কীভাবে?’ জবাব এলো, ‘সাধারণভাবে যেভাবে করে। তাপ দিয়ে।’ এভাবেই শুরু হলো জেরা-পাল্টা জেরা। কিছু অবান্তর ভিত্তিহীন, গবেষণার সাথে সম্পর্কহীন প্রশ্ন করে তাকে অপমানের চুড়ান্ত করা হলো। বলা হলো, ‘ওহ-তার মানে আপনি বলতে চাইছেন তাপের কারণে ভ্রূণগুলো নষ্ট হয়ে যায়নি?

এই কমিটি কী রায় দিবে তা যখন পূর্বনির্ধারিতই তখন এটা আর বলার প্রয়োজন নেই যে এর সব কিছুই আমলাতান্ত্রিক কূটনৈতিক চালের কারণে হচ্ছে। কমিটি চূড়ান্ত রায় দিলো, “Everything that Dr. Mukhopadhyay claims is bogus.”

 

 

প্রথম মা দূর্গা


ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের অধীনে টেস্টটিউব বেবির জন্মের মাত্র ৬৭ দিন আগে ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটে ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হাসপাতালে পৃথিবীর প্রথম টেস্টটিউব বেবী লুইস ব্রাউন জন্ম নেয়। স্থপতি ছিলেন রবার্ট এডওয়ার্ডস এবং প্যাট্রিক স্টেপটো। এ প্রক্রিয়ায় তারা ল্যাপোরোস্কোপি যন্ত্রের সাহায্যে ডিম্বাণু সংগ্রহ করেন। এর আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে ডিম্বাণুর বিভাজন ও পরিস্ফুটন পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর কর্তন প্রক্রিয়ায় ডিম্বাণু সংগ্রহ করে একটা ডিস্কে শুক্রাণুর সাহায্যে সেটাকে নিষিক্ত করেন। এরপর এ থেকে ভ্রূণ উৎপন্ন হলে সেটাকে আবার জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করেন।

 

কিন্তু ডাঃ মুখোপাধ্যায় এক্ষেত্রে ল্যাপোরোস্কোপি যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই ডিম্বাণু সংগ্রহ করেন। এজন্য তিনি এক প্রকার হরমোনের সাহায্যে ডিম্বাণুর সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটান এবং ওখানেই এর বিকাশ সাধন করেন। এরপর ছোট একটা অপারেশনের সাহায্য নিয়ে ডিম্বাণু সংগ্রহ করেন। আর একারণে গর্ভধারণের সম্ভাবনাও অনেকাংশে বেড়ে যায়।
কিন্তু সহকর্মী এবং সরকারের রোষানলে পড়ে তাকে বরণ করে নিতে হলো করূন পরিণতি।

 

Image result for durga testtube mother

তারপর কেবলি পরশ্রীকাতর হেনস্থা ----------

প্রথমে ডা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে বদলী করে দেয়া হলো কলকাতা থেকে বাঁকুড়ার একটি হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে। যাতে তিনি পরবর্তীতে তার গবেষণা চালিয়ে যেতে না পারেন। এরপর তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। ফের চলে এলেন কলকাতায়। চারতলার সিঁড়ি বেয়ে তাকে রোজ কাজ করতে যেতে হতো। জাপান থেকে তার কাজের উপর একটা সেমিনারে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে যেতে দেয়া হয়নি।

চুড়ান্ত অপমান, উপহাস আর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করার পর ১৯৮২ সালে ১৯ শে জুন এই মহান প্রতিভাবান ফিজিশিয়ান নিজ বাসভবনে আত্মহত্যা করেন।

আরো একবার যেন সত্যকে হত্যা করা হলো। ভারতের সরকার স্বীকৃত প্রথম টেস্টটিউব বেবীর স্থপতি হলেন ডা. টি এস আনন্দ কুমার যিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিচার্সের ডিরেক্টর। ১৯৮৬ সালের ১৬ ই আগস্ট তার অধীনে জন্ম নেয় ভারতের দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবী হর্ষ।
যাকে দাবি করা হয় প্রথম বলে।


১৯৯৭ সালে ডা. আনন্দ একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন। তখন ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার সকল কাগজপত্র তার হাতে তুলে দেয়া হয়। নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করে এবং সেই টেস্টটিউব বেবী যার জন্ম হয়েছিল ডাঃ সুভাষের অধীনে-দূর্গা সেই শিশুটির মা-বাবার সাথে আলাপ-আলোচনা করে তিনি নিশ্চিত হন যে, ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের প্রথম এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবীর স্থপতি। ডাঃ টি সি আনন্দ কুমারের উদ্যোগেই তিনি পরে ভারতবর্ষের স্বীকৃতি পান।

 

 


দূর্গা এখন দিল্লীতে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি তার ২৫ তম জন্ম বার্ষিকীতে প্রথম মিডিয়ার সামনে আসেন এবং নিজের জনক ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাপারে কথা বলেন। সেই সাথে এটাও প্রমাণ করে দেন যে ডা. সুভাষের দাবী নিতান্তই অমূলক বা বোগাস ছিল না।

ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন প্রকাশিত মেডিক্যাল ‘ডিকশনারী অব মেডিক্যাল বায়োগ্রাফি’ প্রকাশিত বইতে পৃথিবীর ১০০ দেশের ১১০০ মেডিক্যাল সায়েন্টিস্টের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে যারা এই চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নয়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। আর এই তালিকায় ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামও রয়েছে।

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়