Ameen Qudir

Published:
2017-06-20 16:35:12 BdST

রংপুর মেডিকেলের মহান শিক্ষকদের প্রতি এক ডাক্তারের শ্রদ্ধার্ঘ্য


 

 

 

ডা. মিথিলা ফেরদৌস

________________________

আজ আমার মেডিকেলে আমার প্রিয় কয়েকজন স্যারের কথা বলবো।আমি ইন্টার্ন করেছি মুলত সার্জারি আর মেডিসিনের দুই দিকপাল স্যারের কাছে।
প্রফেসর আব্দুর সোবহান প্রামানিক।আমি ইন্টার্নিতে সার্জারি তে প্রথম জয়েন করি।স্বভাবতই অফুরন্ত উৎসাহ তখন।চারিদিকে ছুটে ছুটে কাজ করে বেড়াই।খুব কম সময়ের মধ্যেই স্যারের চোখে পড়ে যাই।স্যার ওটিতে নিজেই ডেকে নিতেন আমাকে।

যেখানে সবাই ঘন্টার পর ঘন্টা ওয়াশ নিয়ে দাঁড়ায় থাকতো।স্যারের কাজ ছিলো অসাধারণ। খুব ধীরে ধীরে ব্লাডলেস ফিল্ডে কাজ করতেন।স্যার হয়তো আমার নাম জানতেন কিনা জানিনা।কিন্তু খুজতেন,'মেয়েটা কই'।তখন সার্জারিতে আমি একাই মেয়ে।স্যারের স্নেহের একটা বড় কারণ, আমার সি এ,আই এম ও রা আমাকে স্যারের কাছে হাইলাইট করতেন।স্যারের স্কিন গ্রাফট দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো শুধু ব্লেড দিয়ে এত সুন্দর করে স্কিন আনতে আমি কাউকেই দেখিনি।

এখন তো এইসব কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা।স্যার মাঝে মঝে বড় বড় ড্রেসিং গুলো নিজেই করতেন।শুধু ট্রেনি দের শিখানোর জন্যে।উনার ট্রেনিদের উপর উনার এত মায়া ছিলো যে, উনি প্রায় প্রফের সময় সেকেন্ড পার্ট এক্সামিনারদের নিয়ে আসতেন ফেস প্রেজেন্টেসানের জন্যে।উনার কোন ট্রেনিকে দুই বারের বেশি এফসিপিএস এর জন্যে পরিক্ষা দিতে হয়নি।আমার ইন্টার্ন এর শেষের দিনে মতিন স্যার উনার কাছে,নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন,স্যার ও সার্জারি তে ক্যারিয়ার করবে।মাঝে মাঝে এসে আমাদের ছোট খাট ওটিগুলো করে দিয়ে যাবে।

আমার এখনও কানে ভাসে স্যার বলেছিলেন,'মতিন আমার এখানে এম এস খুললে,প্রথমেই আমি এই মেয়েকে নিবো।'স্যার আমি আজও আপনার কথা ভুলিনি। আপনি যেখানেই আছেন আল্লাহপাক আপনাকে সুখে রেখেছেন নিশ্চয়ই।আমাদের মত হাজার ছাত্রছাত্রীদের আর রুগীদের দোয়ায়।খুব নিয়ম মানা সৎ একজন মহামানবের স্নেহ পেয়েছিলাম।

 

প্রফেসর কাজী জাহাঙ্গীর স্যার।মেডিসিনের ট্রেনিং তার কাছেই। রুগী একপলক দেখেই ডায়াগ্নোসিস করে ফেলতেন।ইনভেস্টিগেশন এর বাড়াবাড়ি ছিলোনা।দুই তিনটা বেশি ঔষধ কখনও তার প্রেস্ক্রিপসানে থাকতোনা।আমি আমার রুগী গুলো যখন প্রেজেন্ট করতাম।স্যার খুব খুশি হতেন।আমার কাছে জানতে চাইতেন ডায়াগনোসিস কি হতে পারে?আমি আমার মাথায় যা আসতো বলে দিতাম।স্যার খুব খুশি হতেন।বলতেন সাবাস বেটি।স্যারের সেই উৎসাহ কখনও ভোলার না।আমি মাঝে মাঝে ছুটিতে থাকলে আমার নাম ধরে খুজতেন।


মেডিসিনের নাগ স্যার আরেকজন মহান মানুষ। আমার এফ সি পি এস পার্ট ওয়ান,এম এস এ চান্স,বিসিএস হবার পর স্যারের কাছে গিয়েছিলাম।স্যার অনেক সুন্দর করে উনার প্যাডে আমার অনেক প্রশংসা লিখে দিয়েছিলেন।


একবার আমার মা অসুস্থ ছিলেন।তাকে মুভ করানোর মত অবস্থা ছিলোনা।আমি স্যারকে গিয়ে শুধু হিস্ট্রি বলেছিলাম।দুইটা মাত্র ঔষধ দিয়েছিলেন।মা আমার একদিনেই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।স্যারের চেম্বারে তার মায়ের ছবি বড় করে বাধাই করা ছিলো।যা দেখেই বোঝা যায় স্যার কত মহান ছিলেন।

ওমর আলী স্যার, একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। সবচেয়ে কম সময়ে অপারেসানের রেকর্ড তার।ঢাকা মেডিকেলে ট্রেনিং করার সময় তার স্নেহ পেয়েছি।তখন একবার খুব অসুস্থ হয়ে মেডিকেল ভর্তি ছিলাম।স্যার রক্ত মাখা ওটি গাউন পরেই আমাকে দেখতে এসেছিলেন।কোর্সে আসার পর,আমি ভাবিনি স্যার আমাকে চিনবেন।উনি নিজেই ক্লাশের ফাক থেকে বের করে,প্রশ্ন করে বুঝায় দিয়েছিলেন উনি আমাকে চিনেছেন।
আজিজুল স্যার,বিখ্যাত গাইনিকোলজিস্ট।আমি গাইনিতে ট্রেনিং করিনি,ফিফথ ইয়ারে উনার অসাধারন ক্লাশ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম।আমাকে উনার চেনার কথা না।একবার ঢাকা থেকে ফেরার পথে ফুডভিলেজে স্যার নিজেই আমাকে ডেকে বললেন,'তোমার নাম মিথিলা না?'আমি রীতিমতো অবাক আর কৃতজ্ঞ।আমাকে নাম ধরে চেনার কথা ভাবতেই পারি না।


প্রফেসর নুরুল আবছার স্যার অসম্ভব রাগী কিন্তু নীতিবান মানুষ। ইন্টার্ন এ আমি স্যারের কাছে রুগী প্রেজেন্ট করতাম।স্যার খুব খুশি হতেন।কখনও বকা দেন নাই।বাবু হবার পরও আমাকে চিনেছিলেন।একবার ঢাকা থেকে স্যারের কাছে বাবুর ফোনে চিকিৎসা নিয়েছিলাম,স্যারের মত মানুষ এর কাছে যা কল্পনাতীত ব্যাপার।কিন্তু আমি নিরুপায়।বাবুর ব্যাপারে স্যার ছাড়া আমি কাউকেই ভরসা করতাম না ।স্যার সেইটা বুঝতেন।


প্রফেসর আমানুল্লাহ স্যার,সেকেন্ড প্রফের ভাইভার সময়,জামান স্যারকে বলেছিলেন,'জানো জামান এই মেয়ে সলিমুল্লাহ এয় চান্স পেয়েও রংপুরে পড়ছে'।মুলত স্যার আমার মেডিকেলে চান্স পাবার খবর দিয়েছিলেন,আর আমার স্কোর জানতেন।উনি নাকি অনেক কেই আমার উদাহরণ দিতেন।আমার বাসার পাশেই উনার চেম্বার ছিলো।উনি আমার বাবাকেও বলেছিলেন আপনার মেয়েটা অনেক লক্ষী মেয়ে।আমাকে ডাকতেন বেটি বলে।আমার পরম পাওয়া।স্যার আমি জানি আপনি জান্নাতে আছেন।কত কস্ট করেও আপনাকে আমি এক অয়াক্ত নামাজ মসজীদ ছাড়া পড়তে দেখিনি।
সামাদ স্যার ফরেন্সিক মেডিসিন।ফরেন্সিকের জন্যে একসময় মেডিকেলে পড়া ছেড়ে দিবো ভেবেছিলাম।সামাদ স্যার আমার সব আইটেম ফিল আপ করে দিয়েছিলেন।শুধু তাই না,প্রফের সময় এক্সটারনাল বাথরুমে গেলে আমাকে দ্রুত বের হয়ে যেতে বলেছিলেন।মানে পাশ করানোর জন্যেই করেছিলেন।


এনাটমির ডিপার্টমেন্টাল হেড ম্যাডামের নাম মনে নাই,সুন্দরী ছিলেন।আমার রিটেন পরিক্ষায় নেফ্রনের ছবি দেখে বলেছিলেন,'কি রে তুই তো পেশাদার আর্টিস্ট। 'উনি এনাটমি ভাইভায় আমাকে অনেক মার্কস দিয়েছিলেন।


বুলবুলি ম্যাডাম অসম্ভব ভালো ক্লাশ নিতেন।আমার কাছে মনে হত উনি আমাকে পছন্দ করেননা।তবে আমি উনাকে ভিষন পছন্দ করতাম।
জুনিয়র স্যারদের মধ্যে একজনের নাম না বললেই না,যার কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ,উনি হলেন রুহুল কুদ্দুস রিংকু স্যার।
উপরে আমার মেডিকেলের,আমার শ্রদ্ধেয় স্যারদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে আমার এই লেখা।যাদের কথা বললাম সবাই আমার কাছে মহান।আল্লাহ্‌ যাদের বাচায় রেখেছেন,তাদের সুস্থ,সুন্দর, দীর্ঘ জীবন দান করুন।আর যারা আমাদের মধ্যে নাই তাদের বেহেস্তে নসীব করুন।আর নিজেদের জন্যে এই টুকু,চাইবো যাদের ছত্র ছায়ায় বেড়ে উঠেছি,যেনো তাদের মত হতে পারি।মানুষের সেবায় নিজেদের উজাড় করে দিতে পারি।

___________________________

ডা. মিথিলা ফেরদৌস । সুলেখক ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়