Ameen Qudir

Published:
2017-06-14 18:47:54 BdST

রমজান মাসের ভাবনা: দিদিমা ভোরে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন


 

ডা. রেজাউল করীম
____________________________


আমার কিশোর বয়সে রমজান মাস খুব আনন্দের ছিল। ভোরবেলা সবাই উঠে খাচ্ছে, আমিও উঠে পড়তাম। আমার দিদিমার বাড়ীতে আমরা মানুষ। তিনি বরাবর ভোরে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। তারপর সুর করে কোরান শরীফ পড়তেন। স্পষ্ট উচ্চারণে একটু সুর করে পড়ে যেতেন। আধো ঘুম আধো জাগরণে সেই সুর কেমন একটা নিরাপত্তাবোধ জন্ম দিত। রমজান মাসে সেহরি খেয়ে সবাই ঘুমোত, তিনি কোন একটা বই নিয়ে বসতেন। পার্সি কোন বই- বেশীরভাগ সময় মসনবী, গুলিস্তাঁ বা বোস্তাঁ। তার সেই দীর্ঘ্য পাঠ চলতে চলতে সকাল গড়িয়ে যেত। আমাদের ঘুম ভেঙে গেলেই মা চা আর জলখাবার নিয়ে আসত। বড় দুজন বাদে সবাইকে খাইয়ে দিত। আমার অবাক লাগে মাকে আমি কখনো রোজা রাখতে দেখি নি। বাবা আর দিদিমা সব ধরনের রিচ্যুয়াল পালন করতেন, মা ছিল ব্যতিক্রম।


পাশের পাড়ায় একটা সালাফি মসজিদ ছিল। সালাফিদের আমাদের বাড়ীতে এমনি অবাধ যাতায়াত ছিল কিন্তু ওদের দর্শনের কঠোর সমালোচনা করতেন সবাই, সবচেয়ে বেশী আমার দিদিমা। ওদের বাড়ীতে বিয়েসাদি দেওয়াতেও আপত্তি ছিল। আমাদের ধর্মে হাতে খড়ি দেওয়া হয় নি। দিদিমা আমাকে বলতেন- তুই ছোট ছেলে, পড়াশোনা সবচেয়ে বড় ফরজ কাজ। ভাল করে পড়াশোনা করলে তবেই আল্লাহর মত বৃহৎ বিশাল মহান শক্তিকে বুঝতে পারবি। আমার দিদিমা মারা গেলেন রমজান মাসের প্রথম দিন। সারারাত বেশ কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু ভোরে আমাকে বললেন- আমাকে একটু জল দে, আমি রোজা রাখবো। সেদিন একটার সময় মারা গেলেন। একফোঁটা জলও খাওয়ান যায় নি। মৃত্যুর দশমিনিট আগে বললেন- তোরা একটু চুপ কর, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। এই বলে চোখ বুঝলেন। দশমিনিট পর দেখলাম মৃত। সারা জীবনে কখনো মিথ্যা বলেন নি, কোন অন্যায়ের সাথে সমঝোতা করেন নি।


আমাদের গ্রামে খুব চোরের উৎপাত ছিল। জরুরী অবস্থা চলছে। চারিদিকে ধরপাকড়। সেবার একটা চোর পুলিশের তাড়া খেয়ে বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। পুলিশের লোকগুলি দিদিমাকে দেখে ইতস্তত করে বলল- বাড়ীতে চোর ঢুকেছে। আমরা সার্চ করবো। দিদিমা বললেন- কেউ আসে নি বাবা। পুলিশের লোকটি বাড়ীর নীচের তলা, উপর তলা মায় হাঁড়ির ঢাকনা খুলে চোর ধরতে না পেয়ে একরাশ বিস্ময় নিয়ে ফিরল। তার একটু পর চোর বাড়ী থেকে বের হয়ে এল। দিদিমা বললেন- যা: আজকের মত বাঁচালাম। আর চুরি করিস না। সে মাথা নত করে চলে গেল। আমরা ছোটরা বললাম- তুমি মিথ্যা কথা কেন বললে? দিদিমা বললেন- শরণাগতকে রক্ষা করাই ধর্ম। তাছাড়া আমি পায়ের আওয়াজ পেয়েছিলাম কিন্তু ওকে দেখি নি, আমি সেজদায় ছিলাম।


তা যাহোক, ইফতারে বেরোজাদারদের কখনো ডাকা হত না। ইফতার শেষ হলে, আমরা যারা রোজা করতাম না তারা খেতাম। আমার সারা জীবনে আমার দিদিমার মত মানুষ কখনো দেখি নি। কী সাহিত্য সংস্কৃতি, কি ধর্ম-পুস্তক- কোরান গীতা বাইবেল, কী গল্পের বই সবকিছুতেই তাঁর অসীম আগ্রহ ছিল। আমি সেভেনে পড়ি। হঠাৎ আমাকে বললেন- ইংরেজী অক্ষর গুলো চিনিয়ে দে তো এবং কী আশ্চর্য বছর ঘুরতে না ঘুরতে আমার রাপিড রিডারটি পড়ে আমাকে অর্থ জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলেন। আমি ক্লাস টেন পর্যন্ত পরিমিতি আর গনিতের অঙ্ক ওঁর কাছে শিখেছি। ওঁর ছোটবেলা কেটেছে দুজন গুরুর কাছে- ব্রাহ্মণ পন্ডিত (নামটি স্মরণ করতে পারছি না) আর একজন মুন্সির কাছে যথাক্রমে গনিত আর ফার্সী পড়েছেন। তাই জ্ঞানের পরিধিটি ছিল ব্যাপক। আমাকে বলতেন মানুষের মত মানুষ হতে হবে। একটা ফার্সি বয়েত খুব বলতেন যার ভাবার্থ: যে বই পডছো না, তা বগলে নিয়ে ঘোরা আর ইঁট নিয়ে ঘোরার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।


আমার বন্ধুরা দলবেঁধে সরস্বতী পূজো করতো। সবার কাছ থেকে বই নিয়ে ঠাকুরের পায়ের কাছে রাখা হত। আমার দিদিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম- একটা বই দেব কিনা। দিদিমা হেসে বললেন- যা, দিয়ে আয়। হিন্দু-মুসলমান নিয়ে কোন কথা কখনো শুনি নি। তিনি বলতেন- মনুষ্যত্ব হল সবকিছু, সবচেয়ে বড় ধর্ম। আমার মা জীবনের শেষ কটা দিন আমার কলকাতার বাড়ীতে ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত নানারকম গল্প হত। চারিদিকে ওয়াহাবীরা মানুষ খুন করছে দেখে মা বলত- যারা নবীর নাতীর বুকে চেপে তাঁকে জবাই করতে পারে, তারা সব পারে। মিথ্যা হাদিস বানাতে পারে, মানুষকে খুন করতে পারে, ধর্মের নামে সব সব খারাপ কাজ করতে পারে!!


আমার মার খুব শখ ছিল তার একটা ছেলে বিলেতে লেখাপড়া করবে। কেউ সেটা করে নি। তাই আমার মেয়ে যখন সুযোগ পেল ওদেশ যাওয়ার মাকে অবাক করে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু, মা চলেও গেল আর মেয়েও অত বড় স্কলারশিপটা নিল না। তা যাহোক, মেয়েরা শিক্ষিত হবে, নিজেদের হাঁড়ি ঠেলতে হবে না, জজ ব্যারিস্টার হবে (ডাক্তার নয়) সেটা আমাকে প্রায় বলত। আমরা ছোট থেকেই অন্য পরিবেশে মানুষ হয়েছিলাম। তাই রাজনৈতিক নেতা-নেতৃদের যখন দেখি হিজাবে মাথা ঢেকে ইফতার করছে তখন আমার দেখা এই দুজন মহিলার কথা মনে হয়। সাধারন বাঙালী বাড়ীতে অপরিচিত লোক দেখলে যেমন ঘোমটা দেয়, ওরা সেভাবেই ঘোমটা দিয়েছেন। কানদুটো খোলা রেখে হিজাব দেখলে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ওঠে। ঐ পোষাক তো যোধা আকবর সিনেমায় আকবরের দুধ-মাকে পরতে দেখেছি। আমরা এমন একটা দেশে বাস করি সে দেশের কর্ণধাররা ইতিহাস পড়ে নি। তিতুমিরের মত ওয়াহাবি তাদের আইডল। ওয়াহাবীরা ওদের এজেন্ডা ঠিক করে দেয়, আর সেই এজেন্ডা দিয়ে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বপ্ন দেখে। ওয়াহাবি দর্শনে কী অন্য সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়? তাহলে সারা আরব দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ খৃষ্টান কোথায় গেল? ইহুদিরা আরবীয় খাইবার উপত্যকার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জাতি। তারা কেন সিরিয়ায় পালিয়ে গেলেন? কেন, তুরস্কে চার্চগুলিকে আস্তাবলে রূপান্তরিত করা হয়েছে?


আমাকে অনেকে বলে আপনি হিন্দুদের খুশি করার জন্য নানারকম কথা বলেন। আমি বলি- আমি কোন ধর্মের বাহ্যিকতা নিয়ে মাথা ঘামাই না। যাদের কথা লিখলাম তাদের কাছে এটুকুই শিখেছি- অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে ঈশ্বরকে অনুভব করা যায় না। ভেক না ধরেও সন্ন্যাসী হওয়া যায়। দর্শন হিসেবে উপনিষদ অনন্য, অতুলনীয়। অন্যরা যে ইসলাম মানে সেটা আইনের কচকচি। আমার গুরু আমাকে শিখিয়েছেন তাসাউফ- আত্মসমীক্ষা আর আত্মশুদ্ধি দিয়ে ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। যে দরিদ্রের সেবা করে, যে এতিমকে কোলে তুলে নেয়, দু:খীর চোখের জল মুছিয়ে দেয়, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেয়, জ্ঞানপিপাসুকে সাহায্য করে, অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা দেখিয়ে দেয় সেই সত্যিকার ঈশ্বর ভক্ত। আবু বেন আদহামের কাছে রাজ ঐশ্বর্য ছিল হারাম। খাজা মইনুদ্দিন কোনদিন রাজ দরবারে যান নি। তুঘলক যখন নিজামুদ্দিনকে ডেকে পাঠান তিনি বলেন- আমি তোমার চেয়ে বড় রাজার আশিক, তোমার কাছে যাব না।


উনবিংশ শতকে ওয়াহাবী আন্দোলনের ধাক্কায় বাঙালী মায়ের কোল খালি হয়েছিল। বেহেস্তের হুরপরীর স্বপ্নফেনীল হাতছানি হাজার হাজার যুবকের প্রান কেড়ে নিয়েছিল। ইংরেজ তাদের দমন করেছিল। সেদিন ওয়াহাবীরা রাষ্ট্রীয় সহায়তা পায় নি। কিন্তু আজ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ওয়াহাবি সংস্কৃতি বাংলার আনাচে কানাচে ছডিয়ে পডছে।

গান্ধীর মত ব্যক্তিত্বও একদিন খেলাফত আন্দোলনের নাম করে মৌলবাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। এখনকার অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেকোন অন্যায়ের সাথে নির্দ্ধিধায় আপস করবেন সেজন্য আমি অবাক নই। অবাক শুধু শিক্ষিত বুদ্ধিজীবিদের নির্বাক রূপ দেখে। তারা শিশু পাঠ্য কাহীনিতে মুখ ঢেকে শেষের সেদিনের জন্য অপেক্ষা করছেন কিন্তু রাজানুগ্রহ থেকে যেন বঞ্চিত না হন তার জন্য মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছ্ন। বৃহন্নলার ছদ্মবেশে আসন্ন বিপর্যয় দেখেও না দেখার ভান করছেন।

___________________________

ডা. রেজাউল করীম । বাংলার প্রখ্যাত কথাশিল্পৗ ও কবি।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়