Ameen Qudir

Published:
2017-04-25 15:32:20 BdST

রানা প্লাজা ট্র‍্যাজেডির পর ডাক্তারদের সেবার মহাকাব্য





মারুফ রায়হান খান

____________________________


আমি আজ এ মঞ্চে উঠেছি আপনাদের এক মহাকাব্যের ভাষ্য শোনাতে, ইতিহাসের সাক্ষ্য দিতে, জগৎ-বিখ্যাত বিপ্লবের ইশতিহার জানাতে।
সেই বিপ্লব, সেই ইতিহাস, সেই মহাকাব্য রচিত হয়ছে রানা প্লাজা ট্র‍্যাজেডিকে ঘিরে।

২৪শে এপ্রিল, ২০১৩--
এক অনন্য যুদ্ধ শুরু হয় এনাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে।
প্রতিটি ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী তখন অদম্য যোদ্ধা, উদ্দীপ্ত বিপ্লবী।
যুদ্ধের নিয়ম মানুষকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা--
আর এ যুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে, মানবতাকে বাঁচাতে।
এ যুদ্ধ রক্তক্ষয়ের যুদ্ধ নয়--বরং নিজের শরীর থেকে তাজা রক্ত বের করে দিয়ে আহতকে পুনর্জীবিত করার যুদ্ধ।

 

যুদ্ধ করতে প্রয়োজন একজন অগ্রণী কাণ্ডারির, নিঃস্বার্থ অভিভাবকের।
তখন তিনি শুধু এনাম মেডিকেলের অভিভাবক নন, শুধু সাভারের অভিভাবক নন, তখন তিনি সমগ্র বাংলাদেশের অভিভাবক।
সেদিনের ডাঃ এনামুর রহমান, আপনি জেগে থাকুন বিশ্ব বিপ্লবীর অন্তরাত্মায়।
যুদ্ধের ঘোষণা আসতে হয় সর্বশ্রদ্ধেয়, সর্বমান্যের কাছ থেকে।
কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর ডা. আব্দুল মান্নান শিকদার ঘোষণা দিয়ে দিলেন--
সমস্ত ক্লাস, পরীক্ষা স্থগিত।
দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে সবাইকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

এনাম মেডিকেলের প্রতিটি বিভাগ তখন একেকটা যুদ্ধ সেক্টর।
আমাদের প্রতিজন শিক্ষক তখন সেক্টর কমান্ডার।
প্রতিটি তরুণ-তুর্কী চিকিৎসক একেকজন সুযোগ্য সহযোদ্ধা,
প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী তখন প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর অদম্য সহযোদ্ধা।

একের পর এক স্রোতের মত এম্বুলেন্সে করে আসা বীভৎস ভিক্টিম দেখতে দেখতে কোমলমতি শিক্ষার্থীর অন্তর ভেঙে যেতে চায়, চোখে জল টলমল করে ওঠে।
কিন্তু বিপ্লবের সময় ইমোশন কে মোশনে পরিবর্তন করতে হয়,
আবেগকে পরিণত করতে হয় বেগে।
ট্রলি ঠেলা থেকে শুরু করে রক্তদান, ফান্ড রাইজিং থেকে শুরু করে খাদ্য বণ্টন-
সবক্ষেত্রেই ছাত্রদের মুখর পদচারণা।

একেকজন যোদ্ধার চোখে ঘুম নেই--
চোখের দৃষ্টিতে শুধুই মানবতা।
রাত জেগে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে চোখের পাতা যখনই এক হয়, তখনই কানে বেজে আসে এম্বুলেন্সের শব্দ।
আর কি ঘুমানো সম্ভব?

আমার যে শিক্ষকের বেডরুমে লক্ষাধিক টাকার খাট-
তাকে আমরা দেখেছি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ওটি রুমের ফ্লোরে শুয়েই একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে।
এটি কোনো কাল্পনিক আরব্য রজনীর গল্প নয়, স্বচ্ছ স্ফটিকের মত বাস্তব।
জনতা, আজ আমায় জবাব দাও--আর কোনোদিন ডাক্তারকে তোমরা কসাই বলবে?

যোদ্ধারা ঠিকমতো খায়নি, শরীরের প্রতি যত্ন নিতে পারেনি।
কতো যোদ্ধারা তো নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
বিংশ শতাব্দীতে কবে কোথায় এহেন আত্মত্যাগ পৃথিবী দেখেছে?

মিডিয়া, ব্লগ আর ফেইসবুকের কল্যাণে মানবতার দাবানল তখন ফুঁসে উঠেছে দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
"ভাব যেখানে প্রবল, ভাষা সেখানে দুর্বল"--কতোজনের কতো অবদানের কথা বলব?
গাজীপুরের এক মাদ্রাসা থেকে ৭০ জন ছাত্র সারিবদ্ধভাবে চলে এসেছে রক্ত দেবে বলে।
জনতা, বলো ওদেরকে আর কখনও অবহেলা করবে?
আর ওদিকে ডাক্তার যোদ্ধাদের মায়ামাখা সেবা যত্নে একেকজন সুস্থ হয়ে উঠে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।

আজ অনেকগুলো দিন পেরিয়েছে--
কেমন আছেন তারা--স্বজন হারালেন যারা?
পঙ্গু হয়ে পড়ে রইলেন যারা?
সর্বসান্ত হয়ে গেলেন যারা?

সন্তান হারানো মা কি এখনও ফজরের আজান হলেই ছেলের ঘরে চলে যান, ছেলেকে কাজের জন্য ডেকে দিতে?
না কি সে মা বুঝে গেছেন, তার সোনা-মাণিক আর 'মা গো' বলে ডেকে তার অন্তর জুড়িয়ে দেবে না?
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে শিশুটি হাত বাড়িয়ে তার মা-কে কি এখনও খুঁজে ফেরে?
না কি সে বুঝে গেছে, তার মা আর কখনও তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেবে না?
প্রতিদিন কাজে বেরুবার আগে যে স্বামী তার বধূর কপালে গাঢ় করে চুমু এঁকে দিতেন--
সে বধূর অন্তর আজ নিশ্চয়ই ধূ ধূ মরুভূমি, একবুক তৃষ্ণা নিয়ে সে প্রতিরাতে ঘুমোতে যায়।

হে আমার জাতি, তুমি আজ বুকে হাত দিয়ে বলো তো-
কদিন তুমি কজনকে জিজ্ঞেস করেছো--
মা, আপনার শরীরটা ভালো তো?
সোনামণি, তুমি আর স্কুলে যাও না কেন?
বোন, তোমার সংসার চলে কীভাবে?

জনতা, আর কিছু না পারো, আল্লাহর কাছে মিনতি করো,
তিনি যেন প্রতিজন মৃতকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন।
তাদের রেখে যাওয়া সংসার যেন আবার জেগে ওঠার আলোতে ঝলমল করে।

সহযোদ্ধা,
একবার যখন বুকের ভেতর বিপ্লবের চাষাবাদ শুরু করেছ--
একবার যখন মানবতার ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেছ--
আর কখনও তুমি থেমে যেয়ো না, বিপ্লবী।

(রানা প্লাজা ট্র‍্যাজেডির  চার বছর। লেখাটি এনাম মেডিকেল কলেজের সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রোগ্রামে এবং প্ল্যাটফর্মের ১ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করা হয়।) _________________________________

 


মারুফ রায়হান খান , ইন্টার্ন চিকিৎসক , এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়