Ameen Qudir

Published:
2017-03-26 22:05:36 BdST

এ কাহিনী আমার মত হাজারো ডাক্তারের




 

ডা. মিথিলা ফেরদৌস
_____________________________


ছোটবেলা থেকে আমি দুর্দান্ত রকমের খারাপ ছাত্রী ছিলাম।বাসার কাছের স্কুলে সাড়ে তিন বছরে দেয়া হলো,যাওয়া আসা প্রাক্টিসের জন্যে,সেখানে দুই সাবজেক্টে পরিক্ষা হতো,আমি বাংলায় ফেল করতাম,অংকে ১০০।'all or none law'.এরপর একটা কিন্টারগার্ডেন স্কুলে,তারপর ভাগ্যের জোরে চান্স পেলাম,সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে।সেখানেও অবস্থার উন্নতি নাই,একটা বিষয়ে ফেল করতেই হবে।


ক্লাশ ফোরে ফেল করলাম গানে,তাও থিওরিতে।অংকে ১০০ কিন্তু থাকতোই।
এদিকে চেহারাও ভালো না যে, কোনমতে একটা পাশ দিলে মহাসুন্দরী দেখে,'ডিসি,এডিসি ভাবি 'হতে পারবো,বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে পুরস্কার বিতরন করতে পারবো।

 

বাবা মা যখন পুরাই হতাশ তখন,ক্লাশ ফাইভে বৃত্তি পেয়ে গেলাম,দুর্ভাগ্যের সুচনা।এরপর আর সরকারী স্কুলের নামে মাত্র বেতন ও লাগতোনা।ক্লাশ এইটে বৃত্তি,এসএসসি এর নাম্বারের জন্যে,কলেজে বৃত্তি,ইন্টারের নাম্বারের জন্যে,মেডিকেলে বৃত্তি।


বাবার ইচ্ছায় মেডিকেলে পড়া,তাও রংপুর মেডিকেলেই পড়তে হবে,মেডিকেলে ফর্ম ফিলাপের সময়,ঘাড়ের কাছে,বাবা মা কড়া নির্দেশ ফাস্ট চয়েস ঢাকা,তারপর রংপুর।

মেডিকেলে চান্স পাবার পর ভর্তির দিন দেখলাম,আমি সিরিয়ালে দ্বিতীয়। অফিসের লোকেরা বলল,আপা তিন নম্বরজন ময়মনসিংহ এ মাইগ্রেট করেছে,আপনার সলিমুল্লাহের নাম্বার আছে,মাইগ্রশান করে ফেলেন।আমি ফর্মফিলাপ করে আসি,বাসায় আবার তীব্র প্রতিবাদ,বাবা তার একমাত্র কন্যা ছাড়া কোনভাবেই থাকতে পারবেনা।আবার কলেজে যেয়ে,ফর্ম তুলে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে আসি।

 

তাতে আমার কি লাভ হইছে জানিনা।হোস্টেলের বিরাট খরচ,যাতায়াত খরচ থেকে বাবা মা রক্ষা পাইছে।
মেডিকেলে দুইধরনের বৃত্তি ছিলো,একটা বোর্ড,আরেকটা মেডিকেলের নিজস্ব।আমরা যারা বোর্ড স্কলার ছিলাম,তারা বেশি টাকা পেতাম আর মেডিকেলের যে লামসাম বেতন তা দিতে হতোনা।আমি সাধারনত,স্টাইপেন্ডের টাকা দিয়ে বই কিনে পড়তাম।মোটকথা আমি খুব স্বল্প খরচে মানুষ হওয়া একজন।


আমার এই গল্প শুধু আমার না,আমার মত সব মেডিকেল স্টুডেন্টের,আমি মেডিকেলে ভর্তি হবার পর দেখলাম,সবাই কোন না কোন স্কুলের ফার্স্ট ছিলো,সে হাতিবান্ধা হোক,আর পঞ্চগড় হোক।আমার এক ডাক্তার বান্ধবী বলেছিলো,জানো মেডিকেলে এসে আমি এপ্রন শব্দটা প্রথম শুনছি,সে তার স্কুলের ফার্স্ট ছিলো,তার এলাকায় বৃষ্টির পানি জমিয়ে রেখে খেতো সারাবছর ,এখন সে অনেক বড় ডাক্তার।


ডাক্তার হবার পর প্রথম বাবার কাছে টাকা চাইলাম,এম এস ভর্তির ৩১ হাজার টাকা।কোথায় ডাক্তার হলে বাবা মা হাফ ছেড়ে বাঁচবে তা না,শুরু হলো টাকার খেলা,আয় নাই কোন শুধু ব্যয়।বিনা পয়সায় অনারারী করতে যাবো সেখানেও নাকি টাকা।যত কমই হোক,তাই বা দিতে হয় কেনো।


সরকারী চাকরী, বাবার আরেক মনের ইচ্ছা,গেজেটেড অফিসার হতে হবে।প্রথম পোস্টিংএ গিয়ে দেখি,আমাকে যে রুম দেয়া হলো,তার চেয়ারের হাতল নাই,টেবিল নড়বড়া,পরিস্কার করে দেয়া হয়েছিলো।এই নি গেজেটেড অফিসার?বেতন ছিলো সর্বসাকুল্যে মনে হয় সাত হাজার টাকা।
একটা সময় ছিলো স্বপ্ন দেখতাম,সিনেমায় যেমন দেখা যায় সুসজ্জিত অফিস,সবাই,দাঁড়ায় গুডমর্নিং ম্যাম বলছে,আমিও সুন্দর সেজে গটগট করে অফিসে যাচ্ছি।হা হা।আর বাস্তবতা, যেখানে চাকরী করি সেখানে সালাম আদাবের বালাই নাই,সারাদিন অসহায় মানুষের ট্যা ফ্যা,এই খানে জালায়,ওইখানে পোড়ায়।সারাদিন সমস্যা শুনতে শুনতে নিজের বাপ মা সমস্যার কথা বললেই ধমক লাগাই।

 

আরেক হতাশা বিসিপিএস,যার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই,এক কষ্ট সব কষ্টকে ভুলিয়ে রাখছে,৩৭০ কিমি দূরে পড়ে থাকা নিজের অসুস্থ বাপ মায়ের অসুস্থতায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হইনা,বাচ্চার পড়াশুনা রসাতলে,তাতেও আমার কিছু যায় আসেনা,জামাই তার অফিসের কোন গল্প বললে,সেইদিকে আমার কোন মন থাকে না,কোন প্রোগ্রাম,পুনর্মিলনি কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা।একটাই কারণ বিসিপিএস।মনে হয়,ডিগ্রী টাই জীবনের সব চাওয়া।


আমার মত হাজারো ডাক্তারের কাহিনী এইটা।কিছু অদল বদল থাকতেই পারে।

_______________________________

লেখক ডা. মিথিলা ফেরদৌস । সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়