Ameen Qudir

Published:
2016-11-26 05:27:32 BdST

"কুত্তা শুয়োর খাই না , নে তোর টাকা "


 

 

                     

                                                                                                            প্রতিকী ছবি।

 

 

 

 

ডা. নুরুল হাসান বাবু

___________________________________________

কোথাও ভ্রমনে গেলেন আর সেখানকার বিখ্যাত বা জনপ্রিয় খাবারটা খেলেন না তাহলে কি আর ভ্রমনের ষোল আনা পূরণ হয়! বগুড়ায় গেলে দ্ই , কুমিল্লায় চমচম আর রংপুরে এসে শোলকা শীদল খেয়ে না গেলে গ্রেট মিস । মুন্সিগন্জে গিয়ে বউয়া খাবার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের । জাপানের কচিঁ বাঁশ পাতার স্যুপ, ওসাবির ঝাল , সিংগাপুরের চিকেন পাস , শ্রীলংকার পোলোস , পারিপ্পু বা চাটনি সামবোল সহ ফিসকারী, মালদ্বীপের টুনা ,থাইল্যান্ড টম ইয়াম গুম, পেনাং এর পেনাম লাসকা খাওয়া নিয়ে অনেক টক-ঝাল- মিষ্টি গল্প জমা স্মৃতিতে , সময় পেলে লিখব ।

বাহিরের স্থানীয় খাবার খাওয়ার আগে মাথায় দুটো জিনিষের চিন্তা থাকে সবার- এক . খাবারটা হালাল বা নিজ ধর্ম মতে অনুমোদিত
কিনা ,অন্যটি স্বাদ কেমন বা খেতে পারব কিনা ।

বিদেশী খাবারের স্বাদ নিয়ে দুটি ঘটনা মনে পড়ে ছোট করে বলি -১. দিল্লী সফরে সফরসঙ্গী বন্ধু Kazi Abdur Razzake লিংকন - দুপুরে এক হোটেলে খেতে ঢুকলাম , অভিজাত তবে বেশ ব্যস্ত হোটেল ,কারো সাথে কথা বলার জো নেই । অনেক কষ্টে বসার টেবিল পেলাম । ওয়েটার নর্থ থালি, সাউথ ইন্ডিয়ান থালি প্রভৃতি থালীর নাম বলে যাচ্ছিল গড়গড়িয়ে। এখানে প্রবেশের পর সাউথ ইন্ডিয়ান থালি নামটা বেশী কানে বেজেছে । বন্ধুবর লিংকন বলল কীরে সাউথ ইন্ডিয়ান বলব নাকি , মনে হয় খুব টেষ্টি ,দেখ সবাই কেমন মজা নিয়ে খাচ্ছে । আমি সায় দিয়ে বললাম -বল। দুটি বড় গোল থালায় আট/ দশটি একই সাইজের বাটি বসানো সেই সাউথ ইন্ডিয়ান ডীশের থালি এল ।

বেশ ক্ষুধা পেটে , পাকস্থলি তার Parasympathetic কার্যক্রমের প্রস্তুতি অনেক আগে নিয়ে তৈরী হয়ে আছে । খাবার তুলে মুখে দিলাম আর তাতেই টেষ্ট বাড গুলোর চরম হরতালী আচরণ । এ বাটি ও বাটি দ্রুততায় চেখে দেখতে লাগলাম তবে কোনটিও রোচে না আমাদের বাঙ্গালী জিহ্ববায় । অনেক চেষ্টায় কিছু পাঁপড় গুড়া আর দু ফালী সিকি মাপের আটার রুটি শুধু খাওয়া মত পাওয়া গেল । একে অপরের মুখের দিকে করুনভাবে দেখি ,পেটে এখনো দারুন ক্ষীদে। ওয়েটারকে ডেকে খাওয়ার যোগ্য রুটির টুকরো দেখিয়ে বললাম "ভাইয়া আউর এ রোটি লেকে আও"। ওয়েটারের সাফ জবাব - খালী রোটি নেহি মিলতা । এ থালী মে included. আউর থালী লাউউ । আরো থালী -ওয়াক। বাহিরে বেরিয়ে লিংকনকে গালি দিতে লাগলাম - "যা শয়তান খাঁ, ওয়েটার তোর জন্য আরও দুটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেডী করছে।"


২ ভারতের রাজস্থান । পারিবারিক হলিডে ট্যুর , সফরসঙ্গীদের অন্যতম বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সেন্টিমেন্টাল ব্যক্তিত্ব আমার আম্মা । জয়পুর থেকে কিছুটা দূরে Choki Dhani নামের জনপ্রিয় ও বিলাসবহুল ভীলেজ রিসোর্ট । রিসোর্টের অন্যতম আকর্ষন রাজদরবারের মত এক গ্রান্ড হলে সলতের আলোতে রাতের খাবার ,তাও নাকি রাজস্থানী রাজাদের প্রিয় সব রেসিপি | বুকিং মানি এডভান্সড জমা দিতে হয় । বুকিং অফিসারের বর্ণনায় দুপুর থেকেই সেই খাবারের জন্য জ্বীভে জল টলটল অবস্থা আমার । সবাইকে নির্দেশনা দিয়ে রাখলাম রাতে বিশেষ রাজভোগ হবে , আবোল তাবোল খেয়ে কেউ যেন পেট না ভরে । আমার মা আপত্তি জানালো - "আমি ওসব রাজার খাবার খাব না , তুই আমার জন্য দুটা রুটির ব্যবস্থা করে দিস , আমি যাব না । " আম্মার আপত্তিতে একটু রাগ করে বললাম - "যাবা না মানে , রাজস্থান আর কবে আসবা , সারাজীবন তো ভাত-রুটি খেলা । সবাই মিলে Special কিছু খাব একটা নতুন experience হবে এজন্য তো এতগুলো টাকা খরচ করলাম । সবাইকে যেতে হবে । " সন্ধ্যা হতেই চৌকি ধানী মেলা মাঠে জুড়ে কয়েকটি মন্চে চমৎকার traditional রাজস্থানী নাচ গান চলছে ; চলছে উটের পিঠে ,ঘোড়ার পিঠে সাওয়ার হওয়ার বিভিন্ন ইভেন্ট । আটটা না বাজতেই সব ফেলে সকলকে তাগাদা দিয়ে সেই রাজকীয় ডাইনিং হলে হাজির করালাম ।

 

সুন্দর প্রশস্ত হল । আভিজাত্যের প্রকাশ সুনিপুণ-দেয়ালে ও আসনে । কারুময় রাজস্থানী ঝালোড় ঊপরে আর ঢাউস হাত পাখায় বাতাস করছে কালো তবে উজ্বল নয়না রাজস্থানী সুন্দরী তন্বী পাখাল । প্রাচীন আবহ জিইয়ে রাখতে বিদ্যুৎ নয় মাটি তেলের সলতে/পিদিম জ্বলছে চারিদিকে যেন দ্বীপাবলীর আয়োজন। এক ছোট মন্চে দুজন স্থানীয় শিল্পি চটুল সুরের রাজস্থানী গান গাইছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে রাজকীয় সম্ভাষন জানিয়ে রাজকীয় বড় বড় থালা সবার সামনে দেয়া হল । থালার সাইজ দেখে আম্মা বললেন , "বাবু আমি বেশী কিছু খাব না আমাকে দিতে মানা করিস । " সুন্দর পোশাকে আরদালী ছোট ছোট সাজানো হাড়ি হাতে সারিবদ্ধ ভাবে এসে একটার পর একটা খাবার দিয়ে যেতে থাকল পাতে । আমরা প্রথমে লোকমায় পরে শুধু আঙ্গুলের মাথা ডুবিয়ে একটার পর একটা খাবার চাখতে থাকি আর আশা করতে থাকি পরের টা সুস্বাদু হবে নিশ্চই ।একে একে সব আরদালীর আসা শেষ আর খাবারেও থালা ভরে গ্যাছে | সবার থালা নাড়া বন্ধ , নিষ্ঠুর আর বিষ্মিত চাহুনি আমার দিকে । আমি তাদের এমন শাস্তি দিতে পারি সেটা তারা কল্পনাও করতে পারেনা। ফাকা দূর্গম স্থানে এই চৌকি ধানী । আজ রাতে বিকল্প খাবার আর হয়ত মিলবে না । দুশ্চিন্তা আর নিজ বোকামী লুকাতে আমি সেই বিস্বাদ খাবার দম বন্ধ করে একটু একটু খাচ্ছিলাম আর বলছিলাম নতুন জায়গায় গেলে নতুন খাবারের একটু স্বাদ নিতে হয় । আমার তো ভালই লাগছে , স্বাদ টা different এই যা । সব খাবার কী আমাদের মত ঝোল - ঝালে ভরা হবে। আমার চরম রগচটা মা । 'আমাদের খাবারের' জায়গায় 'আম্মার খাবার' শুনেছে হয়ত ।"জোর করে আনলি , এখন জোর করে এই খাবার খেতে বলছিল । আমার খাবার ঝাল । আমাকে অপমান করতে এখানে এনেছিস ।" এই বলে বেরিয়ে গেলেন । আম্মার পিছনে বাকীরা । সবাইকে আনন্দ দিতে চাইলাম উল্টাে আমার এই চরম লাঞ্ছনা । আমাদের মোটা স্বাস্থ্যের টীম থেকে ভাল বকশিস মিলবে এই আশা হয়ত সবার ছিল । রাগেদু:খে আমার চরম অবস্থা । আমিও কোন দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে এলাম ।সেই গায়ক -গায়িকা গান থামিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টায় বার বার "রাম রাম জী " "রাম রাম জী " বলে সম্ভাষনের কথায় চিৎকার করতে থাকল।

 

এবার নেপালে ফিরে আসি । নেপালের Popular ডীশ traditional পাহাড়ীদের হাতের "ডালভাত " আর আধুনিক স্ন্যাকস 'মম' । নাগরকোটে হোটেল ফোর্টে বৃষ্টি ভেজা রাতে স্থানীয় তামাঙ্গ (tamang) রাঁধুনির হাতের ডাল ভাত পেট পুরে খেলাম সাথে পুদিনায় তৈরী বিশেষ চাটনী , আলুর ব্যান্জন আর লাউ শাক স্বাদের এক শাক ভাজা । সত্যি অপূর্ব আজো খেতে মন চাইছে । বাকী রইল মম।
Traditional ডাল ভাতে ধর্মের কোন বাঁধা নেই । বাঁধা হল মমতে -বাঁধাটা বিরাট হারাম- হালাল্ এর , মম তৈরীর প্রধান উপাদান মাংসে । মম হল অনেকটা সিঙ্গাড়ার মত । পিঠা তৈরীর ছাচ বা ডাইসে আটা বা ময়দার নক্সা করে সিঙ্গাড়ার মত কাপ তৈরী করে তাতে মাংসের পুর ঢুকিয়ে তৈরী হয় মম ।এই মাংস হালাল কাটা চীকেন বা মাটন হতে পারে আবার হতে পারে হারাম পীগ।
নেপালে আসলাম আর মম খাব না তা কী করে হয় ।হালাল মম যখন হয় তবে খাব নিশ্চয় ।রমজান , তাই খাবারের খোঁজ রাতে বা সন্ধ্যায় ।
কাঠমান্ডুর রাজপথ , ইফতারীর সময়ও ঘনিয়ে এসেছে ।এক সাজানো গোছানো ফাষ্টফুডের দোকান চোখে পড়ল । দরজা পাশে বাহারী ডিসপ্লে তে লিখা Grab your Hot dog & also delicious Momo chicken ,mutton & pork which you like. বিজ্ঞাপন ও সাজগোছে মনে হল standard ব্যবসায়ী শুয়োর খাসীর পার্থক্য বজায় রেখেই ব্যবসা করে ।

ইফতার আজ প্রত্যাশার মম আর হটডগে হয়ে যাক।ভিতরে ঢুকে মাংস হালাল কিনা তা আবার নিশ্চিত করতে ম্যানেজারের কাছে গেলাম । স্মার্ট ম্যানেজার মাটন তাগড়া জোয়ান মুসলিম কসাই এর কাটা এতদূর পর্যন্ত বিশ্বত্বতা আনার চেষ্টা চালাল।
টেবিলে বসে হটডগ ,মম আর ইফতারীর সময়ের অপেক্ষা । "রতনে রতন খোঁজে আর রাঁধুনির খোঁজ হাড়ির ।" শম্পা এর মধ্যে দেখে ফেলেছে এদের হেসেলে ভাঁজার কড়াই একটা অর্থাৎ মাটন পীগ যাই হোক সবার গন্তব্য ঐ এক কড়াই এ ।
ব্যাপারটা ম্যানেজারকে notice করে ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রভাবে বেরিয়ে আসতে উদ্যোগ নিলাম। ম্যানেজার মাটন পীগ রন্ধন প্রক্রিয়া ,আলাদা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদী উল্টাপাল্টা বেশ কিছু বোঝাচ্ছিল।

আমার বারংবার sorry শুনে শেষমেষ তার জিজ্ঞাসা 'হটডগে' কী সমস্যা ? হটডগতো আর ঐ কড়াইয়ে উঠে না । ক্লান্ত শরীর , পেটে ক্ষুধা , সময় কম - মেজাজটাও গেল বিগড়ে । পকেট থেকে টাকা (রুপি) বের করে ছুড়ে দিয়ে বাংলায় বললাম -"এই নে তোর টাকা । শালা কুত্তা শুয়োর কোনোটাও খাইনা ।
______________________________

 

 

 

লেখক ডা. নুরুল হাসান বাবু । জনপ্রিয় লেখক। সুখময় প্রাণবন্ত গদ্য লেখেন।
ইতোমধ্যেই সর্বস্তরের পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন।
Clinical Ultrasound Consultant at Popular Diagnostic Centre Ltd.
Works at Bangladesh Govt.
Former Assistant Registrar at National Institute of Mental Health
Studied Bachelor of Medicine & Surgery (MBBS) at Rangpur Medical College

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়