Ameen Qudir

Published:
2017-06-19 01:23:28 BdST

নবীনকিশোর, জীবনপাত্র টা নিয়ে এসো তো বাবা


 

 

 

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
_____________________________

আটের দশকের শেষভাগ। বছরের শেষ কটা দিন। মনোরম আবহাওয়া। মায়াপুরের নাম শুনেছি অনেকবার। যাওয়া ঘটে ওঠে নি। হটাৎ পাড়ার ছেলেরা বললে, সিদ্ধার্থ দা, আমরা মিনিবাস ভাড়া করে মায়াপুর যাবো। সকালে গিয়ে রাতে ফেরত। অনেক বয়স্ক মাসীমারা যাবেন। তুমি গেলে তোমারো ভালো লাগবে, আবার আমরাও নিশ্চিন্ত। শরীর খারাপ হলে কারো, তুমি একটু সামলে দেবে। মাসীমা কেও বলো না যেতে।

তখন বাড়িতে আমি আর মা। মা যেতে রাজী হলেন না। আমাকে বললেন, যা না তুই ঘুরে আয়। বাড়ি ফিরে খাবি তো? আগে ফিরিস, একসঙ্গে খাবো রাতে।
মিনিবাস বোঝাই করে আমরা নবদ্বীপ, মায়াপুর দেখতে গেছি, থুড়ি তীর্থ করতে গেছি। ড্রাইভার আর তার চ্যালা সমেত মোট পনের জন। মূল উদ্যোক্তা --- দেবু নামের উঠতি সিপিয়েম নেতা। নাটক -- রাজনীতি - ফাংশন সবই করে। আমাদের নেতা সেই ই। আমার ডাক নাম ছিলো বিরু, সেটা মুখে মুখে বুড়ো বা বুড়ো দা হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত আমি আমার দশ বছর -- ক্লাস সিক্স থেকেই বুড়ো। তখনো বয়েস এর প্রথম সঙ্খ্যা টা ১ই ছিলো। বৃদ্ধ যুবক আমার ও সহযাত্রী দের --- টিফিন টা পাউরুটি, কলা এবং ডিমসেদ্ধ আর কমলালেবু দিয়ে বাসেই হয়ে গেল বারাকপুর হয়ে বারাসত পার হয়ে জাতীয় সড়কে উঠেই দুদ্দাড়িয়ে শেষ হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলুম দেবুবাবু কে --- দুপুরে কোন হোটেলে খাবো? ১৫ জনের দল তো নেহাত ছোট্ট নয়। বললে, হোটেলে খাবো না, খরচ বেশী পড়বে। আমার পরিচিত একটি গোঁসাইজীর আড্ডা আছে, চলো সেখানেই খাবো

আমি বললুম দেখ দেবু, শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আমরা ১৫ টি প্রাণী। কোন মুখে বলবো যে আমরা সবাই দুপুরে এখানে খাবো? দেবু বাংলাদেশ ম্যাচে বিরাটের মতো বিরাট জীভ বার করে বললে --- ছিঃ, বুড়োদা। তারপর দুহাত দুকানে ছুঁয়ে বললে, ' খাবো ' বলতে নেই, বলতে হয় প্রসাদ পাবো।
দেবু মোটেও বৈষ্ণব নয়, সে নাটক করে, রাজনীতি করে, মুর্গির ঠ্যাং ওর দিব্যি প্রিয় খাদ্য। কিন্তু গোঁসাইজীদের আখড়ায় গতায়াত আছে বলে পারিভাষিক শব্দগুলো দিব্যি রপ্ত আছে। ও বললে, বুড়োদা তুমি প্রথমেই গিয়ে ৫ x ১৫ = ৭৫ টাকা দিয়ে....
দেবুকে মাঝপথে থামিয়ে বলি, আশ্রমে মীল চার্জ কি ৫ টাকা?
এবারেও সে শিহরিত হয়ে জীভ বার করে, দু কান স্পর্শ করে বললে, মীল চার্জ নয়, তুমি প্রণামী দেবে। আর বলবে দুপুরে আমরা ১৫ জন প্রসাদ পেতে আসবো!
সেইমতো ই ব্যবস্থা হলো। আখড়ায় গিয়ে আমি গৌরাঙ্গ দর্শন করে, আমি প্রণামী দিয়ে জানিয়ে এলুম যে মধ্যাহ্নকালে এসে প্রসাদ খেয়ে যাবো। গোঁসাই জী বৈষ্ণব বিনয়ে সম্মত হয়ে বললেন --- এযে আমার পরম সৌভাগ্য।


এর মধ্যে ঘোরা, দেখা, প্রণাম পর্ব শেষ করে দুপুরবেলা গড়িয়ে ফিরে এসে দেখি, বারান্দায় ঠিক ১৫ টি আসন ই পাতা। হস্তপদপ্রক্ষালানাদির একটা ব্যাপার ছিল। সেটি সেরে এসে আমরা আসনে সারি সারি বসলুম। মাটির খুরিতে জল, কলাপাতায় পরিবেশিত হল আহার্য। সব কিছুই পবিত্র, পরিচ্ছন্ন এবং সুস্বাদু ও বটে। কিন্তু আমরা ক্রমাগত হোঁচট খেতে থাকি ওই পারিভাষিক প্রতিবন্ধকতায়। গোঁসাইজী যুক্তকরে দাঁড়িয়ে থাকলেন সামনে, অতিথিসেবা পরিদর্শন করতে। নীলু যেই বলেছে , আর দুটি ভাত ....... অমনি গোঁসাই জী শিউরে উঠলেন। জীভের প্রান্তভাগ দাঁত দিয়ে কামড়ালেন, তারপরে দু হাত নিজ কর্ণমূলে স্পর্শ করে নীলুকে বললেন --- অনুগ্রহ করে ঐ কথাটি আর বলবেন না।

নীলু এবং আমরাও সক্কলে আক্ষরিক অর্থেই হাঁ। এখানে সেকেন্ড হেল্প যে অশাস্ত্রীয় তা আগে কে জানতো

কিন্তু নীলুর আশংকা অমূলক। তখুনি গোঁসাইজী পাকশালা র দিকে তাকিয়ে হাঁকলেন, বাবা নবীনকিশোর, অন্ন পাত্র টি নিয়ে এসো তো।
নবীনকিশোর জনে জনে পরিবেশন করে গেল।
শুধু নীলুর বরাতে আর ভাত জুটলো না, জুটলো অন্ন।
দু নম্বর শহীদ বাসব। দোষের মধ্যে সে একটু ডাল চাইলে। এবারেও গোঁসাইজী শিউরে উঠলেন। এবারে তাঁর নির্দেশে নবীনকিশোর বালতি করে নিয়ে এলো 'রসা '। অন্নের সঙ্গে রসা সেবা করাই বিধেয়।

আমারো জলের গ্লাস খালি হয়ে গেছে। গলাও শুকিয়েছে। কিন্তু জলের পারিভাষিক শব্দ যে জানা নেই। জানি জল চাওয়া মানে গর্হিত অপরাধ। একি বিড়ম্বনা। থাক, জল চাই নে আমার। হাত ধুয়েই না হয় কলের থেকে অঞ্জলি পেতে খাব। কিন্তু, শরীর যে মানে না। নাভি কুণ্ডলী থেকে তৃষ্ণার্ত একটি ঔদরিক আকুতি বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে -- কঁক।

শিউরে উঠলো দেবু। এযে রামপাখি র ডাক। বৈষ্ণবের আখড়ায় ওসব কি বলতে আছে? জলের প্রতিশব্দ -- কঁক? আমি সামলে নিয়ে বলি, না ওটা হেঁচকি। জল ইজুকাল্টু বারি, অপ্, অম্বু, উদয়, নীর, কঁক। দেবু বললে, আর দু চারটে --- অন্ত:, সলিল, আকুয়া, ওয়াটার, H2O, কঁক। তারপরে বললে না ওভাবে হবে না। তুমি বরং গ্লাস টা ঠক ঠক করো।
----- না, মানে তুমি এমন ভাব দেখাও যে যেন খেতে বসে কথা বলেন না। আমরা এতক্ষণ কথা বলেছি। তুমিই নির্বাক আহার করেছ।
দেবুর কথানুযায়ী আমি মূকাভিনয় টা সম্পূর্ণ করলুম।
গোঁসাইজী আবার বললেন --- নবীনকিশোর, জীবনপাত্র টা নিয়ে এসো তো বাবা।
সকলের জীবনপাত্র পরিপূর্ণ হলো। প্রসাদ অতি উচ্চপর্যায়ের। পরম পরিতৃপ্তি হলো। হোটেলে এমনতর হত না। পারিভাষিক প্রতিবন্ধকতা বাদ দিলে এমন সুস্বাদু অন্নব্যঞ্জন এবং এমন সস্নেহ, সযত্ন পরিবেশন হোটেলে মিলতো না।
এরপর যথারীতি নিয়মিত নির্বিঘ্ন নিরুপদ্রব প্রত্যাবর্তন।।

____________________________________
লেখক ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় । কলকাতার প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক । কবি।

Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC)

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়