SAHA ANTAR

Published:
2021-09-19 16:08:47 BdST

মহাজীবনট্রাজেডি কিং দিলীপ কুমার


 

রাজিক হাসান
লন্ডন থেকে
________________

দিলীপ কুমার ‘ট্র্যাজেডি কিং’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ট্রাজেডি নায়ক হিসেবে তাকে দেখা যেত অধিকাংশ সিনেমাতে। ট্র্যাজেডি দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য তিনি ছিলেন সেরা নায়ক, বলতে গেলে কোন প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না তাঁর। ট্রাজিডি দৃশ্যে তখন নিয়মিত অভিনয় করতে করতে বাস্তব জীবনেও তিনি বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করেন। শরণাপন্ন হন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের। দিলীপ কুমার বিবিসি বাংলাকে দেয়অ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটা সময় ছিল যখন মৃত্যুর দৃশ্য করতে গিয়ে আমি ডিপ্রেসড হয়ে যেতাম। বিষন্নতা কমাতে আমাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। চিকিৎসক আমাকে ট্রাজেডি বাদ দিয়ে কিছু কমেডি সিনেমায় অভিনয়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ‘আন’, ‘আজাদ’, ‘কোহিনূর’ সিনেমায় ভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার। মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছিলেন তিনি ‘ট্র্যাজেডি কিং’ তকমা থেকে বের হয়ে আসার জন্যে। লন্ডনে দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা। চিকিৎসার ফাঁকে ফাঁকে তিনি কিছু কমেডি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

দীর্ঘ ছয় দশকের ক্যারিয়ারে তিনি ৬০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম ‘নয়া দৌড়’, ‘মধুমতি’, ‘গঙ্গা যমুনা’, ‘রাম অউর শ্যাম’, ‘দাগ’, ‘আজাদ’, ‘দেবদাস’, ‘মুঘল-ই-আজম’, ‘কোহিনূর’, ‘পয়গাম’, ‘আদমি’, ‘শক্তি’, ‘লিডার’ ইত্যাদি। ১৯৯৮ সালে ‘কিলা’ সিনেমায় শেষবার তিনি রুপালি পর্দায় হেঁটেছেন। ষাটের অঙ্কের এই চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয়ে তিনি অনেক রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করেছেন। তাতে দেখা গেছে শেষ পর্যন্ত নায়িকার সঙ্গে মিলন হয়নি। বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। বলা হয়ে থাকে কিংবদন্তি এই তারকার নিজের ব্যাক্তি জীবনের ভাঙা গড়া ছবিতেও রূপায়িত হয়েছে। যা তাকে ট্রাজেডি কিং হিসেবে পরিচিত করিয়েছে।

বলিউডে থিতু হয়েছেন, নাম কামিয়েছেন, কিন্তু তার জীবনে প্রেম আসবে না, তাও কি কখনও হয়? বড় পর্দার ট্রাজিডি কিং-এর ব্যক্তিগত জীবন ছিল যথেষ্ট রঙীন। তাঁর জীবনেও প্রেম এসেছিল। এসেছিল একাধিকবার। ব্যক্তি জীবনেও বেশ রোমান্টিক ছিলেন তিনি। প্রেমিকাদের নিয়ে বেশ কয়েকবার খবরের শিরোনামও হয়েছিলেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের মতে, অভিনয়ের প্রথম দিকে দিলীপ কুমার কামিনী কুশলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। কিন্তু কামিনীর দাদা মেনে নিতে পারেননি ওই সম্পর্ক। আচমকা কামিনীর বোনের মৃত্যু হওয়ায় বোনের স্বামীকে বিয়ে করেন অভিনেত্রী কামিনী কুশল। ক্যারিয়ারের প্রথম প্রেমেই ধাক্কা খান দিলীপ কুমার। এই ধাক্কা সামলে নিতে শরণাপন্ন হন মধুবালার। মধুবালা ও দিলীপ কুমার মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছিলেন দুজন দুজনকে। চেয়েছিলেন তাঁরা বিয়ে করতে। কিন্তু পারেননি। ক্যারিয়ারের ইগো আর মধুবালার বাবার কূটচালের কাছে সেই সম্পর্ক ভেঙে খান খান হয়ে যায়। অনেকটা অভিমান ও দিলীপ কুমারের ওপর ক্ষোভ নিয়েই পরে কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমারকে বিয়ে করেছিলেন মধুবালা। কিন্তু সুখী হননি। ৯ বছর টিকে ছিল তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক। রোগেশোকে ভুগে মারা যান কোটি পুরুষের স্বপ্নের রানী মধুবালা। দিলীপ কুমার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আতাউল্লা (মধুবালার বাবা) এই সম্পর্কটাকে একটা বিজনেস ভেঞ্চার হিসাবে ফায়দা তুলতে চেয়েছিলেন যার জেরে সন্তুষ্ট হয়ে মধুবালার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তিনি।

মধুবালার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বেশ কিছুদিন নিজেকে সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন দিলীপ কুমার। এরপর পরিচয় হয়সায়রা বানুর সঙ্গে। দিলীপ কুমার ও সায়রা বানুর প্রেম কোনও ছবির চিত্রনাট্য থেকে কম নয়৷ দিলীপ কুমারের থেকে বয়সে ২২ বছর ছোট ছিলেন সায়রা৷ দিলীপ কুমারকে শেষ সময় পর্যন্ত তিনি রেখেছিলেন আগলে আগলে৷

১২ বছর বয়স থেকেই দিলীপ কুমারের প্রেমে পড়েছিলেন সায়রা বানু৷ নিজেই সেকথা স্বীকার করেছেন অভিনেত্রী৷ দিপীল কুমার অভিনীত মুঘল-এ আজাম ছবির প্রিমিয়ারে উপস্থিত হন৷ সায়রা বানু তখন ১৬ বছরের যুবতী, দিলীপ কুমার তখন প্রতিষ্ঠিত স্টার! প্রথম সাক্ষাৎ থেকেই সায়রা বানু বিশ্বাস করতেন যে তিনি একদিন দিলীপ ঘরণী হবেনই৷ দিলীপ-সায়রার প্রেমে মক্ষোম ভূমিকা পালন করেছিলেন সায়রা বানুর মা নাসিম বানু। মেয়ের কাছাকাছি তিনিই নিয়ে এসেছিলেন নামজাদা স্টার দিলীপ কুমারকে৷ ঝুক গয়া আসমান ছবিতে সায়রা বানুকে প্রোপোজ করেন দিলীপ কুমার। না বলার তো কোনও প্রশ্নই ছিল না৷ ১৯৬৬-র ১১ অক্টোবর সায়রা বানু ও দিলীপ কুমারের বিয়ে হয়৷ ৪৪ বছর বয়সী দিলীপ কুমারের অর্ধেক বয়স হওয়া সত্ত্বেও সায়রা বানু তাঁর গলায় মালা পরান।

১৬ বছর ঘর করলেও দিলীপ কুমার সায়রা বানু সম্পর্কের চিড় ধরে, বেড়ে যায় দূরত্ব তাদের দাম্পত্য জীবনে। বিয়ে থেকে একসময় সরে যান দিলীপ কুমার৷ সায়রা বানুর ঘর ত্যাগ করেন দিলীপ কুমার৷ বিয়ে করেন আসমা রেহমানকে৷ কিন্তু, বিয়ের দু’বছরের মধ্যেই আসমার সঙ্গে দিলীপ কুমারের দুরত্ব বাড়তে শুরু করে। আসমা তাঁকে ‘ঠকাচ্ছেন’, সেই অভিযোগেই দূরে সরে যান দিলীপ। আসমার সঙ্গে ঘর ভাঙার পর ফের সায়রা বানু-কে বিয়ে করেন দিলীপ কুমার। এই ঘটনাটি ভুলেই যেতে চান সায়রা বানু৷ আসমার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ফের সায়রার কাছেই ফিরে আসেন দিলীপ। আবারও তারা বিয়ে করে সংসারী হন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সায়রাই ছিলেন দিলীপের প্রেম, আশ্রয়, ঠিকানা, পরিচয়, সেবিকা। সায়রা ক্যারিয়ার, খ্যাতি সব ছেড়ে দিলীপ কুমারের বুকেই স্বর্গের সুখ খুঁজে নিয়েছিলেন। প্রায়ই তিনি বলতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, আল্লাহর কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ কোহিনূর রূপে দিলীপ কুমারকে তার কাছে পাঠানোর জন্য। এটা যেন তাঁর জীবনের এক অভিশপ্ত সময়৷ তাঁর সিদ্ধান্তেও ভুল ছিল, এক সময় মেনে নেন দিলীপ কুমার৷ তিনি বলেন যে আসমা রেহমানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল হায়দরাবাদে, এক ক্রিকেট ম্যাচে৷ তবে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ভুল হয়েছিল৷

জীবদ্দশায় ৬৩টি ছবিতে অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার। তার সাফল্য কিংবা অর্জনের তালিকা অনেক লম্বা। প্রায় ছয় দশকের ক্যারিয়ারে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সবচেয়ে বেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় অভিনেতা হিসাবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও তার নাম রয়েছে। ফিল্ম ফেয়ার আটবার পেয়েছেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। মনোনীত হয়েছেন ১৯ বার। ফিল্ম ফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৮০ সালে মুম্বাই শহরের সাম্মানিক শেরিফ পদটি অলংকৃত করেন তিনি। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন ভারত সরকারের সম্মাননা পদ্মভূষণ ও দাদা সাহেব ফালকে। পাকিস্তান সরকার তাকে ভূষিত করেছে ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’ সম্মাননায়। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ভাগ্যে জোটেনি তাঁর।

একজীবনে নাম-যশ-খ্যাতি সবই পেয়েছেন দিলীপ কুমার। অর্থও কামিয়েছেন অঢেল। এতকিছুর পরও এই ট্রাজেডি হিরোর নেই কোনো উত্তরসূরি। ৯৮ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে ৫৫ বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন স্ত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে। যদিও কোনো সন্তান না থাকায় কোনো আক্ষেপ ছিল না এ কিংবদন্তির। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা সানন্দে মেনে নিয়েছিলেন তিনি। একবার এক সাক্ষাৎকারে দিলীপ কুমার বলেছিলেন- ‘এটা সত্যি যে, আমাদের সন্তান থাকলে দাম্পত্য আরও রঙিন হতো। তবে উত্তরাধিকারী নেই বলে আমাদের কোনো কষ্ট নেই। আমি মনে করি, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই আমাদের জীবনে এ শূন্যতা। আমি ও সায়রা এ অভাব মেনে নিয়েছি।’

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়