Ameen Qudir

Published:
2020-02-09 08:16:25 BdST

ডা. মোশতাক আহমদের ‘ ডুবোজাহাজের ডানা’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতার সেরা নিদর্শন



ডেস্ক
______________________

কবি ডা. মোশতাক আহমদের
‘ ডুবোজাহাজের ডানা’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতার অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থ।

কবি জিললুর রহমান বলছেন ‘ ডুবোজাহাজের ডানা’ নিয়ে –

কবি মোশতাক আহমদকে পড়ে আসছি, দেখে আসছি আশির দশকের শেষার্ধ থেকে; তিনি আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সতীর্থ। তিনি আমার নীরবতার বন্ধুও বটে! কবি মোশতাক আহমদ তাঁর প্রথম বই ‘সড়ক নম্বর দুঃখ বাড়ি নম্বর কষ্ট’ থেকে ক্রমাগত নিজের কবিতার ভাষাকে, কবিতার প্রকরণকে পালটে নিচ্ছেন। এটা জীবনেরই ধর্ম, কবিদের ধর্ম।

‘ ডুবোজাহাজের ডানা’র নামকরণে আছে ইঙ্গিতময়তা। সামুদ্রিক অনুষঙ্গ প্রধান এই বইটি চারটা পর্বে বিভক্ত, চারটা পর্বেই আছে বিষয় ও আঙ্গিকের ভিন্নতা। প্রথম পর্ব ‘সাবমেরিনের সার্সি’তে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ‘অনুপস্থিত জলের এলিজি’ একটি ইঙ্গিতময় কবিতা যেখানে কবির পরিণত হবার ছাপ পাওয়া যায়, ‘দুরত্বের গান’ কবিতায় আমাদের অনিত্য জীবনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন-
জলরঙ ছবি আমি
ধুয়ে যাব প্রথম বর্ষায়।
তাঁর কবিতা ভিন্ন ভিন্ন পাঠককে ভিন্ন ভাবে ভাবায়।

... আমরা বরফ যুগের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি; কিন্তু যতদিন পৃথিবীতে জীবন আছে, কবিরা জীবনের কথা বলবেন, অমরতার কথা বলবেন। এই বইতে বয়সোজনোচিত কারণেই মোশতাকও নানাভাবে এই বিষয়টা নিয়ে এসেছেন।

 

কবি জিললুর রহমান বলছেন ‘ ডুবোজাহাজের ডানা’ নিয়ে –

 

দ্বিতীয় পর্বের কবিতাগুচ্ছ ‘দীর্ঘ ইমন’। কাহিনির আভাস পাওয়া যায় অন্য আমেজের এই কবিতাগুচ্ছে। ‘চন্দ্রনাথের প্রজাপতি ‘ একটি অসাধারণ স্মৃতিকাতর কবিতা। স্মৃতিময়তা আর বন্ধু বাৎসল্যের স্বাদ পাই ‘হস্তরেখার আলপথে’ কবিতায়, কিংবা ‘তারাপদ রায়ের কাণ্ড’ কবিতায়। কবিতাগুলোতে কবির স্বর পালটানো খুবই উপভোগ্য। কবি প্রতিনিয়ত স্বর, সুর পাল্টাচ্ছেন সেই চিহ্ন তাঁর কবিতায় আছে।
‘গদ্যগহন করোটি’ পর্বের কবিতাগুলো টানা গদ্যে লেখা। ভাব গাম্ভীর্যে আমাদেরকে অন্য এক বিপন্ন বিষ্ময়ের দিকে ঠেলে দেয়।
‘আর্ত চতুর্দশী’ পর্বে কয়েকটি সনেট আছে; এই সনেটগুলোই মোশতাক আহমদের এই বইয়ের প্রাণভোমরা! শেষ সনেট ‘সমুদ্রপীড়া’য় অসাধারণভাবে সময় ও জীবনকে ধরেছেন -
গড়িয়ে পড়ছে ধীরে দালির ঘড়িটা
পাণ্ডুর সময় গিলেছে সমুদ্রপীড়া ।

কবি মোশতাক আহমদ তাঁর কবিতায় বঙ্গীয় উত্তর আধুনিকতার কিছু নিদর্শন রেখেছেন; আন্তর্বয়ন নিয়ে খেলেছেন বিভিন্ন কবিতায়। তাঁর ‘ছেলেবেলার গানে’র আন্তর্বয়নে মনে পড়ে যায় ঠাকুর কবির বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুরের কথা, ‘ নকটার্ন’ কবিতায় এসেছে জীবনদাশের ধুসর জগত কিংবা ভ্যানগগের তারাভরা রাতের কথা। এক এক কবিতায় এক এক কৌশলে তিনি আন্তর্বয়ন ব্যবহার করেছেন।

চিত্রকল্প ব্যবহারে তাঁর মুন্সিয়ানা আছে। ছন্দ নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু ছন্দের ধারাবাহিকতা পাওয়া যায় না। হয়তবা কথনের স্পন্দনে অধিক বিশ্বাসী । ছন্দের ব্যাপারে সমালোচকদেরকে অগ্রিম জবাব দিয়েও রেখেছেন ‘ডাইলেমা’ কবিতায়- যেখানে ছন্দ লেখা আর কবিতা লেখার কথা নিয়ে কাব্যিকভাবে বিতর্ক করেছেন।
মোশতাক লিখে যাচ্ছেন কবিতা, গল্প, স্মৃতিকথা, অনুবাদ কবিতা। তিনি বাংলা সাহিত্যের জন্য একজন জরুরী লেখক।

সাখাওয়াত টিপু বলছেন ' ডুবোজাহাজের ডানা ' নিয়ে-

মোশতাকের কবিতা পড়লেই চট্টগ্রাম চোখে ভাসে, মনে পড়ে যায় কর্ণফুলি নদীর কথা। অনেক বছর বিরতির পর সে ফিরে এসেছিল ‘নতুনধারা’র পাতায়। কিন্তু সতীর্থের কবিতা নিয়ে আলোচনার মুশকিল আছে নানাবিধ; তার মধ্যে একটি হচ্ছে মোশতাকের নন্দনতত্ত্বে আমি বিশ্বাস করি কিনা তা প্রকাশ্যে বলা!

... আমাদের পূর্বসূরীরা নতুন রাস্ট্রের স্বপ্ন দেখে জাতীয়তাবাদী ধারার কবিতা লিখে এসেছেন। যে গণতান্ত্রিক সমাজ আমরা চেয়েছিলাম তা কি পেয়েছি?

... আশির দশকে এসে বাংলাদেশে কবিতার দুটো ধারা দেখা গেল- রাজনৈতিক ধারা আর ফরাসী কবিতার অনুসরণে একটি শৈল্পিক ধারা। এরপরে কবিতার বিরাজনীতিকরণ হয়েছে, সমাজেও নেই রাজনীতির চর্চা।

... নানা ডামাডোলের মধ্যে চট্টগ্রামে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার জগতে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মশাল ছিল, জাগরণের; মোশতাক আহমদ তাদেরই একজন।
কবিতার এই দ্বিধাভিভক্ত ধারা ছাড়াও ছন্দ নিয়েও আছে তর্ক। ছোট্ট একটি কবিতায় মোশতাক এ বিষয়ে তার নিজস্ব তর্কটুকু উত্থাপন করেছেন-

রূপকথার পাতা থেকে লাফ দিয়ে পালানো বিড়ালের হাসি
অস্তনীল আকাশের রঙে হারায় কবিতার মত,
বেওয়ারিশ ভাসছে ছন্দের শাদা ইজেল।
বিড়ালেরা হারিয়ে যায় হাসিগুলো রেখে
আকাশ হারিয়ে গেল গাঢ় নীল ছোপে।

তাহলে কবিতা লিখো না, ছন্দই লিখো
মনে কর যদি
অমরতা আর ঋদ্ধি
ওখানেই জায়মান!

তাহলে ছন্দে লিখো না, কবিতাই লিখো
মনে কর যদি
রক্ত অশ্রু নদী
শিয়র অবধি
( ডাইলেমা)

কবি জিগ্যেস করছেন, তুমি কি ছন্দ লিখতে চাও নাকি কবিতা লিখতে চাও! কেউ বলবে যার ছন্দ নাই, তার কবিতাও হয় না; অর্থ্যাৎ শিল্পের জন্য শিল্প। কেউ বলবে জীবনের জন্য শিল্প। মোশতাক হচ্ছে এই দুই ধারারই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

লেখালিখির শুরুতে মোশতাকের কাঁধে একজন আবুল হাসান থাকলেও তার গঠন আবুল হাসানীয় কিংবা জীবনানন্দীয় নয়; তিনি নিজের স্বর খুঁজে পেয়েছেন। দীর্ঘ বিরতি শেষে খানিকটা কক্ষ্যচ্যুতের মতো 'মেঘপুরাণ' নিয়ে ফিরে এলেও ‘ডুবোজাহাজের ডানা’য় মোশতাকের গ্রন্থিত ৮টি সনেটে তার কাব্যশক্তি টের পাওয়া যায়। আপনারা সনেটগুলো পড়বেন।

 

কবি মোশতাক আহমদ জানান ,
( কবিতাভবন থেকে প্রকাশিত আমার কবিতার বই ‘ ডুবোজাহাজের ডানা’র পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানে কবি জিললুর রহমানের আলোচনা। ২১ জানুয়ারি ২০২০, বাতিঘর, ঢাকা। বইটি পাওয়া যাচ্ছে একুশের বইমেলায় বাতিঘরের স্টলে , স্টল নং ৪৪৩-৪৪৫)

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়