Ameen Qudir

Published:
2017-01-02 20:32:52 BdST

বড়ভাই মারা গেলেন


 

 

 

 

ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
___________________________

খবর পেলাম শেষরাতে। এসময় পুবের আকাশ লাল হয়। ধর্মমতে সময়টাকে সুবেহ সাদেক বলে।

মা ঘুমিয়ে আছেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই জাগবেন। নামাজ পড়বেন। নামাজের আগে বড়ছেলের মৃত্যু সংবাদ দেওয়া উচিৎ হবে না। নামাজে মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আমি বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে রইলাম। ভোরের অপেক্ষায়।

বড়ভাই মাহবুব হোসেন লিবিয়ায় থাকতেন। স্টিল মিল শ্রমিক। বাবার মৃত্যুর পর সমস্ত জমিজমা বন্ধক রেখে ভাইকে লিবিয়া পাঠানো হয়েছে। ছয় মাস হলো। বন্ধকী জমি ঘোরানো হয়নি। ঘোরানোর আর কোন সম্ভাবনা নেই।

মাহবুব হোসেন আমার একমাত্র ভাই। শোক সংবাদ শুনে আমার কাঁদা উচিৎ ছিল। কান্না না আসলেও জোর করে কাঁদা যেত। আমি কাঁদলাম না। ফোন কানে নিয়ে গলাটা আরেকটু মোটা করে বললাম,
-কখন মারা গেছে?

ফোনের অন্যপাশে লিবিয়ান বাংলাদেশ এ্যাম্বাসির কর্মকর্তা। গলায় সহানুভুতি আনার চেষ্টা করছে। পারছে না। কেন পারছে না বোঝা মুশকিল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অগনিত শ্রমিক কাজ করে। সপ্তাহে সপ্তাহে অতিরিক্ত গরমে হিটস্ট্রোকে শ্রমিক মারা যাচ্ছে। এ্যাম্বেসীর কর্মকর্তারা দেশের আত্মীয়-স্বজনকে জানাতে হিমশিম খাচ্ছে। হিমশিম খেতে খেতে তাদের আবেগ ভোঁতা হয়ে গেছে।
-আপনার ভাই এর বিষয়টা কি করতে চান?
-কিছু না। সরাসরি দেশে পাঠান।

এ্যাম্বাসির ভদ্রলোক ঢোক গিলছেন। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। লালাগুলো গলায় ধাক্কা খাচ্ছে। গলাকাটা মুরগীর মত ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে।
-আপনার ভাইকে পাঠানো সম্ভব নয়।
-কেন?

ভদ্রলোক আরেকবার ঘড়ঘড় করে গলা পরিষ্কার করলেন।
-আপনার ভাইকে আনার জন্য আমরা কফিন পাঠিয়েছিলাম। লাশ আসেনি।
-কেন আসেনি?
-লাশ নেই।
-লাশ নেই মানে কি?
-লাশ আগুনে পুড়ে গেছে। স্টিল মিলে কাজ করত। প্রোপার সেফটি ছিল। তবুও বেল্ট খুলে হিটারের মধ্যে পড়ে গেছে। দেরি হয়েছিল। লাভ হয়নি। গলে গেছে।

আমার গলার ভেতর দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। দলা পাকানো ঠিক হচ্ছে না। একমাত্র বড় ভাই এর মৃত্যু সংবাদ আরো সহজভাবে নিতে হবে। পারছি না। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি মাহবুব ভাই উপর থেকে টুপ করে জ্বলন্ত চুলায় পড়ে গেল। চুলার গলন্ত স্টিলের মধ্যে গলে গেল। কঠিন দৃশ্য।
-মনজুর সাহেব, এখন কি করবেন?
-কিছু করব না। কফিন ফিরত এসেছে?
-জ্বি। মিল থেকে ফিরত পাঠিয়েছে।
-কফিনটা পাঠিয়ে দিন।

ভদ্রলোক আরেকবার ঢোক গিললেন। আগের চাইতে বেশি জোরে ঘড়ঘড় শব্দ হল। মনে হচ্ছে কাটারি দিয়ে কেউ তার গলা কেটে ফেলছে।
-খালি কফিন পাঠিয়ে দিব?
-জ্বি পাঠিয়ে দিন।
-খালি কফিন দিয়ে কি হবে?
-কিছু হবে না। তবু পাঠিয়ে দিন।
-মিস্টার মনজুর?
-বলুন।
-খালি কফিন দিয়ে কি হবে?
-মাকে দেখাতে হবে না? ভদ্রমহিলা সন্তান জন্ম দিয়েছেন। মৃত সন্তানের কফিনের গায়ে হাত বোলানোর অধিকার তার আছে। এটা ক্ষুন্ন করা ঠিক হবে কি?
-জ্বি না। ঠিক হবে না।
-তাহলে পাঠিয়ে দিন।
-কিন্তু উনি তো বুঝে ফেলবেন কফিনে কেউ নেই।
-সে দায়িত্ব আমার। আপনি কফিন পাঠান দ্রুত।

ভদ্রলোক আরেকবার ঘড়ঘড় করলেন। আগের থেকেও বেশিই শব্দ হল। লিবিয়ার মতো বাঙ্গালী-শ্রমিক বহুল দেশে এ্যাম্বেসীতে এত কর্কশ গলার মানুষকে দায়িত্ব দেবার অর্থ খুজে পাচ্ছি না। এসব লোক মোটামুটি একবারই শ্রমিকদের পরিবারে ফোন করে। কোন বাংলাদেশি শ্রমিককে লিবিয়ান সরকার জেলে দিলে অথবা মৃত্যুতে। দেশে বসে দরিদ্র আত্মীয়দের জন্য এরকম কঠিন সংবাদ চড়া গলায় হজম করা মুশকিল। একজন সুরেলা গলার মেয়েকে বসে রাখা যেত। মৃত্যু সংবাদ দেবার সময় মেয়েটা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলবে,
-ও মনজুরগো, তোমার ভাই নাই গো। মরে গেছে।

এরকম হলে কিছুটা শান্তি লাগত। চার হাজার কিলোমিটার দূরে অপরিচিত কেউ একজন অন্যের দুঃখে কাঁদছে---চমৎকার দৃশ্য। একজন রেডিও জকিকে ফোনের দায়িত্ব দিলে কেমন হত বোঝা যাচ্ছে না। আরজে ফোন করবে। ফোন করেই চিৎকার করে বলবে,
-ইয়ো ডুডস! হোয়াচ্চাপ?
-জ্বি! ভালো আছি।
-ইয়োর ব্র্যাদার গন ম্যান...গন। চুলার মধ্যে টুপ করে পড়ে বার্ন হইচে। কুল ম্যান। কুল।

ফোন কাটার পর কিছুতা স্বস্তি লাগছে। পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর মতো কঠিন ব্যাপার নিয়ে কথা বলা সহজ নয়। গা ঘেমে গেছে। বারান্দায় দাড়ানো যায়। ইজি চেয়ার ফেলানো আছে। একসময় বাবা বসত। অনেকদিন থেকে কেউ বসেনা। বাবার মৃত্যুর পর মাহবুব ভাইকে মাঝেমধ্যে বসতে দেখতাম। অন্ধকারে ভুলে মাঝেমাঝে মনে হত বাবা বসে আছে।

অল্প বাতাস দিচ্ছে।
শীতল বাতাস। আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে বৃষ্টি হলে ভালো হত। মুর্দা বাড়িতে বৃষ্টি হলে ধরে নেওয়া হয় মুর্দা ব্যক্তি নেককার বান্দা। বান্দার সাথে প্রকৃতিও কান্নাকাটি করে। বাবার মারা যাবার দিনেও বৃষ্টি হয়েছিল। টানা ঝুম বৃষ্টি। লাশ দাফন করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। কবরস্থানে গিয়ে দেখা গেল কবর পানিতে ভরে গেছে। মাহবুব ভাই আমাকে সহ বালতি নিয়ে নেমে গেলেন কবরে। পানি সেচে ফেলা হল। আমি উঠলাম। মাহবুব ভাই কবর থেকে আর উঠতে চাচ্ছিলেন না। তার ধারণা কবর খুব শীতল। শীতল আবহাওয়ায় বাবা কষ্ট পাবেন। বাবার অ্যাজমা ছিল। শীত আসলেই বাবার শ্বাসকষ্ট হত।


কলপাড়ে বালতি টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মা ওযু করছেন। এত তাড়াতাড়ি সাধারনত ওঠেন না। বালতি থেকে পানি ঢালছেন। মোটামুটি নিঃশব্দে। এত নিঃশব্দে তিনি কোনদিন ওযু করেন নি। কিছু কি আঁচ করতে পেরেছেন?

এই মুহুর্তে মাকে মৃত্যুর খবর দেওয়া উচিৎ কিনা বোঝা যাচ্ছে না। শোকের সংবাদ দুইভাবে দেওয়া যায়। হুট করে কাছে গিয়ে বলতে হবে,'আপনার বড় ছেলে মারা গেছে।' এটা সুবিধার হবে না। মানুষের নার্ভে বড়সড় দুঃসংবাদ গ্রহন করতে অসুবিধা হয়। সার্কিট ফিউজের মত বড়সড় মানসিক ধাক্কা পেতে পারে। দুঃসংবাদ ধীরে ধীরে ধীরে দিতে হবে। রয়ে রয়ে সয়ে সয়ে।

সুর্য উঠছে।
রাত জাগার জন্য ঘুম পাচ্ছে। ঘুমানো যেতে পারে। শোক সংবাদ দেরি করে দিলেও হবে। লিবিয়া থেকে কফিন আসতে আসতে এক সপ্তাহ লেগে যাবে। ফাঁকা কফিন। আগুঢ় সংবাদ দিয়ে একজন জন্মদাত্রীকে এক সপ্তাহ ধরে কষ্ট দেওয়া উচিৎ হবে না। কফিন আসার দিনে বললেই হবে। মা হয়ত কফিনের উপরে হাত বোলাবেন আর কাঁদবেন। কফিন খোলার দরকার পড়বে না। মা অনেকদিন থেকে অন্ধ। কিছুই দেখতে পান না। চাইলেও মৃত ছেলের মুখ দেখতে পাবেন না। সমস্যা হচ্ছে শেষ বিদায়ের সময় ছেলের গা ছুয়ে কাঁদতে চাইবেন। ত্রিশ বছর ধরে বড় করা প্রথম সন্তানের স্পর্শ না পেয়ে যেতে দিবেন এমন ভাবার সুযোগ নেই। এই সমস্যার কোন সমাধান নেই।

প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে।
আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি। রংপুরে এই একটা চমৎকার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। দিন রাত খোজ নেই, ভোর হলেই বৃষ্টি শুরু হয়!
.
.
.

পাদটীকাঃ লেখাটি পুরনো । দীর্ঘদিন আগে এক গভীর রাতে আমার ঘুম হচ্ছিলনা। মিডাজোলাম খেয়েও আমার দুচোখ ক্যামেরার মত খোলা। আমি শুয়েশুয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম, টিউবয়েল চাপার শব্দ। কেউ একজন টিউবয়েল চেপেচপে বালতিতে পানি নিচ্ছে। বালতি টানার শব্দ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে একজন বৃদ্ধা ওযু করছেন। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য। অথচ আমি যেস্থানে ছিলাম, সেখানে কোন টিউবয়েল নেই। বড় শহর। শুয়ে আছি দশতলার উপর। পুরোটা।ছিল অডিটরী হ্যালুসিনেশন।

ঘুমের চেষ্টা করার চাইতে 'বেগার খাটা' ভালো। আমি প্যাড খুলে দীর্ঘদিন পর কলম দিয়ে লিখলাম।
আমার এখনো সেই মুহুর্তের কথা মনে পড়ে। বড় আনন্দময় মুহুর্ত। যুক্তিযুক্ত কারণেই লেখাটির প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব আছে।

আমি দীর্ঘদিন পর(প্রায় দেড় বছর) পর আবার আনন্দ নিয়ে লেখালেখি করছি। যত নিম্নমানেরই লিখিনা কেন, আনন্দ নিয়ে লিখছি।
আপনারা দোয়া করবেন, এই আনন্দ যেন হারিয়ে না যায়।


_______________________________

 

লেখক ডা. রাজীব হোসাইন সরকার । অনন্য কথাশিল্পী। চিকিৎসক , রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়