Ameen Qudir

Published:
2018-07-19 18:23:00 BdST

মৃত্যু, ক্যান্সার, হুমায়ূন আহমেদ


 


ডা.আমেনা বেগম ছোটন
_________________________

হুমায়ূন আহমেদ মারা যেদিন মারা যান, তারপর দিন ছিল আমার এএমসি পার্ট ওয়ান পরীক্ষা। রাতে তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম, সকালে পরীক্ষা দিতে যাব। আবির ঘুম থেকে উঠে আমার দিকে ভীত, বিব্রত চোখে তাকিয়ে রইল, আমতা আমতা করে বল্ল, খবর জান?

-- কি খবর?

-- হুমায়ূন আহমেদ ত আর নাই।

-- জানি ত, বেশ কদিন ধরেই ত এ অবস্থা। আজ কনফার্ম হল।

আমরা দুজনেই দুজন কে দেখে অবাক। আবির অবাক, আমার নিরুত্তাপ ভাবভঙ্গিতে। আমার হুমায়ূন প্রীতি তার খুব ভাল জানা আছে, একেকটা বই বিশ ত্রিশ বার করে পড়া। যেকোন জায়গায় হুমায়ুন আহমেদের বই আমাকে পড়তে সে দেখেছে। একটু আলো হলেই চলবে, সে যে জায়গাই হোক । সেই আমি, তার মৃত্যু এত স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছি?

আমি অবাক কারণ, আর যাই হোক, আবির বই পড়ুয়া না। হুমায়ূন লাভার ও না। যাকে সেরকম চিনে না, জানে না তার মৃত্যুতে অত বিচলিত কেন হচ্ছে? স্রেফ নামটার ই এত ক্ষমতা? কি আশ্চর্য। এমন না, হুমায়ূন ব্যক্তিগত জীবনে অসাধারণ কেউ। দুই বিয়ে করেছেন, সেরকম ধর্মপ্রাণ কেউ ও নয়। কেন অত ভালবাসা?

আমি পরীক্ষা দিয়ে এসে শেষকৃত্য সংক্রান্ত নাটক দেখতে লাগলাম। কিছুদিন পর দেশে এলাম, হুমায়ুনের পাঠক নন, এমন সব নিতান্ত সাধারণ লোকজনকে আন্তরিক ভাবে হাহাকার করতে দেখলাম। এর ব্যাখ্যা আমি এখনো পাই নি। সম্ভবত, হুমায়ুনের জনপ্রিয়তার ভাগ মানুষজন নিজের মধ্যে বহন করত, সত্যিই কাজের মহিলা, রিক্সাওয়ালা সবাই তার নাম জানত । এরকম কান্ড আর কোন লেখক ঘটিয়েছেন কি না আমার জানা নেই।

আমার নিস্পৃহতাও হয়ত অবাক করার মত। আমি কেন কেউ মারা গেলে এত নির্বিকার থাকি? পরে ভেবেচিন্তে দেখেছি, আমার ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে আমার বাবা, দুই চাচা, দাদা মারা যান। সে কারণেই হয়ত আমার রেজিস্টেন্স ডেভেলপ করেছে। তবে অস্বাভাবিক মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি না। সে বছর নভেম্বরে আমার বান্ধবী ডাঃ সাজিয়া আফরিন খুন হয়। আমার প্রায় মাথাখারাপের মত হয়ে যায়। মাথা এখনো ঠিক হয় নি, প্রায়ই ডাক্তার সংক্রান্ত বিষয়ে আমাকে ওভার রিয়েক্ট করতে দেখা যায়। ফেসবুকের জিগরি দোস্ত রা জানি দুশমন হয়ে যায়।

আমি প্রায়ই মৃত্যু নিয়ে ভাবি। মৃত্যু ফিলোসফি বলা যেতে পারে, এটি মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। আজকাল ভাবি চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতি মৃত্যুকে কঠিন করে দিয়েছে। শান্তিতে মরার বদলে নানারকম টেনশন, অতৃপ্তি নিয়ে মরতে হয়।

হুমায়ুন আহমেদের বাওয়েল ক্যান্সার ধরা পরে স্টেজ ফোরে ( তার লেখা কোন এক কলাম থেকে জানা, সেদিন থেকেই আসলে আমি মৃত্যুসংবাদের জন্য প্রস্তুত) । লাস্ট স্টেজ, কিউর দূরে থাক, প্যালিয়েটিভ কেয়ারের সুযোগ ও সীমিত। দৃঢ়চেতা মানুষ হলে শান্তিতে প্যালিয়েটিভ সহকারে বাচতে পারতেন। আগের দিনের গল্প উপন্যাসের মত বাকেট লিস্ট ফুলফিল করতে করতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন। ৬ মাস সময়ের পর প্রতিটি দিন একটা বোনাস সহকারে আসত। আজ ও বেচে আছি, এই আনন্দে ঘুম ভাংত, ঘুমানোর আগে আগামী দিন বেচে থাকার সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া যেত।

তা না, ভাল হতেও পারি, বিনা চিকিৎসায় কেন মরব, এসব ভেবে দুরদেশে হাসপাতালে অপারেশন হল, ইনফেকশন সারাদেহে ছড়িয়ে ছয়মাস আগেই দিন ফুরিয়ে গেল।

গত কয়েকবছরে, ফেসবুকে ক্যান্সার রোগিকে বাচাতে এগিয়ে আসুন, লেখা দেখি। শেয়ার দিই, বন্ধুবান্ধবদের কাছে হাত পাতি। চিকিৎসা শুরু হয়, এরপর রোগি মারা যায়। পরিবার সর্বশান্ত, শোকগ্রস্ত। ট্রিটমেন্ট প্রসিডিউর মুল রোগযন্ত্রণা থেকে বেশি কষ্টসাধ্য। মাঝেমধ্যে ট্রিটমেন্ট ফেইলিউরে রোগি মারা যায়। রাফা মারা যাবার পর মনে হল, ট্রিটমেন্ট না করালে মেয়েটা আরো কয়েক মাস বাচত।

তাহলে? ট্রিটমেন্ট করাবে না? অবশ্যই করাবেন, কারণ ক্যান্সার সারভাইভার ও আছেন প্রচুর। সেই সৌভাগ্যবান দের একজন হতে গিয়ে, বাকি আয়ুটুকু নিয়ে জুয়া খেলতে হয়।

সারমর্ম - আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি নাই। রোগিরা, তাদের আত্নীয়রা এধরণের সিচুয়েশন কিভাবে ডিল করে আমার জানা নাই। হাবিজাবি মাথায় ঘুরে, লিখে ফেললাম।
_______________________________

ডা.আমেনা বেগম ছোটন । সুলেখক। Somc
2002-03
লেখা প্রসঙ্গে: © Amena Begum Choton

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়