SAHA ANTAR

Published:
2022-06-02 20:52:46 BdST

এক মেধাবী তরুণের অকাল মৃত্যু, কথিত 'বিসিএস উন্মাদনা' এবং মানসিক রোগ নিয়ে অপপ্রচার, কুপ্রচার


ডা. সুলতানা আলগিন,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও সাইকোথেরাপি উইংএর প্রধান এবং কনসালটেন্ট , ওসিডি ক্লিনিক ও জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক

 

 


ডেস্ক
____________________________

একজন মেধাবী তরুণের অকাল মৃত্যু নিয়ে অনলাইন ফোরামে এখন বিভিন্নমুখী আলোচনা চলছে। অনেকের প্রশ্ন , এই অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী কে! মেইনস্ট্রিম মানে মূল ধারার প্রিন্ট মিডিয়া এই অকাল মৃত্যুকে " বিসিএস উন্মাদনার শিকার" বলে উল্লেখ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজ্ঞ, মুর্খ ও অপরিনামদর্শী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। বস্তুত: "বিসিএস উন্মাদনার শিকার" বলা এধরণের টিজিং হয়ে গেছে। মিডিয়া কর্মীরা তা অনুধাবণ করতে পারে নি।
অত্যন্ত আনন্দর বিষয় যে, বিভিন্ন ধরণের মানসিক রোগের শিকার হয়ে সুচিকিৎসা নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ ও কর্মশীল জীবন যাপনকারীরা এখন এসব বিষয়ে সাহস করে কথা বলছেন। লিখছেন নিজ অভিজ্ঞতা। সময় পাল্টাচ্ছে । মানসিক রোগ এখন নিরাময়যোগ্য সাধারণ রোগ। এটা কোন হাসিঠাট্টার বিষয় নয়। সংবাদকর্মীদেরও আগের জগদ্দল ধারণা পাল্টাতে হবে। অকাল প্রয়াতর শুভানূধ্যায়ীরা কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, কোন কোন ডাক্তার নাকি রোগীকে বলেছে, " এসব মেডিসিন খেলে তো আপনি পাগল হয়ে যাবেন। " এটা শুনে সে ঘুমের ঔষধ খাওয়া বাদ দেয়ার চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে ইনসোমনিয়া চরম আকার ধারণ করে..."।
কোন কোন ডাক্তার নাকি রোগীকে বলেছে, " পাগলের ওষুধ না খেয়ে মধ্যরাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি করতে । তাহলে বেশি বেশি ঘুম হবে নিয়মিত। "
অনলাইন ফোরামে এসব অভিযোগ ও বক্তব্য চলছে। শেষে রোগীকে কলকাতা দিল্লি বেঙ্গালুরুতে নিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোন পরামর্শে কাজ হয় নি। সংশ্লিষ্ট রোগী তার আগেই ", তার আগেই ও জীবন থেকে নিজেকে ছুটি দিয়ে দেয়।"

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও সাইকোথেরাপি উইংএর প্রধান এবং
কনসালটেন্ট , ওসিডি ক্লিনিক ও জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগিন বলেন ,
একজন মনোরোগ চিকিৎসক হিসেবে এধরণের কাহিনি ভীষণ ভাবে মর্মাহত করে। আমি প্রয়াত
মেহেদীর জন্য গভীর শোক প্রকাশ করছি। তার এই অকাল মৃত্যুকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মোকাবেলা করা যেত এবং তাকে বিজ্ঞানসম্মত মনোরোগ চিকিৎসার মাধ্যমে ও প্রয়োজনীয় ওষুধ ও নিয়মিত ফলোআপের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা যেত।
মানসিক রোগ নিয়ে নানা কুসংস্কার এখনও বাংলাদেশসহ অনুন্নত দেশগুলোতে বিদ্যমান। রোগীদের ওঝা মোল্লা মৌলভী , তান্ত্রিকদের কাছে নেওয়া হয়। সেখানেই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
কোন কোন ডাক্তার নাকি রোগীকে বলেছে, " এসব মেডিসিন খেলে তো আপনি পাগল হয়ে যাবেন।" "পাগলের ওষুধ না খেয়ে মধ্যরাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি করতে । তাহলে বেশি বেশি ঘুম হবে নিয়মিত। "

এটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কেননা, প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়েই বিজ্ঞান সম্মতভাবে মানসিক রোগীদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়।
পাগলের ওষুধ বলে কোন টোটকা নেই। বাংলাদেশে সহ সারা বিশ্বেই মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত নানা ওষুধ পাওয়া যায়। ডাক্তারি পরামর্শ নিয়ে সেসব সেবন করেই মানসিক রোগীরা ভাল আছেন। এবং থাকবেন।

সমাজে নানা কুসংস্কার থাকবে। নানা অপপ্রচার থাকবেই। সেসব মোকাবেলা করেই লাখো মানসিক রোগীকে সুস্থ স্বাভাবিক কর্মময় জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা।
সুতরাং অপপ্রচার, কুপ্রচার, অন্ধ বিশ্বাস টোটকায় কান দেবেন না। মানসিক রোগীদের সঠিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসায় সুস্থ হতে দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল মেডিকেল কলেজে মনোরোগ বিভাগ রয়েছে। সেখানে নিয়মিত চিকিৎসা নিন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা যে ওষুধ দেন , তা সেবন করুন। ফলোআপ করুন। অবশ্যই সুস্থ থাকবেন । সুস্থ ও কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী রোগীরা তার প্রমাণ। আর ১০টা রোগের মতই মানসিক রোগ একটা রোগ। এ নিয়ে কোন ধরণের মুর্খ অপপ্রচারে কান দেবেন না।

 

প্রয়াতের একজন স্বজন এক লেখায় পরম দু:খ নিয়ে লিখেছেন,
·
মেহেদীর জানাজা পড়ে আমরা ফিরতেছি। এর মধ্যে ইনবক্সে কয়েকজন কিছু অনলাইন নিউজ লিংক দিলো যে মেহেদী নাকি বিসিএস উন্মাদনার শিকার।
সাংবাদিক ভাইকে বলি আপনি ওর সম্পর্কে কতটুকু জানেন? কিসের ভিত্তিতে আপনারা এইসব তথাকথিত অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেন?
মেহেদী ফিন্যান্স ১৯ ব্যাচের অতি পরিচিত হাস্যোজ্জ্বল মুখ। খুবই স্ট্রং মেন্টালিটির ছেলে ছিলো ও। সবাই তাদের দুঃখের গল্পগুলো ওর সাথে শেয়ার করতো। বাংলাদেশের জব মার্কেটের প্রথম শ্রেণির অনেক আকর্ষনীয় চাকুরী ও পেয়েছে। কিছুদিন পর দুর্নীতি দমন কমিশন এর সহকারী পরিচালক (AD) পদের রেজাল্ট দিবে। সেখানেও ওর নাম আছে (ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়)।
২ বছর বয়সে ও তার বাবাকে হারায়। প্রচন্ড স্ট্রাগলিং ফ্যামিলি থেকে উঠে আসলেও নটরডেম কলেজ, ঢাবি ফিন্যান্স থেকে শুরু করে জব মার্কেট- কোনটাতেই সে কখনো পিছিয়ে থাকেনি। এক বছর আগে জব এ ঢুকার ঠিক আগেই ওর আম্মু মারা যায়। মূলত তখন থেকেই ওর ভেংগে পড়া শুরু হয়। ওর মনের মধ্যে একটা জিনিস দানা বাঁধে যে আমি আমার ফ্যামিলির জন্য কিছুই করতে পারলাম না..
ইনসোমনিয়া এক ভয়াবহ ব্যাধি। দেখা হইলেই বলতো ৩/৪ রাত এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। শেষ দিকে বলতো ৭/৮ রাত ও ঘুমাতে পারেনি। ওর বন্ধুবান্ধব ওকে যথেষ্ট সাপোর্ট করেছিলো, কর্মস্থল BSEC এর কলিগ/স্যার রাও ওর প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন।
বাংলাদেশের সব বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছিলো ও। কেউ স্পেসিফিক কোন কিছু আইডেন্টিফাই করতে পারেনি। শুরুর ডাক্তার খুবই হাই পাওয়ার স্লিপিং ডোজ দিয়েছেন এর জন্য কম পাওয়ারফুল এবং শেষ দিকে বেশি পাওয়ার ঘুমের ওষুধ খেয়েও ও অনেকবার ঘুমাতে পারেনি। আবার কোন ডাক্তার বলেছে এসব মেডিসিন খেলে তো আপনি পাগল হয়ে যাবেন, এটা শুনে সে ঘুমের ঔষধ খাওয়া বাদ দেয়ার চেস্টা করে এবং একপর্যায়ে ইনসোমনিয়া চরম আকার ধারণ করে...
লাস্ট এক বছরে চাকুরী এর চেয়ে জীবনটাই ওর কাছে মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ও বলতো আগে বেঁচে থাকি, তারপরই না বিসিএস। বিসিএস ক্রেজ দূরে থাক ও পড়ালেখাই করতো না...
ওকে ইন্ডিয়া নেয়ার প্রসিডিওর শুরু হয় মাত্র, তার আগেই ও জীবন থেকে নিজেকে ছুটি দিয়ে দেয়। মূলত শেষদিন পর্যন্ত ও চেষ্টা করেছে বেঁচে থাকার। কিন্তু কতক্ষন না ঘুমিয়ে থাকা যায়? তারপর.....
তাই মেহেদীর মৃত্যু নিয়ে মুখরোচক গল্প না বানানোর অনুরোধ করছি। জীবিত অবস্থায় ও ঘুমাতে পারেনি, কবরে যেন ও শান্তিতে ঘুমাতে পারে। "
মেন্টাল ব্রেকডাউন কাটিয়ে ওঠা একজন সম্পূর্ণ জীবন যাপন করা ব্যাক্তি নিজ ওয়ালে নিজেই লিখেছেন,

মেন্টাল ব্রেকডাউন যাদের হয়,একমাত্র তারাই বুঝে এটার কষ্ট।আমারও হইসিলো।বাবা,মা,ভাই যথেষ্ট সাপোর্ট দিসে। অনেক ভালো আছি এখন।
কাউকে পাগল ট্যাগ দেয়া খুব সহজ।জাস্ট একবার ঐ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে ঘুরে আসেন।

 

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়