Dr. SAYEED ENAM

Published:
2021-01-26 22:09:43 BdST

কিছু মৃত্যুর কথা ভোলা যায়না


ডা সাঈদ এনাম

-----------------------

কিছু মৃত্যুর কথা ভোলা যায়না...
কিছু মৃত্যুর কথা ভুলা যায় না। একেবারে জীবন্ত ছবি হয়ে চোখে ভাসে প্রিয়জনের মুখ খানি।

সেলিম ভাই (ছদ্ম নাম) আমার সাথে প্রথম দেখার পর থেকেই কেমন জানি বন্ধুর মতো হয়ে উঠলেন। আমি তার আম্মার চিকিৎসক ছিলাম। তিনি বিদেশে থাকতেন ছুটিতে এসেই তার আম্মার সাথে আমার চেম্বারে এলেন। হেসে মুখে বললেন, "আম্মা এতো করে আপনার কথা বলতেন সেই বিদেশ থাকতেই আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছেটা জাগে। তাই দেশে এসেই চলে আসলাম। কালই এসেছি"।

অল্প সময়ে অনেক মজার আলাপ করলেন সেদিন। আমার বেশ পছন্দ হয় সেলিম ভাইকে। বয়সে দুয়েক বছরের বড় হবেন। কথাবার্তা, আচরণে ভীষণ স্মার্ট, সৌখিন। বিয়ে করেন নি। হয়তো এবার করবেন। সে রকম ইংগিত ও পেলাম আলাপে। যাবার সময় ছোট করে বললেন, "সাঈদ ভাই আপনি আম্মার চিকিৎসক। আম্মা আপনাকে খুব পছন্দ করেন। কিছু মনে করবেন না, সামান্য উপহার। আর আমার প্রেশার মাঝেমধ্যে হাই হয়ে যায়। একদিন আপনাকে দেখাবো"।

আমি তড়িৎ বললাম, "একদিন কেনো প্রেশার হাই, আজই দেখবো আপনাকে"।
সেলিম ভাই রাজী হলেন না, "বললেন না সাঈদ ভাই। আজ আমি আপনার সাথে কেবল দেখা করতে এসছি। আজ না। আমি কাল বা পরশু আসবো"।

আমার জন্যে একটা টাই ও একটা শার্ট এনেছিলেন সেটা দিয়ে বললেন, "আসি, ভালো থাকুন।

তার চোখ আনন্দে চক চক করছিলো। সম্ভবত সেলিম ভাইয়ের আম্মা আমার ব্যাপারে হয়তো ভালো কিছু বলেছেন। উনার আম্মা চেম্বারে আসলে আমি খুব যত্ন নিয়ে দেখতাম। তাই হয়তো।

সেলিম ভাই, ঠিক দুদিন পরে আসলেন। আসার আগে ফোন দিলেন।

আমি তার প্রেশার মেপে দেখলাম। খানিকটা অবাক হলাম, তার প্রেশার ২০০ বাই ১১০। জিগ্যেস করলাম, "আপনি কোন ঔষধ বা ডাক্তার দেখান নি?" তিনি বললেন, "না। তবে জানি আমার প্রেশারটা মাঝেমধ্যে বেশী হয়। ভেবেছি দেশে এসেই একসাথে ডাক্তার দেখাবো তাই আর ওভাবে চিকিৎসা নেয়া হয়নি"।

সেলিম ভাইকে এন্টি হাইপারটেনসিভ কভারেজ দিয়ে দ্রুত বললাম কার্ডিওলজিস্ট দেখাতে। বললাম, "ভালো হয় আপনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে চলে আসলে। আমিও থাকবো।"

কয়েকদিন চলে যায় সেলিম ভাইয়ের আর কোন খবর পাইনা। মনে হয়েছিলো হয়তো বিয়েশাদি এসবে ব্যাস্ত হয়েছেন। ছোট বোনটার বিয়ে দিবেন সেটাও বলছিলেন সেদিন।

কিন্তু আমি একটু চিন্তিত থাকি তার জন্যে।

এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ মেডিকেল কলেজের আউট ডোরে আমার চেম্বারে সেলিম ভাই উপস্থিত। "সাঈদ ভাই আপনার কথামতো আজ কার্ডিওলজি তে দেখালাম। সারাদিনই চলে গেলো। ডাক্তাররা খুব ভালো। সত্যিই আমাদের দেশের ডাক্তাররা ভীষণ আন্তরিক হয়ে কথা বলেন। বিদেশে এমনটা হয়। তারা আপনার প্রেস্ক্রিপশনও দেখলেন। যত্ন নিয়ে সকল পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন। তবে বললেন যেনো দ্রুত ঢাকা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চলে যাই।"

আমি বললাম, উদ্বেগের সাথে বললাম, "দেখি রিপোর্ট গুলো।"
তিনি বললেন, "অহ, দুঃখিত সাঈদ ভাই রিপোর্ট গুলো ড্রাইভার সাহেবের হাতে ছিলো। উনিতো গাড়িতে। সমস্যা নাই, রিপোর্ট ভালো, আপনি চিন্তা করবেন না। বিকেলেতো আসছি আপনার চেম্বারে, তখন সব আলাপ হবে।" শক্ত করে হাত চেপে ধরে হাসি মুখে বিদায় নিলেন।

আমি সেলিম ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। আমার শংকা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো। কিন্তু সেলিম ভাই আর আসেন না। একদিন, দুইদিন, তিনদিন। না সেলিম ভাই আর এলেনই না।

সপ্তাহ খানেক পর সেলিম ভাইয়ের আম্মা এলেন। তার মুখ বিমর্ষ, মলীন। চোখ মুচছেন আচল দিয়ে। আমি বললাম, "খালা সেলিম ভাই কই?"

তিনি কেঁদে ফেললেন। "বাবা আমার সেলিম নাই। আপনি তার রোগ ধরেছিলেন। তাকে ঢাকা হার্টের হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তাররা। সে যেতে দেরী করছিলো। পরে আমিই জোর করে পাঠাই। কিন্তু হার্টের হাসপাতালে গিয়ে বিছানায় শোবার পর পরই তার সেই বুকে ব্যাথাটা আবার উঠে। বার কয়েক বমি হয়। অজ্ঞান হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেন ডাক্তাররা। কিন্তু সে আর আসেনি"

সেলিম ভাই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন সে অনেক বছর আগে। কিন্তু তার চেহারাটা আজো ভেসে উঠে। কানে বাজে, "সমস্যা নাই, রিপোর্ট ভালো। আপনি চিন্তা করবেন না। আর বিকেলতো আসছিই আপনার চেম্বারে। তখন সব আলাপ হবে।"

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়