ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-05-30 15:49:20 BdST

গণস্বাস্থ্য:হোন্ডা শিখতে লেডি ডাক্তারের হাত ভাঙা,আই হেইট টু বি এ ক্লিনিশিয়ান ও অন্য কাহিনি


 

কবি, চিকিৎসক মোশতাক আহমদ লিখেছেন গনস্বাস্থ্য স্মৃতি। এ লেখায় ডা. জাফরউল্লাহ সহ নানা চরিত্র চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডের মত দেদীপ্যমান।

মোশতাক আহমদ
কবি, চিকিৎসক
_____________________________


১০ জুলাই ১৯৯৬ তে প্রশিক্ষণার্থী নবীন চিকিৎসক হিসেবে সাভারের নয়ারহাটের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলাম। ওখানে ঢোকা মাত্র জুলাই মাসটা হয়ে গেল আষাঢ় মাস। ডাক্তারদের প্রেস্ক্রিপশন বাংলায়, ক্যালেন্ডার বাংলা। আমার ছোট ভাই আমাকে ডাক্তারদের টিনশেড হোস্টেলে পৌঁছে দিল, আমি তখন ম্যারেড হয়েও ব্যাচেলর হিসেবে থাকব। জায়গাগুলোর আলাদা আলাদা নাম ছিল - লাল ট্যাক, কাঁঠাল ট্যাক ইত্যাদি। আরণ্যক পরিবেশ। আমাকে ডাঃ নজরুল খুব সাহায্য করল সবকিছু গুছিয়ে নিতে। গণস্বাস্থ্য থেকে পালিয়ে যাওয়া অসংখ্য ডাক্তারের অন্যতম ছিল নজরুল। সে পালিয়ে গিয়েছিল কুমুদিনী হাসপাতালে।

আমি ন্যস্ত হলাম প্রশিক্ষণ সমন্বকারী তারিক ভাইয়ের বিশ্বস্ত হাতে, হাসপাতাল চক্কর দিয়ে দেখালেন, আলাপ করিয়ে দিলেন গণস্বাস্থ্যের দুই ডাইনোসর কাশেম ভাই আর মোরশেদ ভাইয়ের সাথে; দুজনেই চৌধুরী। দুপুরে ঘর্মাক্ত কলেবরে রিসেপসন এরিয়াতে দেখা হল ইকবাল ভাইয়ের সাথে, বলছিলেন কোনো একটা ময়নাতদন্তের কাজে দূরের গ্রাম থেকে ফিরলেন।
প্রথম দুই সপ্তাহ প্রধান চাকুরি হল দিনের বেলা আউটডোর, বিকেলে মোটর সাইকেল চালানো শেখা আর সন্ধ্যায় লাইব্রেরি, সেমিনার ইত্যদিতে হাজির থাকা (লাইব্রেরিতে ইউটোপিয়া বইটা ছিল) সপ্তাহে এক বা দুদিন মৌখিক ময়না তদন্তে যাওয়া। আউটডোরে/ সাব সেন্টারে রুগী দেখা বা ইনডোর ডিউটির অনুমতি মিলবে সংগত ওষুধের ব্যবহার শিখে বাংলায় ব্যবস্থাপত্র লিখতে পারলে। আমার শ্লাঘা ছিল কলেজ লাইফে তো মোটর সাইকেল শিখেছিলাম, কিন্তু আলাউদ্দীন, নজরুলের সাথে নিরিবিলি হাউজিং এর মাঠে চালাতে গিয়ে দেখি অত কনফিডেন্স পাই না। আমার মেডিকেল কলেজের বান্ধবী আলগিন আর নাসরিনকে পেলাম; ওদের ট্রেনিং শেষ কিন্তু মোটর সাইকেলটা সরগর না হওয়াতে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে পোস্টিং বিলম্বিত হচ্ছে। আমিও নগর হাসপাতালের জন্যই নিযুক্ত হয়েছি।

কয়েকদিন পর ডাইনিং এর বিখ্যাত লাবড়া দিয়ে ভাত খেয়ে হোস্টেলে ফিরেছি। অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারী কর্মকর্তা, যিনি এখানে যোগ দিয়েছেন পি আর ও হিসেবে, বললেন- বনে বাঘ এসেছে! অর্থ্যাৎ স্বাস্থ্যকর্মীদের ' বড় ভাই' জাফরুল্লাহ চৌধুরী ক্যাম্পাসে এসেছেন! দু' একদিন থাকবেন হয়ত। তাঁকে নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক গল্পকাহিনি অনেক কিংবদন্তি শোনা হয়ে গেছে। গল্পগুলো থেকে আমার জন্য শিক্ষনীয় ছিল এই ' বড় ভাই' এর কাছ থেকে দূরে এবং অচেনা থেকেই সময়টা পার করে দিতে পারাটা নিরাপদ। ডাক্তাররা তাঁর মন মতো হতে পারেন না, তাঁর মর্জি মতো কাজ করতে পারেন না। তিনি যে কি চান কে জানে! আমি তো এসেছি চাকুরি করতে, বিপ্লব করতে নয়। যদিও গণস্বাস্থ্য পত্রিকা আর গণপ্রকাশণীর যেখানে ডাক্তার নাই বা ঝগড়াপুর পড়েছি ইন্টারমিডিয়েট লাইফেই।

পরদিন বিকেলে মোটর সাইকেল গ্যারেজে গেছি। আতাউর নামের এক স্বাস্থ্যকর্মী আমার জন্য কালো রংয়ের বাজাজটা বের করে দিল। এবার আমি অশ্বারূঢ় হব নাকি ঠেলতে ঠেলতে মাঠে নিয়ে যাব ভাবছি। দূর থেকে বড় ভাই জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঘটনা লক্ষ্য করে আমাকে ডাকলেন, পরিচয় নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, মোটর সাইকেল পারি কিনা৷ বললাম, মোটামুটি। সাথে সাথে চার দিকে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন, একজন ডাক্তার ছেলে হয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে এত হিমশিম খেলে চলবে? সাথে সাথে গ্রামীণ স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী কাদের ভাইকে ডেকে নির্দেশ দিলেন যতদিন মোটর সাইকেল রপ্ত না হবে ততদিন আমার আর আমার বান্ধবীদেরও সব ডিউটি বন্ধ; সারাদিন মোটর সাইকেল চালাতে হবে!

জবরদস্তি হোন্ডা শিখতে গিয়ে কাঁঠাল ট্যাকের অদূরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আলগিন তার হাতের একটা হাড্ডি ( স্টাইলয়েড প্রসেস) ভাংলো!

গণস্বাস্থ্য পর্ব।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ( জিকে) যাবার আগে জিকের ভিতরের কার্যক্রম সম্পর্কে তেমন ধারণাই ছিল না। ওখানে ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মী বিশেষজ্ঞ অন্যান্য প্রকল্প কর্মী নির্বিশেষে সবার সকাল শুরু হয় কৃষি কাজ দিয়ে। ডাক্তাররা মাঠে উপস্থিত থাকলেই চলত, কিন্তু আলস্যহেতু সেই উপস্থিতিটুকুও আমার ছিল না। একবার কাশেম ভাই একটা নোটিশ দিয়েছিলেন আমি কেন ভাদ্র মাসে পর পর তিনদিন কৃষিকাজে যাইনি। যাহোক, এইসব নোটিশের কাগজ পাতলা হলেও ভার এবং ধার ছিল; ব্যক্তিগত ফাইলে চলে যেত, প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতে পারত। একবার কৃষিকাজে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী ময়না পুকুর থেকে শালুক তুলেছিল, তাই চিবিয়েছিলাম। আমি খুবই অভিযোজনশীল প্রাণী, পাঁচ তারা হোটেলেও অস্বস্তি হয় না, রাস্তার পাশের ইটালিয়ান হোটেলে উদরপূর্তি করতেও ফুর্তির অভাব হয় না।

আউটডোরে গিয়ে দেখলাম রোগিদের কার্ড আছে, স্বাস্থ্য বীমা বইও আছে। মোট চার ক্যাটাগরির রোগি, ক গ্রুপের রোগিরা ধনী - ঔষধ পরীক্ষা কন্সালটেসন সব সেবাই প্রকৃত দামে নিতে হবে, খ গ্রুপ কিছু কন্ট্রিবিউশান করবে, গ গ্রুপের জন্য কেন্দ্র কিছু সাবসিডি দিবে আর অ গ্রুপ সম্পূর্ণ ফ্রি। আমার নিজেরও কার্ড করতে হয়েছে। এসিডিটি হলে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের বড়ি সিমেটিডিন ( ঔষধের জেনেরিক নাম লিখা হত, আর রেনিটিডিন ছিল না) লিখিয়ে নিতাম কাউকে দিয়ে। যিনি ডিসপেন্স করছেন তিনি যেন সিমেটিডিন নয়, হীরের টুকরো তুলে দিচ্ছেন! কিন্তু র‍্যাশনাল ইউজ অব মেডিসিন নিশ্চিত করতে গিয়ে এন্ডোস্কোপি ছাড়া কাউকে সিমেটিডিন লেখা বারন, বড়ি এন্টাসিড লিখতে হত। অন্যথায় রোগি যখন গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সে মুহূর্তেও কঠিন মনিটরিং এর ফাঁদে পড়ে বীমা বই সহ ফেরত চলে আসার সম্ভাবনা ছিল! প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা না করে অনুমানের ভিত্তিতে কৃমি বা আমাশয়ের চিকিৎসা দিতেও ভয় পেতাম। স্বাস্থ্যকর্মী আউটডোরে বসে ইতিহাস লিখে সাধারণ পরীক্ষা করে রেফার করার প্রয়োজন হলে ডাক্তারের কাছে পাঠায়। স্বাস্থ্য কর্মীরা নির্দিষ্ট কয়েকটি ওষুধ লিখতে পারে। কিন্তু ডাক্তার হয়েও এক্স রে না দেখে এন্টিবায়োটিক লিখতে ভয় পেতাম।

বরং সে তুলনায় সাব সেন্টারে যাওয়া ভাল ছিল, স্বাধীনতা ছিল। জরুন, পানিশাইল, শিমুলিয়া, মিরেরচানগাও আর সাটুরিয়া উপকেন্দ্রে যেতে হত আমাদেরকে। সেই উপকেন্দ্র গুলোতে স্বাস্থ্য কর্মীরা থাকত, ডাক্তার যেত সপ্তাহে দুই দিন। বর্ষাকালে শিমুলিয়া যেতে হত শ্যালো নৌকায়, এ ছাড়া বাকি সব জায়গাতেই মোটর সাইকেল ছিল বাহন। মোটর সাইকেলে না গেলে বাস, রিকসা, ভ্যান আর পায়ে হেঁটে যেতে হত। মিরেরচানগাও কেন্দ্রে গেলে মাসকালাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খেতে পারতাম বলে আবুল ভাইয়ের এই কেন্দ্রটি আমার পছন্দ ছিল। উপকেন্দ্রগুলো আমাদের মূলধারার স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে এত নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল যে, শিমুলিয়া উপকেন্দ্রে গিয়ে যদি আমি একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের কনফিডেন্স নিয়ে মায়েদেরকে চিকিৎসা না দিতে পারতাম তাহলে অনেক রোগির ক্ষেত্রেই, হয়ত আর চিকিৎসাই হত না। এই উপকেন্দ্রের রোগিদেরকে আমরা আবার মূল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিশেষজ্ঞদের কাছে রেফার করতাম। বিশেষজ্ঞগণ ধানমন্ডির নগর হাসপাতাল থেকে ( মাত্র শুরু হয়েছে তখন) সপ্তাহে দুদিন করে আসতেন - মেডিসিন ( আনোয়ার স্যার) , গাইনি ( দেলোয়ার স্যার), শিশু ( মোফাজ্জল স্যার, মেসবাহ স্যার), ডেন্টাল ( হান্নান ভাই, হাবিব ভাই), রেডিওলোজী ইত্যাদি । সার্জন ছিলেন কর্নেল আলী - উনি সাভার ক্যাম্পাসেই থাকতেন, ফৌজি আর বিলেতি কায়দাকানুন জানা ছিল তার ভালই, কিন্তু ততদিনে তার হাত কাঁপে। তারিক ভাই অর্থোপেডিক্স কেসগুলো দেখতেন, শাহজাহান ভাই আর স্বপন ভাই ছিলেন ২৪ ঘন্টার হোল বডি সার্জন! বিদেশি ডাক্তার কেউ কেউ আসতেন ভলান্টিয়ার হিসেবে, কেউবা আসতেন ট্রপিকাল মেডিসিন শিখতে। অস্ট্রেলিয়ার টমিকো আর সুইস এলবেন আমার সময়ে ছিলেন। এদের নিয়েও মজার ঘটনা আছে, হয়ত সামনে বলব।

সন্ধ্যার অফিস ভাল লাগত। লাইব্রেরিতে তারিক ভাই এটা সেটা পড়তে দিতেন কিংবা বাংলায় অনুবাদ করতে দিতেন। স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য একলাম্পসিয়ার প্রটোকল ইত্যাদি বাংলায় করেছিলাম। স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্লাস নিতাম মাঝে মধ্যে। লাইব্রেরিতে মেডিকেল বই পুস্তকের পাশাপাশি সাহিত্যের বইও দুই একটা ছিল।

মাঝে মধ্যে জাফর ভাই আসতেন - পরিদর্শন কিংবা বাজেট মিটিংয়ে । আমি আমার কৌশল অনুযায়ী দূরে থেকেই হাজার তিনেক টাকা বেতনের চাকরিটাকে সুরক্ষিত করে যাব, আর এক সময় তিন চার মাসের জন্য চলে যাব শ্রীপুর উপকেন্দ্রে, যেখানে প্রকল্পের উপদেষ্টা পদে পাঠানো হবে আমাকে। গাজীপুরের শ্রীপুরে ইতালির পয়সায় একটা স্বাস্থ্য কর্মী স্কুল খোলা হয়েছে, প্রতি ব্যাচে জনা পঞ্চাশেক ছাত্রী ভর্তি হয়, ছাত্র সংখ্যা ২ থেকে ৪ % হয়ে থাকে। ওদেরকে গড়ে তুলতে হবে। শ্রীপুর মিশন শেষেই আমাকে ( মোটর সাইকেল পরীক্ষা উত্তীর্ণ ও লাইসেন্স প্রাপ্তি সাপেক্ষে) ঢাকার নগর হাসপাতালে পাঠানো হবে।

শ্রীপুরে গিয়েছিলাম স্ত্রী ও কন্যা শাশ্বতীসহ। কন্যার বয়স তখন দেড় বছর।


গণস্বাস্থ্য পর্ব।

হঠাৎ একদিন শেরপুরের ভাতশালা কেন্দ্র থেকে অপু ভাই চলে এলেন সাভার কেন্দ্রে। তার পিছু পিছু এল নৃতত্ত্বের ছাত্র কুমকুম আর চার জনের একটা দল। ওরা আমাদের হোস্টেলেই উঠলেন। ক্যাম্পাস ছিল অধুমপায়ী, কিন্তু রুমের দরজা বন্ধ করলে কে দেখে আর রাস্তা পার হয়ে ওপারের পর্দাঘেরা চায়ের দোকানে গেলেই বা কে দেখে! প্রশাসনের দেলোয়ার ভাই বলতেন পর্দার আড়ালে নাকি শয়তানের আখড়া। অপু ভাই একটা গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিবেন- অসুখ বিসুখ নিয়ে গ্রামের লোকের ধারণা কি, অসুখ হলে তারা কোথায় যায় এবং কেন যায় ইত্যাদি ছিল গবেষণার বিষয়। অপু ভাই আর কুমকুমের সাথে গোল্ড লিফ টানতে টানতে অনেক কিছু জানা হত, শিখা হত৷ সপ্তাহে একবার ওদের কাজের অগ্রগতি জানতে আইসিডিডিআরবির একটা দল আসত। ওরা যখন সবাই মিলে ' সয়াবিন চা গরম ক্যানটিনে ' বসতেন, পাবলিক হেলথের অনেক আমির ওমরাহদের নাম শুনতাম। সপ্তাহে একবার করে লেবার রুমে সংগৃহীত মায়েদের গর্ভফুলের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যেত আরেকটা দল। এই দুটো ঘটনা ছিল স্বাস্থ্য গবেষণার দুটো নমুনা কাছ থেকে দেখা। গবেষণার সমন্বয়ক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক মোরশেদ চৌধুরী, যিনি শাহাদাৎ চৌধুরীর ভাই ও খালেদ মোশাররফের সহযোদ্ধা।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এতদিন শিখেছি প্রেসক্রিপশনের ডান দিক আর বাম দিকের সমীকরন মিলানো, সংগত ওষুধের ব্যবহার, কঠিন পরিশ্রম - এইগুলো। এবার অন্য দিকে অন্য কিছু খুঁজছে আমার দৃষ্টি। গ্রামে পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যু হলে কিংবা মাতৃ মৃত্যু হলে একজন স্বাস্থ্য কর্মীর সাথে সরেজমিনে গিয়ে মৌখিক ময়নাতদন্তের সময় সদ্য স্বজন হারা মা বাবা কিংবা স্বামী বা শাশুড়ীর সাথে কথা বলা ছিল খুবই বেদনার, চ্যালেঞ্জের।

একদিন চোখে পড়ল হাসপাতালের নিচ তলায় একটা কালো রঙের পোস্টারে কালো এক কিশোরীর ছবি ছিল। কাছে গিয়ে পড়া গেল আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির চিকিৎসা নৃতত্ত্ব বিষয়ে ছাত্র ভর্তির আহ্বান। অপু ভাইদের সাথে মিশে, আমস্টারডাম ফেরত তারিক ভাইয়ের কিছু অভিজ্ঞতা শুনে আর সর্বোপরি মোরশেদ ভাইয়ের ''আই হেইট টু বি এ ক্লিনিশিয়ান' শুনে শুনে আমি দু মাসেই অনেকটা পরিবর্তিত মানুষ। অনেকটা মগজ ধোলাই হয়ে গেছে। মনস্থির করে ফেললাম, মেডিসিন বা সার্জারি নয়, পাবলিক হেলথেই কাজ করব। ওই কালো পোস্টারটাই স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিল।

আই হেইট টু বি এ ক্লিনিশিয়ান গল্পটা এরকম। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক ছোট শিশুর ডায়রিয়া। বমি করে সব ফেলে দিচ্ছে। ম্যালেরিয়া আর কালা জ্বর শিখতে আসা সুইজারল্যান্ডের ডাক্তারকে মানা করা সত্ত্বেও নাকে নল দিয়ে স্যালাইন ব্যাগ থেকে কলেরা স্যালাইন গিলাতে থাকল ( দিতে হবে তো খাওয়ার স্যালাইন। ব্যাগের স্যালাইন তো শিরাপথে রক্তে দেয়ার জন্য) । অগত্যা পেট ফেঁপে ঢোল। পেটে কোনো শব্দ নাই। শিশু বিশেষজ্ঞ এক্স রে দেখে ওপ্যাসিটি, ফ্লুইড লেভেল ইত্যাদি বলে টলে সার্জনকে রেফার করলেন। সার্জন এই একিউট ম্যাজিক বক্স অর্থাৎ পেটটা কাটবেন কি কাটবেন না ভাবছেন আর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দিলেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বিভিন্ন আদেশ -নির্দেশ আর ধমকা- ধমকিতে অস্থির। মোরশেদ ভাইয়ের কানেও হৈ চৈ এর শব্দ গেল। সিকরুম ( ইনডোর) কিছুটা পদভারমুক্ত হলে উনি এসে গোঁফের ভিতর দিয়ে রহস্যময় হাসি এসে বললেন, এই বনানী কুবি কই গেলি, এক চামুচ পটাশিয়াম সিরাপ এনে দে তো! ( সাধারণত জাফর ভাই আর মোরশেদ ভাই অনেক কর্মীকেই তুই করে বলতেন। কাজ পছন্দ না হলে কাঁঠাল পাতা ছিড়ে এনেও খাওয়াতে চাইতেন)। সিরাপ খাওয়ার দুই ঘন্টার মধ্যে বাচ্চা উঠে বসল, পেটও বসে গেল তো বটেই। পরদিন মায়ের কোলে করে বেহাতি খেতে খেতে বাড়ি চলে গেল। এই ঘটনার পর মোরশেদ ভাই বললেন, 'আমি কেন সিকরুমে আসি না বুঝছ? আই হেইট টু বি এ ক্লিনিশিয়ান!' যে আত্মগৌরবের সাথে তিনি এই কথা কয়টা উচ্চারণ করেছিলেন, সেই আত্মবিশ্বাস দেখেই পরবর্তীতে আমিও হয়ত মুক্তিযুদ্ধের সময় মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের কর্মী মোরশেদ ভাইয়ের প্রতিধ্বনি করেছিলাম। একদিন গল্প করেছিলেন হ্যারিকেন-এর আলোয় কিভাবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের শরীর থেকে একটা একটা বুলেট বা পিলেট বের করতেন। আরেক দিন বলেছিলেন বাড়ির উঠোনে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখার কথা।

জাফর ভাইয়ের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে তিনি ঠিক ১১ বছর ১১ মাস ১১ দিন কাজ করার পর ৯৭ এর শেষে ব্র‍্যাকে চলে আসেন (হিসেবটা তার ছেলে খালেদ এর করা) আমিও তাঁর হাত ধরেই ব্র‍্যাকে যাই , আমি অবশ্য ব্র‍্যাকে এক যুগ পার করেছিলাম।

খালেদ মোশাররফের শিষ্য মোরশেদ ভাই আবার ফিরে গিয়েছিলেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে, ছিলেন আমৃত্যু, ওখানেই সমাহিত।

___________________

AD...

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়