Ameen Qudir

Published:
2019-10-04 00:58:49 BdST

কেন আমরা আমাদের শিশু স্মৃতি মনে করতে পারি না?


 

ডা. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট _______________
পৃথিবীতে অনেকে আছেন যাদের মা'নেই। কেউ মা হারিয়েছেন ছেলেবেলায়, কেউ বড় হয়ে কেউবা জন্মের সাথে সাথে। হারানো মায়ের স্থান পূরণীয় নয়। মায়ের ভালোবাসার অতুলনীয়। মায়ে'র শাসন ও মিষ্টি। তারপরও মা হারানোর শোক অনেক সময় আমরা মানিয়ে নিতে পারি। কিন্তু মেয়েটি মেনে নিতে পারেনি। বয়স সতেরো হতে চললো তার। আজো সে তার মা'কে ভুলেনি একটি মুহূর্তের জন্যে।
মা'কে তার মনে নেই। মনে থাকার কথা নয়। বলা যায় মা'কে সে দেখেইনি। শিশু বয়সের কিছুই আমাদের মনে থাকেনা, থাকার কথা না । সাধারণত বয়স তিন বা চার বছর এর পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো আমাদের আবছা আবছা মনে থাকে, তার আগের ঘটনা নয়। একে "চাইল্ডহুড এমনেশিয়া" বলে।
মেয়েটির মা মারা যায় যখন তার বয়স এক বছরের কিছু বেশি। একটু বড় হয়ে যখন সে স্কুলে যাওয়া শুরু করে তখন সে জানতে পারে তার মা নেই। সবার মা আছে, তার মা নেই। শিশু বয়সেই তার মা নাকি মারা গিয়েছেন। যে মা তাকে সেবা যত্ন করে স্কুলে নিয়ে আসেন, তিনি আসল মা'নন। তিনি যে আদর করেন না তা'নয়। তারপরও কেনো জানি তার মন খুঁজে ফেরে তার আসল মা'কে। কেমন ছিলেন তার আসল মা, কেমন উষ্ণ ছিলো তার পরশ।
একদিন নানা বাড়িতে খালার কাছে মায়ের কয়েকটা ছবি দেখে। তখন বয়স চার কি পাঁচ। সে সব গুলো ছবি নিয়ে আসে। তারপর থেকে আজোব্দি ছবি গুলো তার সাথে সাথে থাকে। শয়নে, স্বপনে, চলনে বলনে সব সময়। খুবই যত্নের সাথে ওগুলো। কাপড় আর কাগজের ভাঁজে। কখনো 'মন খারাপ' হলে মায়ের ছবি গুলো বের করে দেখে, 'মন ভালো' হলেও মায়ের ছবি দেখে। পড়তে বসলেও মায়ের ছবি, ঘুমুতে গেলেও সেই একই। মাঝেমধ্যে সজল নয়নে অস্পষ্ট স্বরে কথা বলে,"মা'গো তুমি কই?"
তার এ কথাগুলো আমার বিশ্বাস হয়নি। আমি বললাম, "সব সময় মায়ের ছবি সাথে থাকে? এখন ও কি মায়ের ছবি সাথে আছে?"
অবাক করে দিয়ে সে বললো, "জ্বী আছে"।
ব্যাগ থেকে তার মায়ের একটা ছবি বের করলো। মায়ের কোলে বসে আছে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। এই বাচ্চাটাই সে নিজে। চেম্বারে আমার সামনে বসা সতেরো বছরের মাতৃ' হীন 'কাকলি'।
ছবি দেখে আমি ও সাথে থাকা কাকলি'র বাবা দুজনেই অবাক হলাম। এভাবে হারানো মায়ের ছবি সারাক্ষণ সাথে নিয়ে থাকা, সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে এই প্রথম দেখলাম।
কাকলির'র বাবাও যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি জানতেন না কাকলি এমন করে। মায়ের ছবিগুলো সাথে নিয়ে থাকে সে সারাদিন। মায়ের স্নিগ্ধ কোমল পরশ পেতে সারাক্ষণ হাহাকার করে মেয়েটির মন।
গত দশ বারো বছরের মধ্যে এমন একটি দিন নেই যে, 'কাকলি' তার মায়ের ছবি একবারের জন্যে হলেও না দেখে থেকেছে।
কিছু হলেই মায়ের ছবি গুলো বের করে তার দিকে সে তাকিয়ে থাকে। মায়ের এ ছবিগুলো তার প্রান, তার জীবন, চলার শক্তি, মায়ের ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ পায় ছবির গুলো স্পর্শে। তাই মাঝেমাঝে এই ছবি গুলো সে তার গালে ছোঁয়ায়। হারিয়ে যায় অজানা মায়ের ভালোবাসায়। মায়ের এই ছবি ক'টাকে ঘিরেই তার ছোট্ট জগৎ।
'টুকটুকে লাল জামা পরে মায়ের কোলে বসে হাসছে ছোট্ট তুলতুলে কাকলি'
কাকলি'র বাবা আমার হাত থেকে কাকলির মায়ের ছবি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অনেক্ক্ষণ। অনেক বছর পর বোধহয় তিনি তার স্ত্রী'র ছবি দেখলেন। ক্ষানিক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন নিশ্চুপ । তার চোখের কোনে জমছে জল। আমার সামনেই বাবা ও মেয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। অস্পষ্ট স্বরে বাবা বললেন, 'মা'রে আমার মা'
কাকলির মাথাব্যথা ও মন খারাপ হয় প্রায়ই। মাঝেমধ্যে অজ্ঞান ও হয়ে যায়। এজন্য তার বাবা নিয়ে এসছিলেন আমার কাছে সপ্তাহ দুয়েক আগে।
আজ এসছেন ফলো আপ জানাতে। তেমন একটা ইম্প্রুভ হয়নি। মাথাব্যথা ও অজ্ঞান হয়ে যাবার কারন বের করতেই একান্তে আলাপ করছিলাম কাকলীর সাথে। নিশ্চয়ই কাকলির মাথাব্যথার কোন না কোন কারন আছে। যা সে কাউকে শেয়ার করছেনা। আজ তাই তাকে একান্তে কথা বললাম এ নিয়ে। জানার চেষ্টা করলাম কাকলির মাথাব্যথার ও মন খারাপের কারন।
বছর পনেরো আগে ব্রেইন ক্যান্সারে মারা যান কাকলির মা। তখন কাকলির বয়স এক বছরের কিছু বেশী। কাকলির কষ্ট কেনো তার মায়ের মুখটা মনে করতে পারেনা।
_______________
ডা. সাঈদ এনাম
ডি এম সি, কে-৫২

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়