Ameen Qudir

Published:
2019-08-31 07:02:44 BdST

মেডিকেল ভর্তিচ্ছুদের প্রতি খোলা চিঠি


 

 

ডেস্ক
_____________________

'মেডিকেল ভর্তিচ্ছুদের প্রতি খোলা চিঠি' শিরোনামে
ডা. সাকলায়েন রাসেল-এর লেখা এখন ব্যপক আলোচিত। লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে পাঠকদের কাছে পেশ করা হল।

ডা. সাকলায়েন রাসেল
অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর এন্ড অ্যাসোসিয়েট কনসালটেন্ট, ভাসকুলার সার্জারি, ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হসপিটাল এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট।


তোমরা যারা মেডিকেল কোচিং করছো, দয়া করে ভেবে দেখ—তুমি কি জেনে শুনেই ডাক্তার হতে চাচ্ছো? উত্তর যদি হ্যা হয়, তবে আসো নিম্নে উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে একটু ভাবি।

১. তুমি কি জানো, নিয়তি পাস করে গেলেও এমবিবিএস সম্পন্ন করতে তোমার ৬ বছর লাগবে। যদি সরকার ইন্টার্নশিপ দুই বছর করে তাহলে সাত বছর লাগবে। এরপর উচ্চতর ডিগ্রি নিতে আরো পাঁচ বছর!

২. এর মধ্যে এমএস/এমডি ভর্তি হতে এমবিবিএস পাসের পর দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ ৭+২+৫=১৪ বছর!

৩. এখানেই শেষ কথা নয়, আরও চ্যালেঞ্জিং খবর আছে। তুমি হয়ত জানো না উচ্চতর ডিগ্রিতে পাসের হার ১% বা তারও কম। সেক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রিতে গড়ে অতিরিক্ত ৩ বছর লাগবে। আর এর মধ্যে বিয়ে/গ্রামে ২ বছর পোস্টিং মিলিয়ে তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে আরো ৩টি বছর। সে হিসাবে যোগফল দাঁড়াল ১৪+৩+৩=২০ বছর!

৪. হয়তো ভাবছো, যাক তাও শেষ হচ্ছে। কিন্তু না, এর এরপরেও কথা আছে। তুমি পাস করা মাত্রই বিশেষজ্ঞ হতে পারবে না! নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে তোমাকে আরো ৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে! সর্বশেষ ফলাফল ২০+৫=২৫ বছর।

৫. আচ্ছা, এইসএসসি পাসের পর এই ২৫ বছর নিজেকে পড়ালেখায় নিয়োজিত রাখতে তোমার কোনো প্রস্তুতি ছিল?কিংবা স্বাস্থ্যসেবার গর্বিত সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখার সময় জীবনের শুরুতে দীর্ঘ সময়ের পড়াশোনার বিষয়ে তোমার কোনো ধারণা ছিল।

এখানেও উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে আরও শোনো; কারণ বিষয়গুলো জানা থাকলে অপেক্ষাকৃত সহজ ক্যারিয়ার গড়তে তোমার জন্য সুবিধা হবে।

১. যতদিনে তুমি এমবিবিএস পাস করবে ততদিনে তোমার নন-মেডিকেল সহপাঠীরা ছাত্রত্ব শেষ করে নিজ নিজ পেশায় মনোযোগ দিবে।

২. তুমি যখন উচ্চতর ডিগ্রিতে ভর্তির সুযোগ পাবে—ততদিনে তোমার সহপাঠীরা নতুন প্রমোশন পাবে। বেল চেপে পিয়নকে দিয়ে চা আনাবে।

তুমি কি আরো জানো, সংসারের দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দেয়ার প্রহর গুণতে গুণতে তোমার পিতা একসময় ইহলিলা সাঙ্গ করবেন?

তুমি একসময় অর্থাভাবে খেতে পারবে না। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর যখন তোমার অর্থাভাব কেটে যাবে তখন অনাকাঙ্খিতভাবেই তোমার শরীরে বাসা বাঁধবে ডায়াবেটিস ও প্রেসারের মতো রোগ। তখনো তুমি খেতে পারবে না! এ অবস্থায় সামাজিক সব আয়োজন থেকে তুমি থাকবে দূরে। ধীরে ধীরে মানুষ থেকে অসামাজিক জীবে পরিণত হবে তুমি।

দীর্ঘ সময় পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকার কারণে বিলম্বে সংসার শুরু করায় সন্তানের বেড়ে উঠা দেখার মতো সময়ও তোমার হাতে থাকবে না। আর এ কারণে মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ডাক্তারদের মধ্যেই বেশি!

তোমার এটাও জানা উচিত, প্রতি বছর ৫০ হাজারের মতো ছাত্র মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দেয়, আর চান্স পায় মাত্র ৫ হাজারের মতো।

যারা চান্স পায় না তাঁদের অনেকেই অন্য পেশায় যোগ দেয়। ডাক্তার না হওয়ার আফসোস তাঁদের অন্তরে থাকলেও একসময় তাঁদের অনেকেই ডাক্তার বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। উঠতে বসতে তারা তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করবে!

তুমি হয়ত জানো না, বিদেশ প্রীতি আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। খেয়াল করলে দেখবে, এসব লোক চিকিৎসার জন্য বিদেশের সরকারি হাসপাতালে যায় না, যায় বেসরকারিগুলোতে। তারাই কথায় কথায় তোমাকে কসাই বলতেও কুণ্ঠা বোধ করবে না। ভারতের কথাই ভাবো, নচিকেতা ভারতের লোক ডাক্তারদের কসাই বলেই তিনি বিশেষ স্থান দখল করেছেন। অথচ তাঁর গান ভারতীয় ডাক্তারদের উদ্দেশ্যেই ছিল।

আফসো লাগে এদেশের বিবেকবানরা চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না রাখলেও পাণ্ডিত্য ফলাতে পিছপা হয় না।

আরেকটি বিষয় তোমার পূর্বানুমান থাকা খুব জরুরি। তাহলো: শুধু মাত্র পাস করছে না বলে প্রতিদিন
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেডিকেল শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। বেসরকারি মেডিকেলে এ প্রবণতা অনেক বেশি। অনেক টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে অনেকে আর আসতে চায় না। এতো টাকা নষ্ট করে দেশে ফিরে কি করবে—সে শঙ্কায় ফেরারি আসামির মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে অনেকে।

বেসরকারি মেডিকেলেও তাই। এত্তো টাকা খরচ করে অনেকে ফেল করতে করতে একপর্যায়ে আত্মহত্যার দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ভাগ্যগুণে অনেকে ফিরে আসে। তারা ভাবে, মা-বাবার এতো টাকা খরচ করলাম, ডাক্তার না হলে কি হবে!

নিরাপদ কর্মস্থলের অভাবে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চিকিৎসকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
এদেশে রোগীর চেয়ে ডাক্তারের সংখ্যা বেশি। ওষুধের দোকানদার ডাক্তার, পল্লী চিকিৎসক বড় ডাক্তার, পাশের বাড়ির সব জান্তা আপা তাঁর চেয়েও বড় ডাক্তার, ঘরে ঘরে কত শত ডাক্তার। এর ওপর আবার এখন যোগ হয়েছে গুগল ডাক্তার, গুগলে সার্চ দিয়েই যারা তোমার উপর পাণ্ডিত্য ফলাবে! এদেশের সব লোকই ডাক্তার, এদের মধ্যে কেউ কেউ এমবিবিএস পাস করে!

এবার তবে ভাবো, তুমি কি সত্যিই ডাক্তার হতে চাও?

জানি, এতো কথা শুনতে শুনতে আমার ডাক্তারি ক্যারিয়ার নিয়ে তোমার মনে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তাহলে শোনো, আমার অবস্থাও আর দশজন ডাক্তারের মতোই। তবে আমি সুখী, অনেক সুখী। মনে রাখবা, এ সুখ অনেক অশ্রু দিয়ে কেনা এবং ধরেও রাখছি কষ্টের আঁচলে। হোক না তা শারীরিক বা মানসিক কষ্ট!

তবে তুমি যদি এত্তো কিছুর পরেও সব মেনে নিয়ে এগোতে পারো, তবে নিশ্চিত থেকো—স্বর্গীয় সুখ শুধু এ পেশাতেই আছে। আর এটাও মনে রেখো, মেডিকেল পড়তে আমি তোমাকে নিরূৎসাহিত করছি না, তোমার মনোবল আরো বাড়ানোর প্রয়াস হিসেবেই বিবেচনা করতে পারো। কারণ প্রস্তুতি যত বড় হয়, যুদ্ধ তত সংক্ষিপ্ত হয়!

তুমি পারবে তো? আমার ভয় হয়, কারণ তুমিও যে মানুষ!

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়