Ameen Qudir

Published:
2019-05-04 20:14:04 BdST

এমবিবিএস ডাক্তার থেকে কসাই হওয়ার গল্প এবং ফেরেশতা-কোয়াকদের কাহিনি


 


ডা. অসিত বর্দ্ধন
______________________

১ .

একটু কৌতুক করে শুরু করা যাক! মেডিকেল কলেজে একটা প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে যে একজন শিক্ষার্থি ৩ বার ডাক্তার হন। প্রথম বার যেদিন এপ্রন পড়ে মেডিকেল কলেজে পা রাখেন, দ্বিতীয় বার যখন প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষা পাস করে এপ্রন পরে , গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে পকেটে টর্চ, হ্যামার নিয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে যান। আর তৃতীয়বার যেদিন শেষ প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাস করে নামের আগে ডাঃ লিখে সত্য সত্যি ওয়ার্ডে হাজির হন চিকিৎসা দিতে। এই তিন পর্বেই আনন্দ ও উৎসাহের কমতি থাকে না।
এই সময় কোন নবীন চিকিৎসক কসাই থাকে না। সকাল বেলায় হাসপাতাল শুরু হওয়ার আগে ওয়ার্ডে চলে যায়, রাতের রোগীর খবর নেয়, সতির্থদের কাছে থেকে আগ বাড়িয়ে নিজে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করে। এডমিশান ডে হলে সকাল থেকে শুরু করে, নাস্তা কিম্বা দুপুরের খাবার খায় দুটোর পরে, ইভিনিং থাকলে চলতে থাকে একটানা রাত ৯টা ১০ টা বা এগারো টা পর্যন্ত। যার নাইট ডিউটি আছে সে একটু বিশ্রাম নিয়ে চলে আসে রাতে । এরপর সারারাত হয়ত দুইজন ডাক্তার শ দুয়েক রোগীর সেবা নিশ্চিত করেন। কার ওষুধ লাগবে, কে কিনতে পারছে না, কার পরীক্ষা লাগবে, কে করাতে পারবে , কে পারবে না, সব ম্যানেজ করতে হয়। সকাল এলে একবার নিজের রাউন্ড, একবার সহকারী রেজিস্ট্রারের রাউন্ড আর একবার প্রফেসারের রাউন্ড। কখন দুপুর হাজির হয় বুঝতে পারে শুধু ক্ষিদার অনুভূতি থেকে। অথবা যখন পা দুটো আর চলতে চায় না। কখনো রোগীর ওষুধ না থাকলে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে কিনে দেওয়া, কখনো নিজের গায়ের থেকে রক্ত দিয়ে আবার ডিউটিতে ফিরে আসা। এর মধ্যে কোন রোগী মারা গেলে বুকের ভেতর স্বজন হারানোর বেদনা! চোখের জল ফেলার সময় হয় না, আরেকজন হাজির। ওষুধ কোম্পানির দেওয়া স্যাম্পলে চলে যায় সব রোগীর কাছে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে সহকারী রেজিস্ট্রারের একটা আলমারি থাকে। যখনি কোন রোগী ওষুধ কিনতে পারে না তখনি সেখান থেকে ওষুধ বের করে দেওয়া হয়। সার্জারি ওয়ার্ডে একই অবস্থা। এডমিশান মানে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা একটানা ডিউটি। পরের দিন অপারেশন শেষ করে হস্টেলে যেয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছেন অনেকেই।
যেদিন এডমিশান থাকে না, সেদিন যেন ঈদ! রাউন্ডের পর একটু গল্প, হাসপাতাল ক্যান্টিনে সকালের নাস্তার টেবিলে হয়ত কয়েকজন একসাথে বসার আনন্দ! কিম্বা যে সহকারী রেজিস্ট্রার কোন একজন ইন্টার্র্নির প্রতি আকৃষ্ট, তাকে সিল দেওয়া! একেকদিন একেকজনের বিল দেওয়া, অথবা যে ঘাপটি মেরে থাকে, বিল দিতে চায়না, তাকে একদিন আচ্ছামত সিল দেওয়া। আর রাতে ডক্টরস ক্লাবে হইচই করা। কেউ টিভি দেখে তো কেউ ক্যারাম খেলছে! কেউ তাস পিটায় তো কেউ টেবিল টেনিসে ঝড় তুলছে। সুখে দুখে , ভালবাসায় , আন্তরিকতায়, কখনো প্রেমে, বা অপ্রেমে হৃদয় ডুবিয়ে এক সময় শেষ হয়ে যায় এক বছরের ইন্টার্নশিপ।

যারা এটুকু পড়েই ভাবছেন এ কি বোরিং গল্প, এর সাথে কসাই হবার যোগ কোথায়, এ শুধু গোড়া পত্তন! এর পর থেকে শুরু হয় প্রতিদিন শারীরিক ও মানসিক পীড়ন। চাকরি নেই, উপার্জন নেই, বাড়িতে টাকা চাওয়ার মুখ নেই , প্রেমিকার বাবার কাছে দাম নেই, রাজনীতির সাথে জড়িত নেই তো কোথাও দাঁত ফুটানোর জায়গা নেই। সুধু নেই আর নেই।

বেসরকারি হাসপাতাল নামের এক আজব কারখানা আছে যেখানে ডাক্তার হিসেবে ঢুকে বের হতে হয় দালাল হিসেবে। আপনি কি ডাক্তারি করলেন সেটা আপনার চাকুরীর নিয়ামক নয়! আপনার চাকুরী তখন ঠিকমত চলবে যদি আপনি রোগী এলেই একটা সুচ ফুটিয়ে একটা লবণ জল লাগিয়ে তাকে সিল দিতে পারেন। রোগীর যতই জ্বলুক, ক্লিনিক মালিকের পকেটে আলো জ্বলে, আর ডাক্তারের বেতনের সলতে নিভু নিভু হয়ে জ্বলে।
যেসব নস্ত্রাদুমাস ভবিষ্যতে বড় ডাক্তার হবেন এমন স্বপ্ন দেখেছেন, তারা এক রকম অনাহারের জালে জড়িয়ে যান। এরশাদ চাচা সব কিছুতে টাকা দেখতেন! চুক্তিতে ১০ পারসেন্ট, চাচির নামে। কর্পরেট কায়দা গণতন্ত্রের নামে। হুকুম জারি করেছিলেন যে হাসপাতালে ট্রেনিং মাগনা হবে না। ফেল করি মাখ তেল! মাসে মাসে ৫০০ টাকা দিলে তবেই তুমি হাসপাতালে ঢোকার সুযোগ পাবে!
চাচা যখন লাল দালানে গেলেন , তখন মাজেদ স্যার মন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগে কলমের এক খোঁচা দিয়ে এই বিষফোঁড়াটা কেটে দিয়েছিলেন। উনার মত উপকারী সার্জারি অনেকদিন কেউ করেনি।
এর পরের পালা, ডাক্তার না ঘাটকা, না ঘরকা! অনারারি ট্রেনিং মানে সরকারী ডাক্তারের পরে! কেউ দয়া করে হাতের কাজ করতে দিলে পাইলেন, না হলে নাই। " ফাইজলামি" করার কোন উপায় নাই । দিন রাত খাটেন। কে ছুটিতে যাবে তাঁর ডিউটি দেন, কে ছুটির দিন আসতে পারবে না, ঠ্যাকা দেন! আরেকজন সার্জন হিসেবে মকশো করবে তারে সাহায্য দেন ! আপনার মান নাই, বাড়ি নাই, ডিউটির সময় নাই। পরীক্ষা দেওয়ার টাকা নাই, পড়ার উপযুক্ত সময় নাই।

পেটের ক্ষিদা বেড়ে গেলে আপনি হয়ত একটা ফার্মেসি তে বসলেন। চুপচাপ দেখতে থাকবেন আপনার সামনে একটা কোয়াকের দোকানে রাজ্যের ভিড়! কোয়াক সাহেবের নূরানি চেহারা! বিগলিত হাসি ঝড়ে পরে রোগী দেখলেই।উনার সিরাপের ২ ৩ ডোজ ওষুধ খেলেই রোগী রুশ উপকথার ঘোড়ার মত তাজা হয়ে যায়। কবিরাজ কি " জয় হো" বলে লুঙ্গি তুলে হাওয়া ডিঙ্গিয়ে বাড়ি ফিরে যায়! আপনি জানেন ওই সিরাপে আছে কড়া স্টেরয়েড, সস্তার এন্টিবায়োটিক আর ব্যাথানশক ওষুধ। এক তীরে পৃথিবীর সব রোগ ছিন্নভিন্ন। আপনার ফার্মেসি ওয়ালাকে একবার বোঝাতে গিয়েছিলেন হয়ত। উনি মৃগী রোগীর মত "মৃদু" মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেছিলেন, " স্যার, দুইটা ওষুধ না বেচলে খাইতাম কি? হয় উনার মতন ওষুধ লেখেন, নাইলে আমি আরেকটা ভাল ডাক্তার নিয়ে আসি। " আত্মসম্মান নিয়ে পেটের সাথে মাথার লড়াই! বেশির ভাগ সময় পেট জিতে যায়। তাতে শরীর টা তেলেতেলে হয় বটে , কিন্তু মাথার তেল শুকিয়ে মানবতা হয় একেবারে খটখটে !

উপরওয়ালা যদি এই সময়ের মধ্যে ছাপ্পর ফাঁইরা, নিজে ধইরা আপনাকে এই কারবালা থেকে তুলে একবারে কক্সবাজারর সমুদ্র সৈকতে নিয়ে তোলে, মানে একটা সরকারী চাকুরী জোটে তাহলে আপনি ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন। বাকি ৯০ জন তখনো আশার চোরাবালিতে সাঁতার কাটছে! ডুবে যেতে পারে জেনেও দুই ঘণ্টার বাস জার্নি করে টলতে টলতে ফার্মেসির কোয়াক হয়ে যাওয়া, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হতে বৈষম্য কি ভুলে যাওয়া, রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে রাজনীতির ছত্রাক হয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে পরজীবী স্বর্ণলতার জীবন! মনে হয় বড় গাছের ডালে আছি, কিন্তু গোড়া নেই! নিজের অস্তিত্ব নেই আছে বড় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন! কিন্তু স্বপ্ন দেখার জন্য যেটুকু ঘুম প্রয়োজনতাঁর সময় পর্যন্ত নেই।

আজকে আপনারা ঘুমাতে যান, আমার ঘুমে পেয়েছে। কোথায় বেশ একটু রোমান্টিক কিছু লিখব, তা না বসেছি ত্যানা নিয়ে! যদি কিশোর কুমারের মত তিন টানের জায়গায় পৌঁছে যাই তাহলে আবার লিখব।
___________________________

ডা. অসিত বর্দ্ধন । পাঠক ধন্য সুলেখক। তার তৈরী করা অ্যাপস ডাক্তারদের কল্যাণে এখন জনপ্রিয়।
কানাডায় কর্মরত এনেস্থেসিওলজিস্ট, BDEMR নামের সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়