ডা কামরুন লুনা

Published:
2022-11-20 22:04:16 BdST

১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি : এখন ৮০০ কোটি


লেখক রাজিক হাসান

 

রাজিক হাসান
মুক্ত লেখক
______________

১৫ নভেম্বর পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ৮০০ কোটির ঘরে পৌঁছে গেল! আজ থেকে চার হাজার বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ লক্ষ। যা আমাদের আজকের ঢাকা শহরের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম। খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ সালে অর্থাৎ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি। দ্বিতীয় শতকে এসে দ্বিগুণ হয়েছে; অর্থাৎ ২০ কোটি।
ধারণা করা হয় ১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রথমবারের মতো ১০০ কোটিতে পৌঁছেছিল। এরপর ১২৩ বছর অর্থাৎ ১৯২৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০ কোটির ঘরে পৌঁছাতে। তারপর মাত্র ৩৩ বছরের মাথায় ১৯৬০ সালে মানুষের সংখ্যা হয় ৩০০ কোটি! সেই থেকে খুব দ্রুত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
সময়ের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ২০১১ সালে ৭০০ কোটি থেকে মাত্র ১১ বছরের মাথায় পৃথিবীকে বহন করতে হচ্ছে আরও ১০০ কোটি বেশি মানুষের ভার! আর ২১০০ সালের আগেই মানুষের সংখ্যা ১ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে!
মনে আছে একটা টিভি প্রোগ্রামে এক বাইসনের বাচ্চার জন্ম নেওয়া দেখছিলাম। বাইসনটি মাঠে ঘাস টাস খাচ্ছিল। এমন সময় তার বাচ্চা জন্ম নিল। সে ঘাস খেয়ে চলেছে, আর তার বাচ্চা জন্ম নিয়ে চলেছে। বাচ্চা দেহের বাইরে অনেকটা বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু মায়ের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। বাচ্চা নিজের চেষ্টায় দেহের বাকী অংশকেও মাতৃদেহ থেকে মুক্ত করল, হাঁচর পাঁচর করে বেরিয়ে এসে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। তার পর সে নিজের চেষ্টায় দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পড়ে গেল। আবার চেষ্টা করল, আবারও পড়ে গেল। এইভাবে কয়েকবারের চেষ্টায় পা গুলোকে শরীর থেকে দূরে কোণাকুণি স্থাপন করে ব্যালেন্স রেখে সে দাঁড়াতে সক্ষম হল। তারপর ওইভাবেই এঁকেবেঁকে হেঁটে মায়ের বুকের কাছে গিয়ে এক ঢুঁ মারল। তার বক্তব্য, ‘কি গো আমি জন্মালাম, আর তুমি আমাকে পাত্তা দিচ্ছো না কেন?’ মা ফিরে তাকাল, ‘ও তুই? কখন জন্মালি? আমি তো খেয়ালই করি নি’। মা বাচ্চাকে খুব করে চাটতে লাগল। দেখলাম প্রাণী জগতে সন্তানের জন্মদান কোন কষ্টদায়ক ব্যপার নয়।
কিন্তু মানুষের সন্তান যখন জন্মায় তখন তা এমন ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়ায় কেন? প্রসবযন্ত্রণাকাতর স্ত্রীলোকের চিৎকার কেউ শুনেছেন কি? শুনে কি মনে হয় না দশটা ডাকাত তার উপর প্রাণঘাতী হামলা করছে?
এর কিছু কারণ আছে। প্রথমত বিবর্তনের ফলে মানুষের মস্তিষ্কের আকৃতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, তার সাথে সাথে মস্তকের আকৃতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিরাট আকৃতি মস্তক যখন মাতৃগর্ভ থেকে বেরোয় তখন মাকে বিশ্বরূপ দেখিয়ে ছাড়ে।
দ্বিতীয়ত স্তন্যপায়ী প্রাণীগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র মানুষই দুই পায়ে চলে। দুই পায়ে চলার ফলে মায়ের প্রসব পথটি অনেক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এর ফলে মা যেমন প্রসবের যন্ত্রণা পায়, সন্তানও কিন্তু জন্মের সময় কষ্ট পায়।
তৃতীয়ত মানুষ সভ্য হওয়ার পর থেকেই প্রচুর সন্তানের জন্ম দিয়ে চলেছে। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা আজ আটশো কোটি। পিঁপড়ে টিপরে জাতীয় ক্ষুদ্র প্রাণীর কথা ছেড়ে দিলে মানুষের সমান আকার আয়তন বিশিষ্ট প্রাণীর সংখ্যা এর ধারে কাছেও আসে না।
যত বেশী ‘সভ্য’ হয়েছে, যত বেশী আরামদায়ক জীবনে অভ্যস্ত হয়েছে, তত বেশী যৌনক্রিয়া করেছে, তত বেশী সন্তানোৎপাদন করেছে। এর ফলে স্ত্রীলোকের শরীরে কিছু দুর্বলতা এসেছে, তার রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেম দুর্বল হয়েছে (পুরুষেরও) এর ফলে সন্তানোৎপাদন এমন ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক হয়েছে। এমন কি সদ্যোজাত শিশুও শারীরিকভাবে নড়াচড়ায় সক্ষম থাকে না। যতটা শারীরিক সক্ষমতা সে এক বছরে অর্জন করে ততটাই সক্ষমতা পশুশাবকদের জন্মের সময়েই থাকে। তবে শিশুর মস্তিষ্ক খুবই সক্রিয় ও সক্ষম থাকে, যা পশুদের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
প্রসবযন্ত্রণার মাঝে প্রকৃতির একটা নির্দেশ কাজ করছে, তা হল বেশী সন্তানের জন্ম দিও না। প্রকৃতি সকলের জন্য, শুধু মানুষ আর মানুষ সর্বত্র থিক থিক করবে এটা প্রকৃতির কাম্য হতে পারে না।
আমরা কীভাবে হাঁটতে হয় শিখেছি, শিখেছি কীভাবে বলতে হয়, পোশাক পরতে হয়, বেঁচে কাটাতে হয় জীবন। আমরা শিখেছি আগুন জ্বালানো, যোগাযোগ করা-আর হ্যাঁ, আমরা তো ভালবাসতেও শিখেছি। আমরা অনেককিছু শিখেছি, শিখে চলছি এখনও। তবে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই শিক্ষণকালে আমরা এমনও কিছু শিখেছি যা কোনদিনও না শিখলেই ভাল হত। মনে সুখস্বপ্ন জাগে, আহা, এটুকু যদি আমরা না শিখতাম! আমি বলছিলাম দুনিয়া ধ্বংস করবার যে ‘শৈল্পিক’ কায়দাখানা আমরা আয়ত্ত করেছি, তা নিয়ে। আমাদের একমাত্র বাসস্থান, আমাদের একমাত্র পৃথিবীকে আমরা দক্ষভাবে চুরমার করে দিচ্ছি, এবং যেকোন সময়ের চেয়ে দ্রুততম গতিতে।
আবার মানুষ যখন থেকে জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিতে শিখলো তখন থেকেই মানব সভ্যতায় বিরাট এক আপদের সূচনা হলো। তার আগে ভৌগলিকভাবে আলাদা মানুষের সমাজগুলির রোগবালাই ভিন্ন ভিন্ন ছিলো। যেমন, ইউরোপের রোগবালাই ছিল এক রকম আবার আমেরিকা মহাদেশের রোগের ধরণ ছিলো ভিন্ন রকম।
১৪৯৩ সালে আমেরিকা মহাদেশে প্রথম সোয়াইন ফ্লু বা শুকরবাহিত সর্দিজ্বর মহামারি রূপে দেখা দেয় তা দখলদার কলম্বাসের জাহাজে করে যেই শুকরেরা আমেরিকায় এসেছিলো, সেখান থেকেই এই মহামারি সূচনা হয় যা ইতিহাসে নিউ ওয়ার্ল্ড মহামারি বলে পরিচিত। আবার ১৫১৮ সালে আরাওয়াক ও হিসপানিওয়ালার প্রায় অর্ধেক মানুষ সাফ হয়ে যায় দখলদারদের আগমনের সাথে গুটিবসন্ত চলে আসায়।
ভিনদেশি রোগের সংক্রমণের কারণে আজকের দক্ষিণ আমেরিকাকেও চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। স্পেনীয় দখলদার কর্তেসের মাধ্যমে গুটিবসন্ত মেক্সিকোতে ছড়ায় ১৫২১ সালে। সাথে করে গুটিবসন্ত নিয়ে আসায় সেই সভ্যতার ৩ লাখ মানুষ মারা যায়।
এরপর একে একে আসে সর্দিজ্বর, হাম, ও টাইফাস জ্বরের মহামারী। অনেক বছর পরে মেক্সিকো এবং আন্দিজ কিছুটা সামলে নিলেও ব্রাজিলের জনসংখ্যা প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। ফলে ভয়াবহ জনসংখ্যার অভাব দেখা দেয়। জনসংখ্যার এই ঘাটতি পূরণে স্পেনীয় ও পর্তুগিজরা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ধরে নিয়ে আসে দাস। এই দাসরা তাদের সাথে করে আমেরিকায় নিয়ে আসে ম্যালেরিয়া ও পীতজ্বর।
কলম্বাস যখন আমেরিকা থেকে ইউরোপে ফিরে গেলো, তখন সাথে করে নিয়ে গেলো এক ভয়াবহ রোগ। ১৪৯৩-৯৪ তে ফরাসি-স্পেনীয় যুদ্ধে নেপলসে ছড়ায় এই বীভৎস রোগ। সেখান থেকে ছড়ায় সারা ইউরোপে। এ রোগে প্রথমে যৌনাঙ্গে ঘা দিয়ে উপসর্গ দেখা দেয়। তারপরে শরীরে বীজকুড়ি আসে এবং পঁচে যাওয়া শুরু করে, শেষ হয় একেবারে হাড়ের ক্ষয় দিয়ে। রোগটির নাম সিফিলিস। ইউরোপের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই বীভৎস রোগে ভুগে মরেছে কলম্বাসের কারণে।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর ফরাসি সৈন্যদল যখন ১৮১২ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরে রাশিয়া আক্রমণে মস্কো পর্যন্তই চলে গিয়েছিলো, তখন নেপোলিয়ন দেখতে পায় যে পুরো মস্কো শহর পরিত্যজ্য নগরী। কোন জনমানব নেই পুরো শহর শুধু খাঁ খাঁ করছে। পরের ৫ সপ্তাহে ফরাসি সৈন্যরা টাইফাস রোগের মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে পরে। ৬ লাখ সৈন্যের প্রায় সবাই মারা পড়ে সেই মহামারীতে।
রাশিয়ার টাইফাস মহামারীর একশত বছর পর ১৯১৮ সালের শেষের দিকে ভয়ঙ্কর এক মহামারি সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যার নাম স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের। এই সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যার চাইতেও বেশি। সেসময় সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরই মৃত্যু হয়েছিল এই ভাইরাসে।
স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর একশত বছর পর করোনাভাইরাস আতঙ্ক: অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের একের পর এক শহর। এই মহামারি সামলাতে বড় বড় উন্নত দেশও খুবই হিমশিম খেয়েছে। এই ভাইরাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, জড়বাদী, ভোগবাদি আর বিলাসের সমাজই আমরা তৈরি করেছি। সংকটময় মুহূর্তে বোঝা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বাড়ি, গাড়ী একজন মানুষকে বাঁচাতে পারেনা। যেমন পারে- ঔষধ, খাবার আর পানি।
একদল বিশেষজ্ঞ মানবজাতি বিলুপ্ত হতে চলেছে বলে ক্ষান্ত হচ্ছেন না। তাঁরা ‘লাল কার্ড’ বের করে মহাবিপদ সংকেত দিতেও দ্বিধা করছেন না। তাঁদের কথা হলো, ২০৫০ সাল থেকে ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৫১টি দেশের জন্মহার হ্রাস পেতে শুরু করবে।
প্রায় তিন লাখ বছর পূর্বে আফ্রিকায় আধুনিক মানুষ হোমো সেপিয়েন্স-এর নিদর্শন পাওয়া যায়। অসংখ্য প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতাকে সুনিপুন দক্ষতায় অতিক্রম করে মানুষ নামক উন্নত প্রজাতির প্রাণীটি আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রবেশ করেছে। পৃথিবী একটাই। চমৎকার এ নীল গ্রহটি কোনো একক জাতির বা গোষ্ঠীর নয়, শুধু ৮০০ কোটি মানুষেরও নয়। সহস্র হাজার বছর ধরে আণুবীক্ষণিক জীব, লতাপাতা, জন্তুজানোয়ারের সাথে ভাগাভাগি করে থাকা ৮০০ কোটি মানুষের। মানুষ কি পারবে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে? মানুষ কি পারবে একটি মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলতে? মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে?
--------------------------------------------

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়