Dr. Aminul Islam

Published:
2022-10-04 17:07:20 BdST

সান্তে প্যাবো ও ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব, বানর- মানুষের সম্পর্ক, বিজ্ঞান বনাম বিশ্বাস এবং মূর্খদের উত্তেজনা


 

ডেস্ক
_____________

 

সান্তে প্যাবো সব কিছু প্রশান্ত করে দিলেন।  

ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ঠিক কিনা, বানর- মানুষের সম্পর্ক, বিজ্ঞান বনাম বিশ্বাস, এবারের নোবেল লরিয়েট সান্তে প্যাবো কি ডারউইনের চেতনার প্রামানিক : এ নিয়ে জগদ্দল মূর্খদের তর্কের শেষ নেই।

এ সব নিয়ে সবিস্তারে লিখেছেন  মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়,ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম ও স্নেহাশিস রায়।

যা পাঠে মনের জানালা খুলে যাবে। দূর হবে অন্ধকার।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম লিখেছেন,


মেডিসিন এবং ফিজিওলজি ক্যাটেগরীতে এবারের নোবেল প্রাইজ অন্যবারের চেয়ে কিছুটা আলাদা এবং বৈজ্ঞানিক ভাবে অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

জেনম সিক্যুয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে সুইডিশ বিজ্ঞানী সান্তে প্যাবো প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে মানুষ এবং মানুষ সদৃশ্য আরো দুটো বিলুপ্ত প্রজাতি নেন্ডার্থ্যাল এবং ডেনিসোভ্যান প্রায় একই সময় বিবর্তিত হয়। এবং এই তিন ধরনের হোমিনিদের ভেতরে জিনের আদানপ্রদান ঘটে মিলনের মাধ্যমে।

সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়:

(১) এক লক্ষ বছরেরও আগে ইউরোপ এবং এশিয়াতে বসবাস করতো নেন্ডার্থ্যাল এবং ডেনিসোভ্যান নামক মানুষ-সদৃশ্য দুটো প্রজাতি।

(২) প্রায় একই সময় আফ্রিকা মহাদেশে বসবাস করতো হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষ প্রজাতি। ঐ অঞ্চলেই মূলত বিবর্তন ঘটে মানুষের।

(৩) প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে কিছু মানুষ ইউরোপ এবং এশিয়ায় দিকে মাইগ্রেট করে।

(৪) বিজ্ঞানী সান্তে প্যাবো ৪০ থেকে ৬০ হাজার বছরের পুরোনো নেন্ডার্থ্যাল এবং ডেনিসোভ্যানের হাড় নিয়ে জেনোম সিক্যুয়েন্সিং করে প্রমান হাজির করেন যে মানুষ এক সময় নেন্ডার্থ্যাল এবং ডেনিসোভ্যানের সাথে বসবাস শুরু করেছিলো। এবং তাদের মধ্যে মিলনের মাধ্যমে বংশবিস্তারও ঘটেছিল।

(৫) এর ফলে নেন্ডার্থ্যাল এবং ডেনিসোভ্যানের কিছু জিন আমাদের (মানুষের) শরীরে প্রবাহিত হয়। এবং এই জিনগুলো মূলত আমাদেরকে হাই অ্যালটিচিউড বা উচ্চ ভুমিতে বসবাসের উপোযোগী করে তুলে। এছাড়াও সংক্রমণ প্রতিরোধক কিছু জিনও নেন্ডার্থ্যালদের কাছ থেকে আমাদের শরীরে চলে আসে। এতে করে আফ্রিকা থেকে ইউরোপ এবং এশিয়ায় মাইগ্রেট করা মানুষগুলো নতুনভাবে অভিযোজিত হয় যা তাদেরকে নতুন পরিবেশে বাঁচতে সহায়তা করে।

(৬) কোন এক অজ্ঞাত কারণে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে এ পৃথিবী থেকে নেন্ডার্থ্যাল এবং ডেনিসোভ্যান প্রজাতিদুটো বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর আমরা মানুষেরা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরি।

(৭) বর্তমানে আমাদের জেনোম সিক্যুয়েন্সিং করলে সবার শরীরেই প্রায় ১-৬ শতাংশ জিন পাওয়া যায় যা এসেছে নেন্ডার্থ্যাল অথবা ডেনিসোভ্যান থেকে। আর এই জিনগুলোকে একত্রিত করলে দেখা যায় নেন্ডার্থ্যাল অথবা ডেনিসোভ্যানের ৪০ শতাংশ জিন এখনও বয়ে চলছে আমাদের মাঝে!

(৮) তবে যারা কালো আফ্রিকান তাদের শরীরে এই নেন্ডার্থ্যাল বা ডেনিসোভ্যানের কোন জিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। নেন্ডার্থ্যাল বা ডেনিসোভ্যান প্রজাতি দুটো আফ্রিকাতে মাইগ্রেট করেনি। তার আগেই তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

(৯) হিউম্যান ইভোলিউশন বা মানব বিবর্তনে এই জিন প্রবাহের তথ্য উদঘাটনের জন্যই এবার নোবেল পুরস্কার দেয়া হল সান্তে প্যাবোকে।

স্নেহাশিস রায় লিখেছেন, আজ সোয়ান্তে প্যাবো চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেল পেলেন।

তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মানব প্রজাতির বিবর্তন। তিনি গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, মানব গোত্রের দু'টি প্রজাতি নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভান কিভাবে আমাদের মানব প্রজাতি হোমো সাপিয়েন্সের ডিএনএ-এর মাঝে ছাপ রেখে গেছে।

ন্যাচারেলিষ্টরা যখন প্রথম বিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করছিল, তখন চার্চ ও মানুষের উপর ধর্মের প্রভাব ছিল প্রকট।

মানুষ ও শিম্পাঞ্জি যে একই মায়ের দুধ খেয়ে বেড়ে উঠেছে, এই সম্ভাবনাটি ছিল বিবমিষা-জাগানিয়া। যে মানুষ এক জেনারেশানে আগে তাঁদের পিতৃপূরুষের টয়লেটবিহীন জীবনযাপন করার কথা ভাবতে লজ্জা পায়, সেই মানুষ যখন জানতে পারে যে, বনের বানর/শিম্পাঞ্জি তাঁদের ভাই/বোন ছিল একদা, তখন প্রতিক্রিয়া ছিল অবিশ্বাস আর ঘৃণার মিশেলে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে, মানুষের বিশ্বাসের দিক থেকে।

ইহুদী, খ্রীষ্টান, মুসলিমরা বিশ্বাস করে, মানুষের সৃষ্টি হয় কালের একটি নির্দিষ্ট মূহুর্তে; যে মূহুর্তে সৃষ্টি কর্তা অ্যাডাম-ইভকে সৃষ্টি করেছিলেন। বিজ্ঞানীরা যখন বিবর্তনবাদের কথা বলেন, ওল্ড টেষ্টামেন্টের পুরো সত্যটিই তাঁদের কাছে রূপকথা হয়ে উঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। যে ওল্ড টেষ্টামেন্টের ঈশ্বরের মাঝে সকল অনিশ্চয়তার জবাব খুঁজেছে, সেটি মূহুর্তেই পরিণত হয় এক আরব্য রজনীর রূপকথার গল্পে।

ওল্ড টেষ্টামেন্টের গড আর অ্যারাবিয়ান নাইটসের জেনির মাঝে পার্থক্যটা কমে যায়।

মানুষকে যতই বলা হোক তাঁকে অন্ধভাবে অদৃশ্যে বিশ্বাস করতে হবে। দিনশেষে মানুষ এক যৌক্তিক প্রাণী। সে হয়তো স্বীকার করে না, অথবা, স্বীকার করতে ভয় পায়, কিন্তু মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতে থাকে। এই অবস্থাটি মানবজাতির চরিত্রে এক ধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি করে। বিশ্বাসের মাঝে এক সুবিশাল প্রশ্নবোধক সৃষ্টি করে।

বহুদিন ধরে, মানুষ নিজেকে বুঝাতে থাকে যে, বিবর্তন একটা থিওরী মাত্র। এর কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। ল্যাবরেটরীতে কোন পরীক্ষণে এটি প্রমাণিত নয়। যদিও ওল্ড টেষ্টামেন্টের অ্যাডাম-ইভের থিওরীও ল্যাবরেটরীতে প্রমাণিত নয়, তবু মানুষ বিশ্বাস করতে চায়, যা এতোদিন সে জেনে এসেছিল , যা এতোদিন তাঁকে খানিকটা মানসিক স্থিরতা দিয়েছিল, তাই সত্য। বিবর্তন সত্য নয়। ঈশ্বরবিহীন পৃথিবী এক ধরণের মানসিক নৈরাজ্য।

তারপর, বিবর্তন আর ধীরে ধীরে একটা নিছক থিওরী হিসেবে থাকে না। ফসিলের কার্বন ডেটিং-এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অনেক প্রমাণ হাজির করে। বিবর্তনের মাধ্যমে জীবজগত সৃষ্টির সম্ভাবনাটি বেড়ে যেতে থাকে। এর সাথে যুক্ত হয় সব শেষে যুক্ত হয় ডিএনএ।

বানরগোত্রীয় প্রাণীর সাথে আমাদের ডিএনএর সাযুজ্যটি এতোটাই প্রকট যে, মানুষের পক্ষে চরম সত্যটি উপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে উঠে।

যে ইয়োরোপ একদিন বাইবেল নিয়ে প্রশ্ন করা মানুষকে আগুনে পুড়িয়েছে, সেই ইয়োরোপ বিবর্তন নিয়ে কাজ করা একজন বিজ্ঞানীকে পৃথিবীর সম্মানজনক পুরষ্কারটি প্রদান করলো।

পাশ্চাত্যে বড় হওয়া এক শিশুর জন্য হয়তো এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যেখানে বড় হয়ে উঠেছি, সেখানে এটি এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। কারণ , আমাদের প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার পৃথিবীতে ডারউইন পড়াতে গেলে বিদ্যালয়ের শিক্ষককে জেলও খাটতে হয়।

#


মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন,
সুইডিশ বিজ্ঞানী সান্ত পাবো মানব বিবর্তন নিয়ে অনন্যসাধরণ কাজের জন্য শারীরবিদ্যা/মেডিসিনে ২০২২ সালের নোবেল পুরস্কার পেলেন।

যারা মানব বিবর্তন নিয়ে পড়াশোনা করছেন, তাদের কাছে নামটা পরিচিত।

নোবেল কমিটি বলেছে, তিনি আমাদের বিলুপ্ত আত্মীয় নিয়েণ্ডারথালদের জেনেটিক কোড ক্র্যাক করার মত আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটি করতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আধুনিক মানুষের আরেক জ্ঞাতি ভাই ডেনিসোভানদের আবিষ্কার করার ক্ষেত্রেও "চাঞ্চল্যকর" কাজ করেছেন।
সেই যে মৌলিক প্রশ্ন, আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমাদের জ্ঞাতি কারা, সেই জ্ঞাতিরা কেন বিলুপ্ত হয়েছে, কেন হোমো স্যাপিয়েন্স টিকে রইল, কেন আমরা কথা বলতে পারি, আমাদের জ্ঞাতিরা কি কথা বলতে পারত? - এই প্রশ্নগুলো নিয়ে যেসব আণবিক জীববিজ্ঞানী, জনজাতি জিনবিদ, বিবর্তনীয় জিনবিদরা কাজ করছেন সান্ত পাবো তাদের মধ্যে শুধু অগ্রগণ্য নয়, তাঁকে প্যালিওজেনোমিক্স অর্থাৎ প্রত্নজিনবিদ্যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।

বেঁচে থাকা মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা যায়, সে আমরা সকলেই জানি। তবে প্রাচীন কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে আমাদের ইতিহাস, আমাদের পূর্বজ, জ্ঞাতিদের সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। সাম্প্রতিককালে প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পৃথিবীব্যাপী পরিযান নিয়ে তথ্য দিয়েছে। ডেভিড রাইখের নাম আমরা শুনেছি, ভারতের ইতিহাস নির্মাণ প্রসঙ্গে ২০১৯ সালে জনজাতি জিনবিদ্যার বিভিন্ন গবেষণাপত্র নিয়ে খবরের কাগজে রীতিমত রাজনৈতিক ঝড় বয়ে গেছে।

সান্ত পাবো অবশ্য আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আমাদের বিলুপ্ত আত্মীয় নিয়েণ্ডারথালের প্রাচীন কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে সফল হয়েছেন। এই কাজ কতটা কঠিন, একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। হরিয়ানার রাখিগর্হিতে ৪৫০০ বছর আগের হরপ্পীয় সভ্যতার ৬১ টি কঙ্কালের মধ্যে মাত্র ১টির সফল ডিএনএ সিকুয়েন্স করা সম্ভব হয়েছিল দক্ষিণ কোরীয় জিনবিদদের সাহায্যে। সেখানে ৩৫-৪০ হাজার বছর আগের ‘অন্য মানুষে’র কঙ্কালের জিনোম সিকুয়েন্স করা যে অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল, সে আমাদের মত আদার ব্যাপারীরাও বেশ বুঝতে পারি। পাবো চেষ্টা করেছেন, অধুনা লুপ্ত বিভিন্ন মানব প্রজাতির প্রাচীন ডিএনএ থেকে পূর্ণ জিনোম সিকুয়েন্স করে তাদের সঙ্গে আধুনিক মানুষের তুলনা করতে।

আমরা জানি, আধুনিক মানুষ ও ‘নিয়েণ্ডারথাল’-রা নিজেদের মধ্যে মিলনে সক্ষম ছিল। শুধু তাই নয়, তাদের সন্তানরাও পরের প্রজন্মের জন্ম দিতে পেরেছে। আজও তাই আফ্রিকার বাইরে সব মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে ১-৪% ‘নিয়েণ্ডারথাল’ জিন।

আমাদের বিলুপ্ত আত্মীয়দের কাছ থেকে পাওয়া কিছু জিন আজকের মানুষের শরীরবিদ্যাকে প্রভাবিত করে। এরকম একটি উদাহরণ হল EPAS1 জিনের ডেনিসোভান সংস্করণ, যা উঁচু জায়গায় বেঁচে থাকার জন্য তাদের সুবিধা দিয়েছিল, এখন তিব্বতিদের মধ্যে এই জিন পাওয়া যায়। নিয়েণ্ডারথালের জিনও বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের থেকে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

নতুন পথে বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে, প্রাচীন বিলুপ্ত মানবের জিনের সঙ্গে আধুনিক মানুষের জিনের তুলনা করে তার কার্যকারিতা হয়তো চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নতুন পথের সন্ধান দেবে।
অভিনন্দন সান্ত পাবো, অভিনন্দন প্রত্নজিনবিদ্যা, জনজাতি জিনবিদ্যা, বিবর্তনীয় জিনবিদ্যার অনলস বিজ্ঞানীদের। নতুনভাবে নিজেদের চিনতে, জানতে, আমাদের প্রাগিতিহাসকে তুলে ধরতে এই বিদ্যা ভবিষ্যতে নির্ঘাত আরও কার্যকরী হবে।
এই বিষয়ে আগ্রহী আমাদের ছেলেমেয়েরাও হয়তো এমন খবর পেয়ে আরও বেশি করে বিবর্তনীয় জিনবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতে এগিয়ে আসবে।

#

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়