SAHA ANTAR

Published:
2020-10-22 01:07:44 BdST

বটবৃক্ষ মানুষগুলোর সুরক্ষায় যা করণীয়


 

 

অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকল্যাণাচার্য
__________________________

 


‘কেশে আমার পাক ধরেছে বটে, তাহার পানে নজর এত কেন?

পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো সবার আমি একবয়সি জেনো।’

‘ক্ষণিকা’য় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এমনই বলেছেন। বয়সে প্রবীণ হলেও মনে নবীন মন বাসনা কবির।

কবি তাই আরও বলেছেন, ‘ও গো প্রবীণ চলো এবার সকল কাজের শেষে, নবীন হাসি মুখে নিয়ে চরম খেলার বেশে।’

কিন্তু বিশ্বে এখন চলছে যে অজানা–অচেনা, অভিনব ভাইরাসের তাণ্ডব। একে একেবারে তুচ্ছ করার উপায় নেই। এই বিশ্বমারিতে যে প্রবীণরা বেশি ঝুঁকিতে, বলছেন সব বিজ্ঞানী। সঙ্গে যদি থাকে অন্যান্য দীর্ঘকালের অসুখ, তাহলে বিপদ আরও বেশি।

এমন এক প্রেক্ষাপটে ১ অক্টোবর পালিত হল বিশ্ব প্রবীণ দিবস। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলছেন, কোভিড–১৯ পৃথিবীজুড়ে বয়স্ক লোকদের মধ্যে ছড়াচ্ছে ভয়, ভীতি আর দুর্ভোগ। স্বাস্থ্যঝুঁকির বাইরেও আছে কিছু সংকট; দারিদ্র্য, বৈষম্য, নিঃসঙ্গ জীবন হচ্ছে সঙ্গী। উন্নয়নশীল দেশের জন্য তাঁর উদ্বেগ আরও বেশি।

এদিকে ২০২০ থেকে ২০৩০—এই এক দশক ধরে চলবে সুস্থ সজীব বার্ধক্য নিয়ে আন্দোলন।

কেমন আছেন প্রবীণেরা
মাস আটেক আগেও দুজনে একসঙ্গে হাঁটতেন কর্তা-গিন্নি। কর্তার বয়স ৭৪ ছুঁই ছুঁই। আর গিন্নির বয়স ষাট পেরিয়েছে। আধা ঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট যতখানি সম্ভব দ্রুত হাঁটতেন। হাঁটাপথে দুজনের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো। কুশল বিনিময় হতো। ডায়াবেটিস আছে, তাই ডাক্তার বলে দিয়েছেন হাঁটাহাঁটি করতে। হঠাৎ করেই সেই প্রতিদিনের বৈকালিক আনন্দ বন্ধ হলো। মন খারাপ হওয়ার মতো ঘটনা। হাঁটাহাঁটি নেই, তাই দুজনের বিকেলটা ভালো কাটে না। এখন বিকেল মানেই বারান্দায় বসে চা পান, এই করে কি মন ভরে?

এদিকে দুজনেই ঘরবন্দী। ঘর থেকে বেরোনো বারণ। ছেলে রেখেছেন কড়া শাসনে। বাইরের কেউ আসাও মানা। গৃহকর্মীকে বিদেয় করা হয়েছে। ছেলে আর ছেলের বউ ঘর সামলাচ্ছেন। নিজেরা যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, তেমনি মা–বাবাকে মানতে বলেছেন। কড়াকড়ি খুব। বারবার হাত ধোয়া সাবানজল দিয়ে, অন্তত ২০ সেকেন্ড। বউমার কড়াকড়ি, হাত দিয়ে নাক, মুখ, চোখ ছোঁয়া যাবে না। ঘরের বাইরে একটু পা দিলেই মাস্ক পরতে হবে। ঘরে প্রয়োজনে কেউ যদি আসে, তাহলে মাস্ক পরে তিন ফুট দূরে থাকতে হবে। হাত মেলানোর অভ্যাস গেল। কোলাকুলিতে সাময়িক বিরতি দিন। হাত নেড়ে কুশল বার্তা, তা না হলে মাথা নুয়ে।

ছেলে বুঝিয়েছেন, তোমাদের ঝুঁকি বেশি। নিজেও বোঝেন, মনে তরুণ হতে চাইলেও শরীরের ভাঙন কী করে ঠেকাবেন? আর বয়স হলে দেহের ভেতর যে প্রতিরক্ষা আছে, তা দুর্বল হবেই। আর তাই রোগবালাই ধরে বেশি। ফুসফুস সহজে কাবু হয়ে যায়, এই সময়ে নিউমোনিয়া হয়ে গেলে ভয়ানক বিপদ। তাই বাড়ির বয়স্ক মানুষটির দরকার বিশেষ যত্ন।

অনেকে আছেন, যাঁদের ছেলেমেয়ে কাছে নেই, সবাই বিদেশে থাকে। যোগাযোগের উপায় ভিডিও কল। টেলিফোনে মেয়ের গলা শুনে, জামাইকে দেখে, নাতিপুতিকে দেখে তবেই শান্তি মেলে। তা না হলে কী যে মন খারাপ হয় এই বয়সে, সেটা আমিও জানি। ছেলেমেয়ে শান্তিতে আছে জেনে স্বস্তি। জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস চলছে, তাই মন মানাতে হয়।

বয়স্ক মানুষকেও মনে রাখতে হবে, কিছুতেই মন খারাপ করা চলবে না। মনে জোর রাখতে হবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে যতটুকু পারা যায়। সচল থাকবে শরীর। নিজের বাড়ির ভেতর আঙিনা থাকলে বাগান করা যায়। ছাদ থাকলে সেখানেও গাছপালার যত্ন আর হাঁটাহাঁটি করে ভালো সময় কাটানো যায়।

যে ঘরে থাকছেন, সে ঘরে এসি না চালালে ভালো। খোলা থাক জানালা। বাতাস খেলুক। গান শুনুন। বই পড়ুন, মন ভালো হবে। বাড়িতে নাতি-নাতনি থাকলে তাদের সঙ্গেও চমৎকার সময় কাটাতে পারেন।

বাড়ির লোকজনের করণীয়
এই সময়ে ঘরে একটি পালস অক্সিমিটার রাখা ভালো। বয়স্ক ব্যক্তির সুবিধা–অসুবিধার দিকে সব সময় নজর রাখতে হবে। বাড়িতে হাসপাতাল বা ডাক্তারের প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর আগে থেকে নোট বইয়ে টুকে রাখাতে পারেন। গ্লুকোমিটার থাকবে। মা–বাবা বা দাদা-দাদির বয়স হলে রক্তের গ্লুকোজ মেপে দেখতে হবে নিয়মিত। আর থাকবে ডিজিটাল প্রেশার মাপার যন্ত্র। থার্মোমিটার, ওজন মাপার মেশিন ইত্যাদি রাখতে হবে জরুরি প্রয়োজনে।

তবে শুধু যে মানুষটির অসুখ হলেই যত্ন নিতে হবে, তা কিন্তু নয়। তাঁর প্রতিদিনকার যত্ন দরকার। নিজে সব কাজ করতে না পারলে, বাড়ির বাকিরা তাঁকে সাহায্য করতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে।

বয়স্কদের বিষণ্ণতা, অবসাদ বেশি। তাই ঘরের ছোটরা সেদিকে খেয়াল রাখবেন। নানা দুশ্চিন্তা হয়, কী হবে, কী করব, কে দেখভাল করবে। ডাকলে অ্যাম্বুলেন্স আসবে কি না। বাড়ির দায়িত্ববান সদস্যদের উচিত এসব ভাবনা থেকে তাঁকে দূরে রাখা। তিনি যে একা নন, আপনারা যে তাঁর পাশে আছেন সব সময়, সেই অনুভূতিটা তাঁকে বোঝান। তিনি যেন নিজেকে একা না ভাবেন।

জ্বর, মাথা ধরা, শ্বাসকষ্ট হয়, শরীর খারাপ লাগলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এখন তো ফোনে আছে টেলিমেডিসিন সুবিধা। কয়েক সপ্তাহের ওষুধপত্র একবারে কিনে রাখা ভালো।

শরীর ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে। খেয়াল রাখতে হবে, তাঁর ঘুম ভালো হচ্ছে কি না। নতুন চিন্তা যেন না বাড়ে। ঘরে এসব নিয়ে কম আলোচনা হলে ভালো। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে আহার করলে ভালো। পরিবারের বটবৃক্ষ হচ্ছেন বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি। তা কেবল টের পাওয়া যায় তিনি না থাকলেই। ফলে বটের ছায়া পেতে হলে, বটবৃক্ষকে যত্নে রাখা জরুরি। তাঁকে বোঝা মনে করা যাবে না।

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়