Dr. Aminul Islam

Published:
2020-09-14 17:35:36 BdST

সোনার হরিণ : নতুন চাকুরি পর্ব থেকে অবসর পর্যন্ত এক ডাক্তারের আত্মকাহিনি


 


ডাঃ সুকুমার সুর রায়
_____________________

১.

১৯৮৫ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকারি চাকুরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেলাম।
আইসিডিডিআরবির ডাইনামিক চাকরিটি ছেড়ে দিতে হলো। আত্মীয় স্বজনের পরামর্শ মতো সরকারি চাকুরির ' সোনার হরিণ ' কব্জা করার জন্য মতলব থেকে রওনা হয়ে সিরাজগঞ্জ পৌছে গেলাম।
আমার পোষ্টিং হয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলার দুর্গম চর চৌহালি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে।
খোঁজ খবর নিয়ে যতদুর বোঝা গেলো তাতে সিরাজগঞ্জ থেকে বাসে চেপে বেলকুচি হয়ে এনায়েতপুর পৌছাতে হবে।
একটি বড় স্যুটকেসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বোঝাই করে নিলাম।
১১ই জুলাই সিরাজগঞ্জের চালা বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি মিনিবাসে উঠে বসতেই একজনের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। মনে হলো বেশ পরিচিত। কিন্তু লোকাল বাসের হৈ হট্টগোলের মাঝে কথা বলার সুযোগ হলো না।
লক্কর বাসের ঘন্টা দেড়েকের ভয়ানক জার্নির পর বেলকুচির চালা বাসস্ট্যান্ডে বাস দাঁড়িয়ে গেলো।
এইটিই জার্নির শেষ। এরপর আর বাস চলে না।
নামার পর বাসের ভিতরে চোখাচোখি হওয়া ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো। তার নাম ডাক্তার আলতাফ হোসেন। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা আমার হবু কলিগ। এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে আমার মতই চৌহালি হেলথ কমপ্লেক্সে জয়েন করতে যাচ্ছেন।
পরিচিত হয়ে খুব ভালো হলো। দুইজনের গন্তব্য একই। দুইজনই সদ্য সরকারি অফিসার হিসাবে যোগদান করতে যাচ্ছি। দুইজনের কারোরই হবু কর্মস্থল সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা নাই। তা না থাকুক, তবে দুইজনের চোখেমুখে এক অফিসার সুলভ ভাব আছে।
যাইহোক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেলো বেলকুচি থেকে ছয় সাত কিলোমিটার হেঁটে এনায়েতপুর পৌঁছাতে হবে।
হাঁটা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই।
ভাঙ্গা চোরা, মাঝে মাঝে ইট বিছানো, কাঁচা রাস্তা ধরে দুইজনকে হাঁটা শুরু করতে হলো।
বেলকুচি ছাড়িয়ে আজুগড়া গ্রাম পর্যন্ত পৌছাতেই দফারফা হয়ে গেল। একেতো ভারি স্যুটকেস , মাথার উপরে তীব্র রোদ, তার উপরে এবড়ো খেবড়ো রাস্তা।
দুইজন তরুন হবু মেডিকেল অফিসারের চেহারায় যে চকচকে অফিসার অফিসার ভাব ছিলো তা একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
বেতিল বাজারের কাছে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করায় তিনি একটি ডাক্তারখানা দেখিয়ে দিলেন।
সেখানকার সিনিয়র একজন ডাক্তার লুতফর রহমান আমাদেরকে যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন। তিনি বললেন যে - " আপনাদের অফিস পাশের 'খামারগ্রাম' নামক জায়গায়।" অফিসে পৌছে দেওয়ার জন্যে আমাদের সাথে একজন লোক দিয়ে দিলেন তিনি।
আরো আধা ঘন্টা হাঁটার পর লোকটি আমাদেরকে একটি লম্বা টিনের ঘরের সামনে নিয়ে দাঁড় করালেন।
দেখলাম একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে! তাতে লেখা আছে - " উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়, চৌহালি, সিরাজগঞ্জ। "
অবশেষে আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাক্তার খবিরউদ্দিন স্যারের রুমে উঁকি দিতেই তিনি বললেন - " আসেন, আসেন, তাড়াতাড়ি জয়েন করেন, আমি এক্ষুনি চলে যাবো। "
খবির স্যারের বাড়ি রাজশাহীতে।
বহুল প্রতিক্ষিত মেডিকেল অফিসার পদে জয়েন করার পর তিনি বললেন যে, " আমাদের হাসপাতাল নদীর ওপারের চরে।
আগামীকাল আপনারা ওপারে চলে যাবেন। আমি এখুনি রাজশাহী রওয়ানা হচ্ছি। দুইদিন পর সরাসরি ওপারে চলে আসবো।
আমার কলিগ ডাক্তার আলতাফ হোসেন বললেন যে, " স্যার আমাকে দুই দিনের ছুটি দেন, আমি বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে একবারে প্রস্তুত হয়ে আসবো ।"
তার ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেলো। আমি একা একা রয়ে গেলাম।
বেলা তিনটায় অফিসের পিয়ন মুসলেমউদ্দীন আমাকে অফিসের পিছনের রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো - " স্যার এখানেতো কোন হোট্যাল মোট্যাল নাই, কোন খাওয়া দাওয়া পাইব্যেন না। আপনার জন্য আলুভত্তা ভাত পাক কর‍্যেছি, খাইয়্যা লন।"
রাতে অফিসের একটি লম্বা টেবিলের উপরে ঘুমানোর ব্যবস্থা হলো। মুসলেমউদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করলাম -" ওপারের অফিস কী এইরকমই?" মুসলেমউদ্দীন বললো - " না, ওপারে নতুন হাসপাতাল বিল্ডিং হয়্যেছে,কোয়াটার আছে, আপনেরা আইস্যা পড়ছেন এখন উদ্ভোদন হয়্যা যাইব্যো। "
কিছুতেই ঘুম আসছিলো না। টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। আগামীকাল ভোর ছয়টায় এনায়েতপুর ঘাট থেকে লঞ্চে চেপে যমুনার ওপারে চৌহালি উপজেলা হাসপাতালে পৌছাতে হবে।

২.

জেগেই ছিলাম । তারপরেও ভোর পাঁচটায় মুসলেমউদ্দীন আমাকে ডেকে দিলো - " স্যার, ওঠেন। রেডি হন। ছয়টার আগেই লঞ্চঘাটা যাইতে হইব্যো। "
আমি বললাম - " এত সকালে উঠতে হবে কেন? এরপরের লঞ্চে যাই। "
মুসলেম বললো - " না স্যার, এরপরে কোন লঞ্চ নাই। সারাদিনে একটাই লঞ্চ। "
অগত্যা উঠে রেডি হতে হলো।
মুসলেম আমাকে লঞ্চে তুলে দিলো এবং একজন ভদ্রলোকের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো - " আমাগারে নতুন স্যার। "
জানা গেলো ওনার নাম আব্দুল মতিন এবং উনি চৌহালিতে বছর খানেক হলো আছেন কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার হিসাবে।
কিছুক্ষনের মধ্যে ছোট্ট লঞ্চটি যাত্রী দিয়ে কানায় কানায় ভরে গেলো।
লঞ্চ ছাড়তেই যমুনার প্রচন্ড স্রোতের ঘুর্নিতে একদিকে ভয়ানক ভাবে কাত হয়ে যেতে লাগলো!
আমার ভয়ার্ত চেহারা দেখে মতিন সাহেব সাহস দিলেন -- " ভয় নাই, ও কিছু না, লোকজন স্থির হয়ে বসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। "
আমি বললাম -' আপনি কতদিন পর পর যাতায়াত করেন? '
তিনি বললেন - " প্রতি সপ্তাহেই। "
প্রচন্ড স্রোতের টানে লঞ্চ ভাটির দিকে তর তর করে এগিয়ে চললো।
পুর্বদিকে তাকিয়ে অনেক দুরে গ্রামের রেখা দেখা যেতে লাগলো।
' আচ্ছা পুর্বদিকে ঐযে দুরে গ্রাম দেখা যায় ওইখানেই যদি যেতে হয়, তাহলে লঞ্চ সোজা দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে কেন! ?'
মতিন সাহেব বললেন - " যে গ্রাম দেখতে পাচ্ছেন, ওটা হলো মাঝখানের চর!
ওই চরের ওদিকে আবার নদী আছে , সেই নদীর ওপারে চৌহালির হেডকোয়ার্টার। তবে তা এই সোজাসুজি নয়। দক্ষিনে অনেক দুর যাওয়ার পর লঞ্চ পুর্বদিকে টার্ন নিবে। "
' তা সেখানে পৌছাতে কত সময় লাগবে? '
" দশ টা নাগাদ পৌছে যাবো ইনশাআল্লাহ। "
' এই লঞ্চ কী শুধু সেখানেই যাতায়াত করে? '
" না, লঞ্চ প্রথমে পুর্বপারে মিরকুটিয়া ঘাটে আমাদের নামিয়ে দিয়ে ভাটির দিকে গিয়ে আবার পশ্চিম পারে নগর বাড়ি ঘাটে থামবে। তারপর আবার পুর্ব পারে আরিচাঘাটে গিয়ে আজ রাতের মতো লঞ্চ সেখানে থেকে যাবে। আজ ভোরে আরিচা ঘাট থেকে অন্য আরেকটি লঞ্চ ছেড়েছে। সেটা নগরবাড়ি, মিরকুটিয়া হয়ে এনায়েতপুর পৌছাবে সন্ধ্যায়। এই রকম ভাবে দুইটি লঞ্চ এই রুটে আপ- ডাউন করে। "
এর আগে অবশ্য একাধিকবার যমুনা নদী পার হয়েছি।
সিরাজগঞ্জ - জগন্নাথগঞ্জ রুটে স্টিমারে।
সিরাজগঞ্জ- ভুয়াপুর রুটে লঞ্চে এবং নগরবাড়ি - আরিচা রুটে ফেরিতে। কিন্তু এইরকম অদ্ভুত রকমের রুটে এই প্রথম।
যমুনা নদীর বিশালতা! তার বিভিন্ন ধারা উপধারা ও গতি প্রকৃতি দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নাই!
বেলা দশটায় লঞ্চ যেখানে দাঁড়ালো সেই জায়গার নাম মিরকুটিয়া ঘাট। যদিও ঘাট বলে কোন কিছু বোঝা গেলো না। কয়েকটি দেশি নৌকা দাঁড়িয়ে আছে মাত্র।
এবার নামার পালা।
লঞ্চ থেকে নামার ব্যবস্থা দেখে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলো!
একটি চিকন তক্তার মত নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই চিকন তক্তা বেয়ে সার্কাসের ব্যালেন্স খেলার মতো ব্যালান্স করতে করতে লোকজন হাঁটু জলের মধ্যে গিয়ে নেমে পড়ছে!
একবার পায়ের জুতার দিকে, আরেকবার চিকন তক্তার দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকাতেই মতিন সাহেব বললেন, " একটু দাঁড়ান। "
তিনি হাঁক দিলেন - " এই শিবিরের নৌকার মাঝি, এইদিকে তক্তার সাথে লাগিয়ে দাও।"
অতঃপর তক্তা বেয়ে সরাসরি নৌকায় নামা সম্ভব হলো।
শিবিরের যাত্রীরা নৌকায় ওঠা শেষ হলে নৌকা ছেড়ে দিলো।
বলে রাখা ভালো চৌহালি উপজেলা হেডকোয়ার্টার ' শিবির' নামে পরিচিত।
' শিবির ' নামের ইতিহাস আছে, সে অন্য আরেকদিন বলা যাবে।
নৌকা চলা শুরু করার পরেও আশে পাশে কোথাও কোন দালান কোঠা দেখা গেলো না।
একটি গ্রাম পার হওয়ার পরে দিগন্ত রেখায় ছোট ছোট বিল্ডিং দেখা গেলো।
মতিন সাহেব বললেন - " ডাক্তার সাহেব, ঐ যে শিবির দেখা যায়! হাতের ডানের বিল্ডিং গুলিই আপনার হাসপাতাল!
আধা ঘন্টা খানেক চলার পর একটি ছোট্ট বাজারের ঘাটে আমরা নেমে পড়লাম।
একটি কাঁচা রাস্তা ধরে সোজা পুর্বদিকে যেতে যেতে মতিন সাহেব ধারা বিবরনীর মতো বলতে লাগলেন - " ডানপাশে গার্লস স্কুল, এরপর অফিসারদের ডরমিটরি। বাম পাশে ইউএনও অফিস, তারপর উপজেলা কোর্ট। সোজা নাক বরাবর যে বিল্ডিং দেখছেন ওটা হলো থানা। থানার দক্ষিন পাশে আপনাদের হাসপাতাল। "
হঠাৎ দেখলাম একজন মধ্যবয়সী অভিজাত চেহারার মানুষ পেছনে পেছনে আট দশ জন লোকের এক বহর নিয়ে জমিদারি স্টাইলে হেলেদুলে সোজা আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন।
মতিন সাহেব বললেন -- " ওই যে ভদ্রলোক আসছেন, উনি এখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান। ওনার নাম ফারুক রেজা চৌধুরী। উনিই এই চরের রাজা! "
কাছাকাছি হতেই মতিন সাহেব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন -- " নতুন মেডিকেল অফিসার সাহেব এলেন ! "
চেয়ারম্যান সাহেব আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বিগলিত ভঙ্গিতে বললেন - " আসেন, আসেন, আগে জয়েন দ্যান, পরে কথা হবে। "
৩.
আমাদের হাসপাতালের উত্তর পাশের বাউন্ডারি ওয়ালের ওপাশে থানা বিল্ডিং। হাসপাতালের পশ্চিম পাশ দিয়ে একটি কাঁচা রাস্তা চলে গেছে সোজা দক্ষিনে জ্যোতপাড়া হাটখোলার দিকে।
হাসপাতালের ক্যাম্পাস এরিয়া নিতান্ত ছোট নয় । ক্যাম্পাসের উত্তর- পশ্চিম কোনায় রাস্তা সংলগ্ন প্রথমেই অফিসারদের কোয়ার্টার। অফিসার্স কোয়ার্টারের সামনে বিশাল ফুটবল মাঠ। মাঠের দক্ষিন প্রান্তে হাসপাতাল বিল্ডিং। অফিসার্স কোয়ার্টারের পুর্বদিকে নার্সদের ডরমিটরি। তারও পুর্বদিকে তৃতীয় শ্রেণির কোয়ার্টার। তৃতীয় শ্রেণির কোয়ার্টারের সামনে চতুর্থ শ্রেণির কোয়ার্টার। তার দক্ষিনে বিশাল পুকুর।
এই পুকুর ও হাসপাতাল বিল্ডিংয়ের দক্ষিন পাশে অনেকখানি খোলা জায়গা। তারপর বাউন্ডারি ওয়ালের সামনেই দিগন্ত বিস্তৃত ধানখেত।
ইতিমধ্যে আরো দুইজন কলিগ জয়েন করেছে।
আমাদের চারজন মেডিকেল অফিসারের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে প্রথম শ্রেণির কোয়ার্টারে। তবে ফ্ল্যাট হিসাবে নয়। ডরমিটরি হিসাবে। কারন আমরা সবাই ব্যাচেলর।
মোট পাঁচটি ফ্ল্যাট। পশ্চিম দিকের দোতলার ফ্ল্যাটটি উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব দখল করে আছেন এবং সপরিবারে বসবাস করছেন।
উপজেলা চেয়ারম্যান কেন হাসপাতালের ডাক্তারদের কোয়ার্টার দখল করে আছেন এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নাই।
তবে এটুকু সবাই জানে যে, আমাদের এই উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব নাকি দম্ভভরে বলেন যে - " উপরে এরশাদ, নীচে ফারুক রেজা ! মাঝখানে কেউ নাই। থাকার কথাও নয়! তাই এবিষয়ে আমাদেরও মাথা ব্যাথার কিছু ছিলো না।
কোয়ার্টারে আমাদের থাকার জন্য বেড, চেয়ার, টেবিল, মায় মশারী চাদরের ব্যবস্থা পর্যন্ত হয়ে গেছে! সবই অবশ্য অফিসের বড় বাবুর কল্যানে!
আমাদের অফিস টাইম সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত।
প্রথম দিন আইসিডিডিআরবির অভ্যাসমতো টাইমলি হাসপাতালে গিয়ে বেইজ্জত হতে হলো।
সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে গিয়ে দেখলাম সব তালাবদ্ধ!
সুইপার বারান্দা ঝারু দিচ্ছে। আমার ইতস্তত ভাব দেখে সুইপার মিলন খাতুন বললো - " ছার, নতুন আসিছেন! দশটার আগে কেউ অফিসে আসে না। "
আমি আর কোয়ার্টারে ফিরে না গিয়ে হাসপাতালের আঙ্গিনা ও পুকুর পাড়ে
পায়চারি করে সময় কাটাতে লাগলাম।
কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম প্রকৃত পক্ষে কোন কাজ নাই।
দশটা থেকে বারোটার মধ্যে আউটডোরের কাজ শেষ হয়ে যায়।
তারপর দলবেঁধে এ অফিস সে অফিস ঘুরে বেড়ানো, চা খাওয়া আর আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো ছাড়া তেমন কিছু করার নাই।
একদিন দুপুর বেলা কোয়ার্টারে লাঞ্চ শেষে আমরা কয়েকজন উচ্চৈঃস্বরে গল্পগুজবে মেতে ছিলাম।
হঠাৎ চেয়ারম্যান সাহেব নিঃশব্দে দরজা ঠেলে আমাদের ঘরে প্রবেশ করলেন। আমরা থতমত খেয়ে গেলাম। শশব্যস্ত হয়ে তার দিকে চেয়ার এগিয়ে দিলাম!
তিনি চেয়ারে না বসে আস্তে আস্তে বললেন , " আপনাদের ভাবি আজ পনেরো দিন হলো অসুস্থ! তার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে! এই মূহুর্তে খুবই খারাপ অবস্থা। আপনারা দয়া করে একটু দেখে যান কী করা যায়। "
আমি এবং ডাক্তার রবিউল সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীর যে অবস্থা দেখলাম তা এক কথায় ভয়াবহ!
ব্লিডিং হতে হতে রক্তশুন্য হয়ে তিনি একদম সাদা কাগজের মত সাদা হয়ে গেছেন!
চেয়ারম্যান সাহেবকে বলা হলো "ইমেডিয়েট হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দিতে না পারলে ওনাকে বাঁচানো যাবে না।"
সিদ্ধান্ত হলো ঢাকা যেতে হবে। কারন সিরাজগঞ্জ কিংবা টাংগাইলে যেতে যে সময় লাগবে সেই একই সময়ে ঢাকা যাওয়া সম্ভব।
চেয়ারম্যান সাহেব হঠাৎ খপ করে আমার হাত ধরে ফেললেন। বললেন - " আপনাকে সাথে যেতে হবে। "
এমত পরিস্থিতে ' না' বলার কোন সুযোগ ছিলো না।
নার্সকে ডেকে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়ে, একটি স্ট্রেচারে করে রোগীনিকে স্পিডবোটে তোলা হলো।
ধলেশ্বরী নদীর দুইতীরে প্রবল ঢেউ তুলে দ্রুত গতিতে স্পিডবোট ঢাকার দিকে ছুটে চললো।
বোটেই আরেকবার পরীক্ষা করে দেখলাম প্রেশার খুব কমে গেছে! দুর্বল পালস খুব জোরে চলছে! ঢাকা পর্যন্ত পৌছানো যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে!
আমাকে এখন অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে।
স্পিডবোট সদরঘাটে পৌছাবে। সেখান থেকে গাড়ির ব্যবস্থা কেমনে হবে! ঢাকা মেডিকেলে যাবো, নাকি অন্য কোন প্রাইভেট ক্লিনিকে যাবো!?
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলাম, প্রাইভেট ক্লিনিকেই যাবো।
ঘন্টা খানেক চলার পর একটা বাজার মত জায়গা দেখা গেলো। ওদের জিজ্ঞাসা করলাম "এটা কোন জায়গা?"
জানা গেলো এটা মানিকগঞ্জের নয়ারহাট।
সেখানকার ঘাটে স্পিডবোট দাঁড়াতে বললাম, কারন জরুরি ওষুধ নিতে হবে।
স্পিডবোট থেকে নেমে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে ফিরে আসতেই দেখলাম, পাশেই ধামরাই উপজেলা হাসপাতাল। সেখানে একটি এম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা আইডিয়া খেলে গেলো! এই এম্বুল্যান্স নিয়েই ঢাকায় যাবো!।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের কথা বলে - " এম্বুল্যান্স বুক " করে ফেললাম।
তারপর ঘাটে পৌছাতেই ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো!
চেয়ারম্যান সাহেব ও তার ছেলে মেয়েরা রোগিণীকে জড়িয়ে ধরে ভয়ানক কান্নাকাটি শুরু করেছে! স্পিডবোটের লোক দুইজন জোরে জোরে সমানে ' লাই লাহা ইল্লাল্লাহু ', লাই লাহা ইল্লাল্লাহু ' বলে দোয়া দরুদ পড়ে চলেছে!!
আমি হতভম্ভের মতো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতে পারলাম হয়তো মারা গেছে!
পরক্ষনেই মনে হলো আরে আমিতো ডাক্তার!
হয়তোবা মারা গেছে বললেতো হবে না!
আমাকে ভালোভাবে দেখতে হবে। তারপর "মৃত্যুর ঘোষনা " আমাকেই দিতে হবে!!

৪.

ঘাটের পাড় থেকে দ্রুত নেমে বোটে উঠে রোগীনিকে পরীক্ষা করে দেখলাম মারা যায়নি! তবে অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন!
আমাকে দেখে সবার কান্নাকাটি থেমে গেলো। স্যালাইনের গতি বাড়িয়ে রানিং রেট করে দিলাম। কিছু ইঞ্জেকশন স্যালাইনের টিউবে পুশ করে দিলাম। স্পিডবোটের লোকদের বললাম স্ট্রেচার ধরে উপরে এম্বল্যান্সে তুলতে হবে।
এম্বুল্যান্স প্যাঁ পুঁ, প্যাঁ পুঁ, সাইরেন বাজাতে বাজাতে দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে ছুটে চললো। এক ঘন্টারও কম সময়ে ড্রাইভার প্রথম একটি ক্লিনিকের দোরগোড়ায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিলো।
দ্রুত নেমে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো বেড খালি নাই।
সেখান থেকে বের হয়ে দ্রুত ' সোহান ক্লিনিকের' দিকে যাত্রা করতে হলো। ভাগ্য ভালো তখন রাস্তাঘাটে এখনকার মতো জ্যাম ছিলো না এবং এম্বুল্যান্স ড্রাইভারের সব কিছু নখদর্পনে ছিলো। 'সোহান ক্লিনিকে' গিয়ে জানা গেলো বেড আছে,কিন্তু গাইনির ডাক্তারকে আজ পাওয়া যাবেনা।
এরপরে আমরা দ্রুতগতিতে পৌছে গেলাম মহাখালীর - " মেট্রোপলিটন মেডিকেল সেন্টারে "।
সেখানে নেমে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারকে নিজের পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বললাম।
তিনি দ্রুত রোগি নামাতে বললেন।
রোগীকে পরীক্ষা করতে করতেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কী কী দেওয়া হয়েছে?
আমি স্যালাইন থেকে শুরু করে সব ওষুধের নাম বলে দিলাম। ডাক্তার সাহেব চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন - " উনি যা কিছু করেছেন, তার জন্যই রোগী এখনো টিকে আছে। যাই হোক,এখন প্রচুর রক্ত লাগবে, আপনাদের কোন ব্লাড ডোনার থাকলে তাদের খবর দেন। "
ভর্তি হওয়ার পর দুই হাতে টানা রক্ত চলতে লাগলো। পাশাপাশি সব পরীক্ষানীরিক্ষা হতে থাকলো।
পাঁচ ব্যাগ রক্ত যাওয়ার পর গাইনির ম্যাডাম রাত এগারোটার সময় ওটিতে ঢুকলেন।
রাত সাড়ে বারোটায় অপারেশন শেষ হলো।
রাত্রি একটায় যখন রোগিকে কেবিনে দেওয়া হলো, তখন চেয়ারম্যান সাহেবকে বলে আমি বিদায় হতে চাইলাম।
আবারো তিনি খপ করে আমার হাত ধরে ফেললেন।
যদিও একজন সার্বক্ষণিক সিস্টার দায়িত্বে ছিলেন, তথাপি আমি চেয়ারে বসে রইলাম।
চেয়ারম্যান সাহেব মেঝেতে একখানা চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
রাত চারটার সময় হঠাৎ তিনি ধড়ফড় করে উঠে চোখ মুছতে মুছতে আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে জোর করে সেই চাদরের বিছানায় আমাকে শুইয়ে দিলেন।
পরদিন সকালে রোগীকে ভালো অবস্থায় রেখে ছোট ভাইয়ের হোস্টেলে গেলাম ফ্রেশ হতে।
বিকালেই হাসপাতালে ফিরে যেতে হলো। কারন চেয়ারম্যান সাহেবকে কথা দিয়েছিলাম বিকালে অবশ্যই থাকবো।
গাইনির ম্যাডামের সাথে কথা হলো। তিনি বললেন কম পক্ষে পাঁচ দিন হাসপাতালে থাকুক, তার পর নিয়ে যেতে পারবেন।
আমি বিদায় নিতে চাইলেও চেয়ারম্যান মহোদয় আমাকে কিছুতেই ছাড়লেন না।
তিনি বললেন পাঁচদিন পর একসাথেই ফেরা হবে।
পাঁচদিন পর কথা হলো আগামীকাল তারা রোগী নিয়ে নয়ারহাট হয়ে স্পিডবোটে চৌহালি ফিরে যাবেন।
আমি আমার মতো বাড়ি হয়ে দুইদিন পর চৌহালি ফিরবো ।।
(------ চলবে ---------)

 

ডাক্তার প্রতিদিনে প্রকাশিত পরবর্তী ৪ পর্ব অর্থাৎ পঞ্চম পর্ব থেকে অষ্টম পর্ব পড়ুন নিচের লিঙ্কে

https://daktarprotidin.com/medical-camp/5764/%E0%A6%B8%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A3-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%80-%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%8F-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B2-%E0%A6%93-%E0%A6%86%E0%A6%A7%E0%A6%BE-%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B2-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9F

প্রিয় পাঠক, এই লেখার পরবর্তী ৯-১২ কিস্তি লিঙ্ক

https://daktarprotidin.com/medical-camp/5767/%E0%A6%B8%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A3-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%AE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A6%95%E0%A6%A1%E0%A7%81-%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A1%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BF

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়