DR. MOHITUZZAMAN

Published:
2020-07-21 03:29:58 BdST

যে 'ষড়যন্ত্রে' কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে এমবিবিএস পাশ করানো হয় নি



অমিত কুমার / ডা. মোহিতুজ্জমান
______________________

হ্যাঁ। ঠিকই পড়েছেন। ১৮৬১ সালের ১৮ জুলাই ভাগলপুরে শ্রী ব্রজকিশোর বসুর ঘরে জন্মানো, এই প্রাতঃস্মরণীয়া মহীয়সী ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট কাদম্বিনী গাঙ্গুলী; (চন্দ্রমুখী বসুর সাথে) হলেও, ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস তিনি ছিলেন না। নারীবিরোধী শিক্ষকেরা তাঁকে এমবিবিএস ডিগ্রি পেতে দেন নি।

লেখিকা লীলা মজুমদার কাদম্বিনী দেবীর আত্মীয়া ছিলেন। তিনি তাঁর পাকদণ্ডী গ্রন্থে স্মৃতিচারণা করেছেন, “তাঁর জীবনটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তার অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বয়সে জ্যাঠাইমার (বিধুমুখী– দ্বারকানাথের প্রথমপক্ষের কন্যা) চাইতে সামান্য বড় ছিলেন, দেখে মনে হত অনেক ছোট। মস্ত দশাশই চেহারা, ফুটফুট করত গায়ের রঙ, থান পরে এবং এত বয়সেও রূপ চাপা পড়ত না, তবে কেমন একটু কড়া ধরনের ভাব। আমরা দূর থেকে দেখতাম।” এই বর্ণনাটুকুই মহীয়সীকে মানসপটে কল্পনা করে নেবার জন্যে যথেষ্ট হবে বলে মনে করছি।

কাদম্বিনী দেবীর পিতা ব্রজকিশোর বাবু নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। নিজের প্রিয় কন্যাকে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ করে দিতে, তিনি তৎকালীন হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতা করেও ১৩ বছরের কাদম্বিনীকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন।
কলকাতায় দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী দুর্গামোহন দাসের সাথে মেয়েদের জন্যে একটি বোর্ডিং স্কুল চালাতেন... 'হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়'। কাদম্বিনী এই স্কুলেরই ছাত্রী ছিলেন। পরে অবশ্য নানা টানাপোড়েনে স্কুলটি বেথুন স্কুলের সাথে মিশে যায়।

কাদম্বিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে আরেক সমস্যা দেখা যায়। নারীদের জন্যে কলকাতায় স্কুল তৈরী হলেও, কলেজ তখনও ছিল না। শেষ পর্যন্ত বেথুন স্কুলকেই কলেজে রূপান্তরিত করা হল। একজন ছাত্রী ও একজন শিক্ষক নিয়ে শুরু হল বাংলার প্রথম মহিলা কলেজ।
এই কলেজ থেকেই গণিতে বিএ পাস করেছিলেন তিনি (জানুয়ারি, ১৮৮৩)। শোনা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের দিন দুই নারীর ডিগ্রি পাওয়া দেখতে সেদিন বিরাট জনসমাগম হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।

চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার জন্যে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে তিনি প্রথম আবেদন করেছিলেন, ১৮৮১ সালে। বলাই বাহুল্য, কর্তারা সে আবেদন ধর্তব্যের মধ্যেও আনেন নি। দুবছর পরে বিএ পাস করে, কাদম্বিনী আবার আবেদন করেছিলেন। এবারে তাঁর আবেদনকে গ্রাহ্য করতেই হয়েছিল। ১৮৮৩র ২৯শে জুন কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তাঁর আগেই অবশ্য বাংলার সমাজজীবনে আরেকটি বিপ্লব ঘটিয়ে তিনি ব্রাহ্ম দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে বিয়ে করে ফেলেছেন।
সুন্দরী বিদুষী কাদম্বিনী প্রায় দ্বিগুণ বয়েসের দোজবর পুরুষকে বিবাহ করেছিলেন বলে সেসময়ে সমালোচনা হয়েছিল খুব। কিন্তু কাদম্বিনী-দ্বারকানাথের দাম্পত্য ছিল ব্যতিক্রমী। কাদম্বিনী সম্ভবত এমন এক জনকে জীবনসঙ্গী করতে চেয়েছিলেন, যিনি উদারমনস্ক হবেন এবং নারী স্বাধীনতা নিয়ে কেবল বুলি না আউড়ে সত্যিই সেই আদর্শে অটল থাকবেন। সেই দিক থেকেই তিনি দ্বারকানাথকে পছন্দ করেছিলেন।

কাদম্বরীকে 'Bachelor of Medicine' পরীক্ষায় পাস করানো হয় নি। শোনা যায়, মেডিসিনের শিক্ষক ডাঃ রাজেন্দ্র চন্দ্র তাঁকে মেডিসিনের মৌখিক পরীক্ষায় এক নম্বর কম দিয়ে ফেল করিয়ে দিয়েছিলেন।
এই অন্যায়টা টের পেয়েছিলেন অধ্যক্ষ জে এম কোটস্। তিনি নিজের ক্ষমতাবলে ১৮৮৬ সালে কাদম্বিনীকে Licentiate of Medicine and Surgery (LMS) সার্টিফিকেট পাইয়ে দেন।
কিন্তু দুবছর LMS পড়েও ফাইনাল পরীক্ষায় কাদম্বিনী ডাঃ চন্দ্রের বিষয়ে ফেইল করে যান। শেষ অব্দি অধ্যক্ষ কোটস্ তাঁকে Graduate of the Medical College of Bengal (GMCB) ডিগ্রি পাইয়ে দিয়ে ডাক্তারি করার ছাড়পত্র দিয়ে দেন।

কাদম্বিনীই প্রথম মহিলা চিকিৎসক যিনি 'দ্য প্যাট্রিয়ট' এর মতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। কিন্তু তাতে কী হয়, প্রথাগত ডিগ্রি ছিল না বলে তখন তো তাঁকে কম কটূক্তি, কটাক্ষ সহ্য করতে হচ্ছিল না! সেই সমস্ত বক্রোক্তির জবাব দিতে ১৮৯৩ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি তিনি একাই বিলেত যাত্রা করেন। তাঁর আট সন্তানকে দেশে ফেলে রেখে একার উদ্যমে লন্ডনের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনটি ডিগ্রি অর্জন করেন। কলকাতায় ফেরার পরে ‘বামাবোধিনী’ বা ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’-এর মতো কাগজগুলি তাঁর তুমুল প্রশংসা করে।
কিন্তু বিরোধিতায় ইতি পড়েনি তখনও। চিকিৎসক কাদম্বিনী তাঁর যোগ্যতার পদ বা চাকরি পাননি। কিছু দিন ডাফরিন হাসপাতালে সিনিয়র ডাক্তারের চাকরি করে ইস্তফা দিয়ে নিজের বাড়িতে চেম্বার খুলে পুরোপুরি প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। পসার জমে ওঠে দ্রুত।

চিকিৎসক হিসেবে কাদম্বিনীর নিষ্ঠা ও দায়িত্বপরায়ণতার কথা বলে শেষ করা যায় না। একটা উদাহরণ দেয়া যাক।
দ্বারকানাথের যে দিন মৃত্যু হয়, সে দিন বিকেলে কলকাতার এক জমিদার বাড়ি থেকে কাদম্বিনীকে প্রসব করানোর জন্য ‘কল’ দেওয়া হয়। সকালে স্বামীহারা চিকিৎসক বিকেলে তাঁর ব্যাগপত্র নিয়ে সেখানে রওনা দেন। হতবাক ও অসন্তুষ্ট আত্মীয়দের বলেছিলেন, ‘‘যে গেছে সে তো আর ফিরবে না, যে নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসছে তাকে তো আনতে হবে!’’
নেপালের রাজা জঙ বাহাদুরের অন্দরমহলে ঢুকে কাদম্বিনী রাজমাতার অসুখ সারিয়ে ফিরেছিলেন
রাজার পুরষ্কারের মধ্যে একটি টাট্টু ঘোড়াও ছিল। এই টাট্টু ঘোড়ায় টানা ফিটনে চড়েই কাদম্বিনী কলকাতার বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করে এসেছেন। রাত-বিরেত ঝড়-বাদল কোনো কিছুই তাঁর সেবার আদর্শের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।

জীবনের শেষ দিন অব্দি তিনি চিকিৎসা করে গেছেন। ১৯২৩ সালের ৩রা অক্টোবর দুপুরে, হাসপাতালে থেকে জটিল অস্ত্রোপচার সেরে বাড়িতে ফিরে পুত্রবধূ সরলাকে পরিতৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘‘আজকের অপারেশন দেখলে আর কেউ বলতে পারবে না যে, ডাক্তার গাঙ্গুলির আর অপারেশনের হাত নেই।’’
এই পরিতৃপ্তির হৃদয়ভার নিয়ে, সেইদিনই তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। শেষ হয় মহীয়সীর জীবন।

দুটি বাংলা চ্যানেলে কাদম্বিনী দেবীর নামে ধারাবাহিক শুরু হয়েছে। ধারাবাহিকের গল্পে কতটা সত্য থাকবে, তা আমার জানা নেই। কিন্তু এই মহীয়সী নারীর জীবনসংগ্রামের একাংশও যদি তারা ফুটিয়ে তুলতে পারে, ডাঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর অপার জীবনীশক্তির সামান্য অংশও যদি তাতে আমাদের ভারতবর্ষের অবহেলিতা বঞ্চিতা নারীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তবে তাঁর জীবনভর পরিশ্রমের প্রতি একটু হলেও সম্মান জ্ঞাপন করা হবে।
সৌজন্য আনন্দবাজার পত্রিকা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়