Ameen Qudir

Published:
2019-10-11 06:15:17 BdST

আত্মহত্যার প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা: “৪০ সেকেন্ডে পদক্ষেপ” নেবার দিন



মনোবিকাশ প্রতিবেদন
___________________________

১০ই অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে পারি। এবছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হল আত্মহত্যা প্রতিরোধ। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেন। এবছর, আমরা আপনাদের আহ্বান জানাই ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক কোন পদক্ষেপ নিতে, যেন:
• বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে আত্মহত্যার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়;
• আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা বৃদ্ধি হয়;
• আত্মহত্যার সাথে জড়িত সামাজিক গ্লানি কমিয়ে আনা যায়;
• বিপর্যস্ত মানুষদের জানানো যায় যে তারা একা নয়।
প্রধান প্রধান তথ্য এবং পরিসংখ্যানসমূহ:
• আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
• প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে প্রাণ হারায়।
• যে ব্যক্তি পূর্বে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে, তার আবারো আত্মহত্যার চেষ্টা করার ঝুঁকি বেশি।
• ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যা মৃত্যুর প্রধান দুটি কারণের মধ্যে একটি।
• আত্মহত্যা যেকোনো দেশের যেকোনো বয়সী মানুষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে আমাদের করণীয়:
• আপনি যদি বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকেন, তাহলে ৪০ সেকেন্ড নিয়ে আপনার বিশ্বস্ত কোন ব্যক্তির সাথে আপনার অনুভূতিগুলো নিয়ে একটি আলোচনার সূত্রপাত করুন।
• আত্মহত্যার কারণে আপনজনকে হারিয়েছে এমন কারো সাথে আপনার পরিচয় থাকলে, ৪০ সেকেন্ডের নিয়ে তার সাথে আলাপ শুরু করুন এবং তাকে জিজ্ঞেস করুন যে তারা কেমন আছেন।
• আপনি যদি মিডিয়াকর্মী হয়ে থাকেন, তাহলে সাক্ষাৎকার, আর্টিকেল এবং ব্লগপোস্ট ৪০ সেকেন্ডের পরিসংখ্যানটি তুলে ধরুন।
• আপনি যদি শৈল্পিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে কাজ করেন, তাহলে আপনার প্রোডাকশন বা ব্রডকাস্ট ৪০ সেকেন্ডের জন্য থামিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বা আত্মহত্যা প্রতিরোধ নিয়ে একটি বার্তা প্রচার করুন।
• আপনি যদি একজন কর্মকর্তা বা ম্যানেজার হন, তাহলে আপনার কর্মচারীদের প্রতি আপনার সমর্থন প্রকাশ করে করে এমন ৪০ সেকেন্ডের একটি ইতিবাচক ঘোষণা দিন। মানসিক বিপর্যয়ের সময় তারা কর্মক্ষেত্রে বা স্থানীয় এলাকায় কি ধরণের সাহায্য পেতে পারেন তা সম্পর্কে তাদের অবগত করুন।
• আপনার দেশের সরকারের কাছ থেকে আপনি মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ নিয়ে কি ধরণের পদক্ষেপ আশা করেন তা নিয়ে ৪০ সেকেন্ডের একটি অডিও বা ভিডিও ক্লিপ ধারণ করে সরকারকে পাঠান।
• আপনার যদি কর্মক্ষেত্রে একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ থাকে (যেমন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি, রেডিও) তাহলে আপনার দর্শক, শ্রোতা বা ফলোয়ারদের ৪০ সেকেন্ড সময় ধরে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গল্প বা বার্তা শেয়ার করার সুযোগ দিন।
• আপনি যদি রাজনৈতিক নেতা হন, তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন তা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরুন, ৪০ সেকেন্ডের পরিসংখ্যানটির উপর গুরুত্ব আরোপ করুন।

বর্তমানে, বিশ্বে প্রতি বছরে গড়ে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ১৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়। এই গড় সংখ্যার উপর ভিত্তি করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০১৮ সালের একটি পরিসংখ্যানে প্রকাশ করে যে, বাংলাদেশে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে ৫.৯ জন মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যায় (ইন্ডিয়া এবং শ্রীলংকায় আত্মহত্যার হার আরো ভয়াবহ, যা যথাক্রমে ১৬.৩ জন এবং ১৪.৬ জন মানুষ) । লক্ষণীয় ব্যাপার হল যে, প্রতিবছর বাংলাদেশে আত্মহত্যা করে মৃত্যুর সংখ্যা খুনের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পুলিশ হেডকোয়াটার থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে আত্মহত্যা করে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ২০১৭ সালে, ১১,০৯৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়, অর্থাৎ গড়ে ৩০ জন মানুষ প্রতিদিন আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৭ সালে বরিশাল জেলায় অন্যান্য জেলার তুলনায় আত্মহত্যার সংখ্যা সর্বোচ্চ, মোট ২,৫৮৫ জন মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার আরো বাড়তে পারে। তারা বলেন, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ অনেক ধরণের প্রতিবন্ধকতার এবং মানসিক আঘাতের মধ্যে দিয়ে যায়। তবে, এসব সমস্যার মোকাবেলা করতে তাদের যে সামাজিক এবং মানসিক সমর্থন দরকার তা তারা পায় না। ফলে এসব মানুষের মনে হয় যে, আত্মহত্যাই তাদের সকল সমস্যার একমাত্র প্রতিকার।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য ফেডেরেশনের প্রেসিডেন্ট আলবার্টো ট্রিম্বলি এবছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিটির একটি অংশ এখানে দেওয়া হল:
“এ বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য ফেডেরেশনের পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হল “আত্মহত্যা প্রতিরোধ”। আত্মহত্যামূলক আচরণ মানব জাতির ইতিহাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকলেও, বেশ কিছু জটিল ফ্যাক্টরের কারণে, বিশ্বের প্রতিটি অংশে এর হার ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। গত কয়েক দশকে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান এক ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। WHO এর হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর ৮লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়, যার মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ এখন আত্মহত্যা।” সুতরাং আত্মহত্যা নিয়ে আর অবহেলা নয়, বরং বেশি মাত্রার সচেতনতা দরকার। কারণ আত্মহত্যার প্রতিরোধ করাই এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। বিশ্বের বৃহত্তম মহাদেশ এশিয়ায় সামগ্রিক আত্মহত্যার প্রায় ৬০% সংঘটিত হয়।
সম্প্রতি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (MDG) অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু, এদেশে আত্মহত্যার হার উচ্চ হওয়া সত্ত্বেও, আত্মহত্যাজনিত সমস্যাগুলো নিয়ে এখনো পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত আত্মহত্যা বিষয়ক কোন জরিপ বা জাতীয় পর্যায়ের কোন গবেষণা করা হয়নি।
ধারণা করা হয় যে, বিশ্বে ৩০ কোটি মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগে এবং কোন না কোন সময় আত্মহত্যার চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আত্মহত্যা একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা বেশীরভাগ সময়ই গবেষকদের নজর এড়িয়ে যায়। কিন্তু, এখন সময় এসেছে এই সমস্যা নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করার।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০১৯ এর প্রধান প্রতিপাদ্য “আত্মহত্যা প্রতিরোধ” হিসেবে নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য হল, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যেন এই সমস্যাটিকে বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য বিষয়সূচিতে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আত্মহত্যা এমন একটি বিষয় যা সাধারণত “ট্যাবু” হিসাবে বিবেচিত হয়। এটা সম্পর্কে নানা ধরণের ভুল ধারণা ও কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এমন একটি বিষয় নিয়ে জনগণকে মন খুলে আলোচনা করার সুযোগ করে দিলে, যে কাউকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হবে, আত্মহত্যার কারণগুলো নির্ণয় করা সম্ভব হবে এবং এই জনস্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় পরবর্তীতে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তা চিহ্নিত করা যাবে।

মনোবিকাশ ফাউন্ডেশন

মনোবিকাশ ফাউন্ডেশন একটি মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৬ সাল থেকে ফাউন্ডেশনটি শিশুকিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের ব্রত নিয়ে যাত্রা শুরু করে। মনোবিকাশ ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য হলো, আলোকিত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে এমন বিকশিত মানুষ গড়তে সাহায্য করা। বিকশিত মানুষ হতে হলে একজন ব্যক্তিকে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করতে হয় সেগুলো হলো: মানসিক বিকাশ, আবেগীয় বিকাশ, সামাজিক বিকাশ, আত্মিক বিকাশ এবং শারীরিক বিকাশ। মানবজীবনের বিকাশে শৈশব থেকে কৈশোর, এই সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সে স্বপ্নময় জীবন গড়ার দুয়ার উন্মোচিত হয় এবং মানুষ অজানা ভবিষ্যতের সাথে পরিচিত হতে শুরু করে। একজন মানুষকে সুস্থ তখনই বলা যায় যখন তার দেহ ও মনে দুটোই সুস্থ থাকে। বিকশিত মানুষ হবার গুণাবলী শুধুমাত্র একজন সুস্থ মানুষের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব। শিশুকিশোরদের মনোসামাজিক সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দেবার পিছনে আমাদের যুক্তি হল: এই বয়সে অনেকেই নিজেদের মনোসামাজিক সমস্যাগুলোকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে, যার পরিণতিতে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে জন্ম নিতে পারে বিভিন্ন জটিল মনোরোগ। এই পরিণতির কথা ভেবেই আমরা সমাজের সকল বয়সের মানুষের মধ্যে মনোসামাজিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শারীরিক সমস্যার মত মানসিক সমস্যা সমাধানেও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, সচেতন হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রচলিত মানসিক সমস্যা নিয়ে বিদ্যমান কুসংস্কারগুলোকে দূর করা এবং মানসিক রোগকে অবজ্ঞা করার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পরিবর্তিত করা। সঠিক ও যথাযথ সেবা নিশ্চিত করে আমরা যাতে দেহমনে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে বাঁচতে পারি সে লক্ষ্যেই মনোবিকাশ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্বপ্ন – সুস্থ মন ও সুস্থ দেহ নিয়ে বেড়ে উঠুক আমাদের প্রজন্ম। ২০১৯ সনের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “আত্মহত্যা প্রতিরোধ” সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়