DR ASIA SULTANA SETU

Published:
2021-01-10 02:38:32 BdST

"ভাবি, আজকে ব্রুটাল ধর্ষিত মেয়েটি আমার নিজের কন্যা হলেও তো হতে পারতো"


এক অসহায় বিব্রত বিপন্ন বোধে আক্রান্ত কন্যা সন্তানের মা


ডা. আসিয়া সুলতানা সেতু  


_______________________

স্কুল বা মাদ্রাসা :ধর্ষক যেখানেই থাকুক, আমি সবার বিরুদ্ধেই সোচ্চার।

একদিকে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার্থী কর্তৃক ব্রুটাল ধর্ষণ , কিশোরীর প্রতি নির্মম সহিংসতা ও মাদ্রাসায় হুজুরদের হাতে বলাৎকার ধর্ষণের শিকার শিশুদের কান্নায় বাংলাদেশের সামনে নানা প্রশ্ন। বেরিয়ে পড়েছে বিপন্ন সমাজের কংকাল। একদল দুষছে ইংলিশ মিডিয়ামকে। দুষছে যৌন সহিংসার শিকার নারীদের। আরেকদল বলছে, নারী ও সাধারণ পুরুষ শিশুরা নিরাপদ নয় ধর্মীয় শিক্ষালয়ে।
তাহলে আমরা যাচ্ছি কোথায়। আজ আমাদের এই ধর্ষক দিহান ইস্যুতে কিংবা মাদ্রাসায় শিশুদের বলাৎকারের বিরুদ্ধে দিল্লীর নির্ভয়াকান্ডের মহাপ্রতিবাদের মত গর্জে ওঠা উচিত ছিল। কোথায় সেই গর্জন। বরং আমরা বিবিতালাকের ফতোয়া খুঁজছি। আমরা ব্রুটাল ধর্ষিত কিশোরী ও তার পরিবারের মধ্যে দোষ খুঁজে নিজেরাও ধর্ষক সমর্থকদের কাতারে নাম লেখাচ্ছি। আমরা মানুষ হলে দিল্লীর নির্ভয়া প্রতিবাদের মত মহা সংগ্রামে নেমে পড়তাম। তাতে সমাজ বদলাত।

 

বদলাতাম সকলে। এর মধ্যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ইংলিশ মিডিয়ামকে না টেনে; নারীর পোষাককে না টেনে সকলের একতাবদ্ধ হওয়া উচিত মাদ্রাসা , স্কুল কলেজ যেখানেই ধর্ষক থাকুক , সেখানেই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। এই কথাগুলো বললাম ফেসবুকে ফারজানা মাহবুবার অসাধারণ একটি লেখা পড়ে।তার মত আমিও ভাবছি, "ভাবি, আজকে ব্রুটাল ধর্ষিত মেয়েটি আমার নিজের কন্যা হলেও তো হতে পারতো"

ফারজানা মাহবুবা একজন মুসলমান ধর্মপ্রাণ নারী। তিনি
লিখেছেন


"আমি রেপড কিশোরীর মৃত্যুর খবরটা যতবার যত জায়গায় পড়ছি, বার বার দু'টো শব্দ ইলেক্ট্রিক শক এর মত আমার গায়ে ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে লাগছে।
'যিনা'!
'দু'জনেরই দোষ'!
ইসলামপন্থী, ইসলামিষ্ট, ধার্মিক মনষ্ক বেশীরভাগ মানুষ বার বার এই ঘটনায় যিনা'র কথা টেনে এনে সামহাউ খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটার নিজের, প্লাস তার বাবা-মা'র, দায় নিয়ে কথা বলছে!
আমি এজন্যেই বলি- বিশেষ করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী জনগন এখনো এইটিন্থ শতাব্দীতে বসবাস করে।
ঠিক এইটিন্থ সেঞ্চুরীতে এভাবেই ইউরোপেও একটা মেয়েকে একটা ছেলে জোড় করে যদি একলা জায়গায় টেনেও নিয়ে যেত, কিছু হোক বা না হোক, সেই মেয়ে আর তার পরিবারের মান মর্যাদা সব ধুলায় মিশে যেতো!
সেই মেয়ের আর ভাল পরিবারে বিয়েই হতো না!
এইটিন্থ সেঞ্চুরীতে বসবাস করা বাংগাল ধার্মিক ইসলামিষ্টরা তাই রেপ ভিকটিম  আর দিহানের ঘটনায় চোখের সামনে 'যিনা' দেখে, যখন আমি সবকিছুর শুরুতেই দেখতে পাচ্ছি- একটা খুন!
একটা মার্ডার!
একটা হত্যা!
আমি হতবাক। কারন ইসলামিক ঘরানার যাদেরকে আমি ফিউচার লীডার্স ভাবি, তাদেরকেও দেখছি সমাজের যিনা নিয়ে লম্বা লম্বা পোষ্ট দিচ্ছেন সোশাল মিডিয়ায়!
অথচ একটা মেয়ে যে খুন হলো- সেই খুন যেন তেমন কিছু না। এটা নিয়ে বলার কী আছে?!
'যিনা' করতে না গেলে কি এই মেয়ে খুন হতো?- তাদের প্রশ্ন।
তাদের কাছে আমার প্রশ্ন-
আপনি যদি ইসলাম এতই বুঝেন- এটা কি বুঝেন যে যিনার কথা কুর'আনে আসার আগে- অনেক বছর আগে- আল্লাহ খুব স্ট্রংলি কোনো কিছু না দেখে, কোনো এভিডেন্স ছাড়া, ধারনা করতে মানা করেছেন?
এটা কি জানেন?
রেপড ভিকটিম ও  দিহান'র ওখানে কীভাবে গিয়েছিল- নিজের ইচ্ছায় গিয়েছিল কি যায়নি-
তারসাথে নিজের ইচ্ছায় সেক্স করেছিল কি করেনি-
আসলে ঘটনা কী ঘটেছিল-
কিশোরী  নিজে এসে কি আপনাকে বলেছে?????????
আপনি পরিস্থিতি দেখে অনুমান করছেন!
মনে আছে ইফক'র ঘটনায় কী হয়েছিল?
আয়েশা রাঃ কে সাফওয়ান রাঃ এর সাথে একসাথে শহরে ফেরত আসতে দেখেই আব্দুল্লাহ বিন উবাই'র নেতৃত্বে কয়েকজন সাথে সাথে আয়েশা রাঃ এর চরিত্র নিয়ে গসিপ করা শুরু করেছিল।
এবং জাষ্ট সিচুয়েশান দেখেই মানুষের অনুমান এতটাই স্ট্রং ছিল যে অনেকেই বিশ্বাস করে বসেছিল আয়েশা রাঃ এর চরিত্র কলংকিত হয়েছে (আস্তাগফিরুল্লাহ)!
এখানে মেয়ে চরিত্রটাকে সরিয়ে দিয়ে- কারন আমি আনুশকার কথা কিছুই জানিনা, মেয়েটা কোন সিচুয়েশানে মরেছে- জানিনা, জানা সম্ভব না- তাই বলছি, মেয়ে চরিত্রটাকে সরিয়ে দিয়ে এবার এই ঘটনায় আপনার রোল দেখুন!
আপনি দেখছেন- একটা ছেলে একটা মেয়ের মৃতদেহ নিয়ে হসপিটালে এসেছে।
এখন আপনি জাষ্ট এই দৃশ্য থেকেই অনুমানে পৌঁছে গিয়েছেন- যেহেতু দিহান আনুশকাকে মৃত হলেও হসপিটালে এনেছে তাই এখানে আসলে 'যিনা'র ঘটনা ঘটেছে!
ব্যাস,
উঠে পড়ে লেগে গিয়েছেন আনুশকার দায় কতটুকু তা মাপতে!
তার বাবা-মা'কে জাজ করতে!
এমনকি,
ধরে নিন- আপনাদের কথা যদি আমি মেনেও নেই- এমনকি যদি এখানে "যিনা" হয়েও থাকে- তারপরও এই সিচুয়েশানে কোন শাস্তি'র কথা উঠবে আগে?
যিনা'র?
নাকি হত্যা'র?
আপনার লজিক কী বলে?
আপনার ভিতর আল্লাহ যে বিবেক নামে একটা কিছু দিয়েছেন, সেই বিবেক কী বলে???
আপনার নিজের সন্তান এখানে খুন হলে আপনি কী নিয়ে কথা বলতেন আগে???
এমনকি, খোদ রাসূল সঃ এর জীবন থেকে কেন এখানে উদাহরন আনতে ভুলে যাচ্ছেন??
রাসূল সঃ বেঁচে থাকতে যে যিনা'র শাস্তি প্রদানের ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে যিনাকারী নিজে রাসূল সঃ এর কাছে এসে বার বার বলেছে "হে আল্লাহ'র রাসূল, আমি যিনা করেছি, আমাকে শাস্তি দিন!"
আর রাসূল সঃ বার বার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন যেন তিনি শুনতেই পাননি!
আর সেই যিনাকারী বার বার ঘুরে এসে রাসূল সঃ এর মুখের সামনে এসে পাপের শাস্তি চেয়েছেন।
মনে আছে?
একবারও কোথাও দেখেছেন রাসূল সঃ পুলিশ পাঠিয়ে পাঠিয়ে, জনগনকে উষ্কে দিয়ে দিয়ে বলছেন, যাও, খুঁজে খুঁজে দেখো কে কোথায় যিনা করে বেড়াচ্ছে???
কিন্তু আপনারা এই কাজটাই করছেন!
অদ্ভুত!
রাসূল সঃ এর উম্মত হয়ে আপনাদের অবস্থা দেখে খোদ শয়তানও বুঝি লজ্জা পায়! - এতটাই গাদ্দারী, এতটাই দাম্ভিক, এতটাই জাজমেন্টাল আপনারা- একটা খুন হওয়া মেয়ের আদ্যপন্ত কিছুই না জেনে নিজেরা নিজেরা শার্লক হোমস হয়ে ঘটনার এ টু জেড মিলিয়ে ফেলেছেন!
তারপর নিজেরাই মব কোর্ট বসিয়ে রায় দিয়ে দিয়েছেন!
এই মেয়ে যিনা করেছে, এইরকম খুন হবে না তো কী হবে!!
আর ধার্মিক না যারা তারাও তো আরো কত কথাই যে বলছে!
দিহান নামের ছেলেটার দোষ নাকি দোষ না!
ছেলেটার দোষ হলে সে কি নিজে মেয়েটাকে হসপিটালে আনতো?!
যেন খুন করে খুনী খুন হওয়া মানুষকে হসপিটালে নিয়ে আসলেই তার খুনের দায় মাফ হয়ে গেলো!
কী হাস্যকর সব লজিক!
যেখানে ডক্টর'র ইমিডিয়েট রিপোর্ট স্পষ্টভাবে বলছে- মেয়েটার সামনের দিক দিয়ে আর পিছন দিক দিয়ে এমনভাবে সেক্স করা হয়েছে যে মেয়েটা ব্লিডিং হতে হতে মরে গিয়েছে!
অনেকেই বলছেন, এমনটাই তো হওয়ার কথা! মেয়েটা নিজেই যেখানে গিয়েছে ছেলেটার সাথে সেক্স করতে!
কী ধার্মিক, কী বক ধার্মিক, কী খুব ধার্মিক, কী অধার্মিক, এই মানুষগুলো তাদের বিবেককে, তাদের কমনসেন্সকে কোথায় যে তালা দিয়ে রেখেছেন কে জানে!
সেক্স'র বিষয় আসলেই কীভাবে যেন ঘুরে ফিরে সব দোষ গিয়ে তারা মেয়েটার উপরেই ঢালেন!
খুব জোড়েসোড়ে কন্যা সন্তানদের বাবামা'র দায় দায়িত্ব নিয়ে লেকচার দিতে শুরু করে দেন!
সমাজের 'কন্যা'দের আচার আচড়ন যে কতটা অশোভন হয়েছে এখন- তাই নিয়ে অনেক বড় বড় বয়ান দিতে শুরু করেন!
এ যেন সেই গরুর রচনা লেখার মত!
টীচার যাই লিখতে দেন না কেনো, যাইইই লিখতে দেন না কেনো, নদীর রচনা লিখতে দিলেও, তাতে স্টূডেন্ট গরুকে নিয়ে আসে!
"আমাদের গ্রামে একটা নদী আছে, সেই নদীর পাড়ে ঘাস আছে, সেই ঘাসে অনেক গরু চড়ে বেড়ায়। গরুর দু'টো কান, একটা লেজ, চারটে পা আছে......" এরপর গরুর বিবরন চলতে থাকে!
সেক্স'র সাথেও যেন আমাদের সমাজে মেয়েদের এমনই একটা সম্পর্ক!
সেক্স রিলেটেড যে ঘটনাই ঘটুক- এট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে- কোনো না কোনোভাবে সেখানে মেয়েটার ঘাড়েই সব দোষ চাপে!
মেয়েটার এবং মেয়েটার পরিবারের ঘাড়ে।
মেয়েটার বাপ মা'র ঘাড়ে।
এই সেক্স'র বিষয়ে একটা শব্দ'র খুব ব্যবহার দেখছি যত্রতত্র- 'কনসেনচুয়াল'।
আম্মু একটা কথা বলতো- কুত্তার পেটে ঘি ভাত সয় না।
আমি এখন সেই সুরে একটা কথা ভাবি- আবাল বাংগালীর মাথায় ইংলিশ কনসেপ্ট সয় না।
বাংগাল কতটা 'কনসেনচুয়াল' বুঝে তা পত্র পত্রিকার নিউজের নীচে আর সোশাল মিডিয়ায় তাদের লেখালেখি আর কমেন্টস দেখেই বেশ বুঝতে পারছি!
বাংগাল'র কাছে কনসেনচুয়াল মানে হলো মেয়েটার ছেলেটার কাছে আবদার করা- "আসো আমার সাথে সেক্স করো! আমার পিছন দিক দিয়ে সেক্স করতে করতে আমাকে মেরে ফেলো!"
আপনারা যারা কনসেনচুয়াল সেক্স নিয়ে খুব জ্বালা পোড়ায় আছেন, আপনাদের কি মনে হয় মেয়েটাকে পিছন দিক দিয়ে সেক্স করতে করতে যখন খুন করছিল দিহান, তখনও মেয়েটার খুব সুখ লাগছিলো?
নাকি খুন হওয়ার সময় যেহেতু সেক্স'র ব্যপার, তাই সেক্স'র খুনের ঘটনায় মেয়েদের ব্যাথা লাগে না??
তখন খুন হতেও অনেক সুখ লাগে?
এটাই কি ভাবেন আপনারা??
যদি না ভাবেন, তাহলে কীভাবে- জাষ্ট সিমপ্লি আমাকে একটু প্লীজজজজ বুঝিয়ে বলুন- কীভাবে আপনি খুন আগে না দেখে যিনা-কে আগে দেখেন????
কীভাবে আপনি একজন খুনী খুন করার পর তার সাফাই গাইতে পারেন????
কীভাবে আপনি খুন হওয়া মানুষটার আগাগোড়া কিছুই না জেনে- ঘটনার সময় কী ঘটেছে কীভাবে ঘটেছে কিছুইইইইই না জেনে- স্রেফ মানুষের কথায় শার্লক হোমস সেঁজে রায় দিয়ে দিচ্ছেন 'মেয়েটারও দোষ আছে!!'???
একজন আপু'র লেখা আমি মিস করি না, পেলেই পড়ে ফেলি। উনি প্রায়ই বাংগালকে 'ভোক্সোদ' বলে গালি দেন।
আমি এতদিন প্রায়ই ভাবতাম, এভাবে এমন গড়পড়তায় গালি দেয়া কী আসলে ঠিক হচ্ছে!?
আনুশকা আর দিহানের ঘটনায় অনলাইন নিউজের নীচে প্লাস সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন লেখালেখিতে আপামর বাংগাল জনতার কমেন্ট পড়ে এখন আমার মনে হচ্ছে, আপু ঠিকই গালি দেন।
এই জাতি যে সুপার সেক্সিষ্ট,
যে সুপার গান্ডু,
যাদের বিবেক আর কমন সেন্স তার হাঁটু না, তাদের পায়ের তলেও নেই,
এই জাতি ভোক্সোদ-ই।
তোরা কনসেনচুয়াল সেক্স'র মিনিং বের করতে থাক, আর ওদিকে আনুশকার মা বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদুক।
আমার কী?
আমার কিছুই না।
আমার শুধু বুকের ভিতর দম বন্ধ হয়ে আসে নিজের দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে।
ভাবি, আজকে আনুশকা আমার নিজের মেয়ে হলেও তো হতে পারতো! "
-- ফারজানা মাহবুবা

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়