SAHA ANTOR

Published:
2020-07-30 20:33:46 BdST

ইদ সবিশেষরহস্য প্রধান এলাকা


 

মোশতাক আহমদ

_________________________
১৯৬৬

আহমদ ছফা ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে ফিরছেন। কয়েকদিন গ্রামে বসে বসে নিরবিচ্ছিন্ন সময়ে দুটো ছোটগল্প লেখা হল। গান লেখার মুড তো ঘরে বসে চা সিগারেট খেতে খেতেই হয়ে যায়। গল্প লিখতে তো সময় আর মন দুইই দাবি করে। গুলিস্তানে নেমেই সোজা ভিক্টোরিয়া পার্কের উদ্দেশ্যে রিকশা নিলেন আহমদ ছফা। কামাল ইবনে মাহতাব ‘ছোটগল্প’ নামে একটা গল্পের পত্রিকা বের করছে, গল্পের জন্য সে শহিদী দরোজায় যেতে হলেও যাবে। পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর। কামাল সাহেব ছফাকে দেখেই ডেকে ভিতরে একপাশে নিয়ে গেলেন, বললেন, “ পথে কাউকে দেখলেন? সন্দেহজনক? “
“ না তো! কেন?” ছফা বিস্মিত।
“ আপনার জন্য পার্কের ভিতরে রাম দা নিয়ে এক লোক বসে আছে।“
ছফা পকেট থেকে ক্যাপস্টান সিগারেট বের করে ত্রস্ত হাতে ধরালেন, “ কে বলেছে? আপনি কি দেখেছেন?”
ছফা আড়চোখে সম্পাদকের অফিসের দিকে তাকিয়ে দেখলেন শশাঙ্ক পাল খুব মন দিয়ে তাঁকে লক্ষ্য করছে। ছফা সুখটান দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলেন। তাঁর এন্টেনা খুবই শার্প। বললেন, “ কামাল ভাই, শশাংক বলেছে তাই না?”
এই শশাংক পালের অভ্যাস হল প্রথমত সুন্দর করে মিথ্যা কথা ছড়িয়ে মানুষকে ভয় দেখানো, এক এক বার এক এক প্রেস থেকে লিটল ম্যাগাজিন বের করে পয়সা না মিটিয়েই কেটে পড়া আর আবারও লেখা জোগাড় করতে করতে নতুন প্রেসের সন্ধান করা। তাঁতীবাজারের বর্ণালী প্রেসে মোজাফফর হোসেন পল্টুকে একদিন ‘কালপরশু বিজ্ঞাপনের টাকা পেলেই দিয়ে যাব, আপনাকে খবর পাঠাতে হবে না! এরপরে প্রেসে নিয়ে আসতেছি ছয় দফার বাস্তবায়ন নিয়ে পূর্ব বাংলার কবিরা কি স্বপ্ন দেখতেছেন – ছয় ফর্মায় ছয় দফা! জয় বাংলা!’ বলে কিরকম পটিয়ে বের হয়ে গেল পেলের কায়দায়! এই দুষ্টুটার কাজ, ছফা বুঝলেন।
শশাংককে বললেন, “ ভাল হয়ে যাও শশাংক! ও হ্যাঁ সেই রাম দা-ওয়ালাকে ডেকে আমার নাম করে হোটেলে খাইয়ে দিও। তিন দিন যাবত না খেয়ে না দেয়ে আমার জন্য ওয়েট করছে!”
শশাংক বিগলিত হয়ে গেল, “ চ্যাতেন ক্যান ছফা ভাই। আমার বন্ধুর সাথে আলাপ করাইয়া দেই- ওর নাম আবুল হাসান”, বলেই এক শাদা শার্ট পড়া, গলায় মাফলার, তেরছা করে চুলে সিঁথি কাটা, নিষ্পাপ কিশোরের মুখচ্ছবির এক তরুণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল; “ কবি আবুল হাসান ...”।
“ ও যে কি রকম কাব্যিক ছোটগল্প লিখে ছফা”, শশাংককে থামিয়ে সম্পাদক কামাল সাহেব বললেন।
হাসানের চোখদুটো ছফাকে আকর্ষণ করল। কবিসুলভ ভাসাভাসা মায়াবী চোখ। কন্ঠস্বরে এক ধরণের জাদু আছে।
.
রাতে ওরিয়েন্ট হোটেলের মেসে ছফা নিজের হিটারে লেবু চা বানিয়ে খাচ্ছেন। মনটা রাজা বাদশাহদের মতো। আজ প্রথম উপন্যাসের জন্য প্রকাশকের কাছ থেকে আগাম দেড় হাজার টাকা পেয়েছেন। কালই বাড়িতে বেশ কিছু টাকা পাঠিয়ে দিবেন। টাকাটা খুব দরকার বলে আজ মরীয়া হয়েই টাকাটা চেয়ে এনেছেন। আর এদিকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ ‘প্রতিদিন একটি মুরগির রান ‘ আর সাদা ভাতের পালার দেরি আছে। ছফারা কয়েকজন বন্ধু মিলে আরমানিটোলার এই হোটেলের একটা অংশকে মেস বানিয়ে নিয়েছেন। হঠাত দরোজায় নক। শশাংক এসেছে, আবুল হাসানকে নিয়ে।
“ বস, হাসান আপনার এখানে কয়েকদিন থাকবে।“ শশাঙ্ক বলল, “ ওর আগের মেস বন্ধ হয়ে গেছে।“
“ কেন ওর হলের সিটের কি অসুবিধা?”
“ ভার্সিটি থেকে নাম কাটা গেছে।“

আবুল হাসান জানালো, মায়ের অসুখ খবর পেয়ে গ্রামে যেতে হয়েছিল। এদিকে বাবা দেরি করে টাকা পাঠানোয় সময়মত তিন মাসের টিউশন ফি জমা দেয়া হয়নি। শেষ মুহূর্তে কিছু টাকা জোগাড় হলে এক বন্ধুকে দায়িত্ব দিয়ে বাড়ি চলে যায়। ফিরে এসে দেখে বন্ধুটি সেই টাকা উড়িয়ে ফেলেছে। হাসানের ভর্তি হওয়া হয়নি।

“ হাসান, আমারও এক সময় ইউনিভার্সিটি থেকে নাম কাটা গিয়েছিল, কিন্তু সেই নাম আর তোলা হয়নি। আমি চাই তুমি জরিমানা দিয়ে হলেও নামটা আবার উঠাও। পরাধীন দেশে সার্টিফিকেট দরকার। কবিতা তোমাকে ভাত দিবে না।“
“ কিন্তু ছফা ভাই, টাকা কোথায় পাব?”
“ কত টাকা?”
“ সাড়ে তিনশো।“
“ আমি তোমাকে টাকা দিচ্ছি। কালই গিয়ে তুমি নাম উঠাও।“
শশাঙ্কসহ কিছুক্ষণ গল্পগুজব হল। হাসান একটা কবিতা পড়ে শোনালো।

পরদিন সকালে ছফা রাজ্জাক স্যারের সাথে জরুরী বিষয়ে কথা বলে বাড়িতে মানি অর্ডার করতে যাবেন। দেখলেন হোটেলের লবিতে হাসান বসে বসে ক্যারাম খেলছে। এত দ্রুত বন্ধুবান্ধব জোটালো কিভাবে ভাবতে ভাবতে ছফা কাজে চলে গেলেন।

কয়েকদিন পর ছফার কাছ থেকে আরো কিছু টাকা চাইল হাসান। নাম সে তুলেছে, কিন্তু সেমিনার ফি লাগবে।
“ আবার আলাদাভাবে টাকা দিতে হচ্ছে?”
“ জ্বি ভাই। আমি হিসেব করতে ভুল করেছিলাম।“
ছফা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়ি নক্ষত্র জানেন, তাঁর ষষ্ট ইন্দ্রিয় যথেষ্ট সজাগ ও জ্ঞানপিপাসু। অবিশ্বাসের সাথে হাসানকে আরো একশো টাকা দিলেন।

ছফা লক্ষ্য করলেন, এই সময় হাসানের কিছু বয়স্ক ও ভবঘুরে বন্ধু জোটে। সন্ধ্যাগুলো হয়ত রঙিন হয়ে ওঠে। কিন্তু সকাল বেলা সে আবার গোবেচারা ছেলে।

____________________

মোশতাক আহমদ । কবি, চিকিৎসক , লেখক

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়