ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-05-30 18:14:43 BdST

গাঁও গেরামের করোনা : সত্য কাহিনি লিখলেন একজন ডাক্তার


 

ডাঃ সুকুমার সুর রায়  

_________________________________


আমতলার মাচানে বসে ছিলেন অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক মতিন সাহেব।
তাকে ঘিরে ধরে ছিল কয়েক বাড়ির হাইল্যা কামলারা।
তেমন কোন কাজ কাম নাই।
ইরি বোরো ধান তোলা হয়ে গেছে। ঈদও পার হয়ে গেল।
কয়েকদিন আগে আমপান ' ঝর বয়ে গেছে।
প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিনের নারুয়া চড়া পানিতে ডুবে আছে। সেদিক থেকে মৃদু মন্দ হাওয়া বইছে।
জৈষ্ঠ্য মাসের ভর দুপুরে কড়া রোদ উঠলেও আমতলার মাচানে বেশ আরাম লাগছে।
কামলারা সব হল্লা করে পাল্লা দিয়ে বিড়ি ফুঁকছে।
মতিন সাহেব বিড়ির ধোঁয়ায় হাঁসফাঁস করলেও এই সব সহজ সরল হাইল্যাদের সাথে সময় কাটাতে তার ভালই লাগছে। তিনি বললেন - " কীরে, আগে যে হোঁকা তামাক খাওয়া হত, তার কি হলো? "
কাসু বললো - " কাক্কা যে কি কয়, সেই হোঁক্কার যুগ কি আর আচে!? "
বক্কার বললো - " নদীত জোয়ার ধইরচে! ম্যালা পানি বাইড়্যা গ্যাচে। "
সোলেমান বললো - " এবার বান ' হব্যার পারে। অসুবিদা নাই, চড়াত ধান পাট নাই, কিছু তিল আচে, সপ্তা খানেকের মদ্যে উইঠ্যা যাইব্যো। "
বানের কথা শুনেই আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। কাসু বলে উঠলো -- " একবার হইলো কি, বানের পানি বাইড়্যা উঠানের মইদ্যে উড়াত পানি হয়্যা গ্যালো। । পাক ঘরের হাঁস্যাইলের মইদ্যেও পানি। রাইতের বেলায় দেহি কি, হাঁস্যাইলের মইদ্যে কী জানি খলবল খলবল করতিচে ! টর্চ মাইর‍্যা দেহি কি, বড় বোয়্যাল মাছের নাহাল দ্যাহা যায়! থরকোঁচা দিয়্যা গাঁইথ্যা তুইল্যা দেহি ১০ কেজি ওজনের বোয়্যাল! "
সোলেমান বললো - " মাছ আছিলো দুইডো, তোমার টর্চ আর থরকোঁচার ভাঁজ পাইয়্যা একটো মাছ চইল্য্যা গেছিল। "
বক্কার সোলেমানকে সমর্থন করে বললো -
" হ, হ, এই সুমে বড় মাছ জোড়াবাইন্ধা থাকে। "
টগর বাড়ির ভিতর থেকে কাঁচা মরিচ লবন দিয়ে মাখানো এক থালা আম নিয়ে এসে হাজির হলো। মতিন সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো - " কাক্কা, আমপান ঝড়ের আম, মিঠা আম , খান। "
মতিন সাহেব বললেন - " হিন্দু পাড়ার সেই কোকিল দত্তও নাই, সেই কাসুন্দিও নাই। কাসুন্দি ছাড়া কী আম টেস্ট হয় রে !?

কাঁচা আম মাখানো দেখে গল্পের মোড় আবার আরেক দিকে ঘুরে গেল।
বক্কার বললো - " এক বার হাশেম কাক্কার কাঁচা মিঠা গাছের এক ঝাঁকা আম গামলার মইদ্যে মাহাইয়া নইয়া আর কেউ শ্যাষ কইরব্যার পারে না। এই দেইখ্যা হাশেম কাক্কা কী রাগ, কয় - ' খাইব্যার পারবুনা তা মাহালু ক্যা? "
সোলেমান বললো -" কাক্কা, আপনের আব্বা যহুন বাঁইচ্যা আচিল, একবার আপনেগারে চূনি গাছের আম আমরা তিন জন মিল্ল্যা চুরি কইর‍্যা ভাগ কইর‍্যা নিচিল্যাম। "
কাসু বললো - " আরাক কাম হইছিলো , একবার কাক্কাগারে কলা বাগান থেইক্যা এক কাইন কলা কাইট্যা খ্যাড়ের পালার মইদ্যে জাগ্ দিয়্যা থুচিল্যাম। পত্যেক দিন পাকা কলা বাইর কইর‍্যা কইর‍্যা তিন জন মিল্যা আত্মা ভইর‍্যা খাইচি। "
মতিন সাহেব হাইল্যা কামলাদের এই সব সরল সোজা স্বীকারোক্তি শুনে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন - " আচ্ছা তোমরা এই যে চুরি করে গাছের আম, কলা, খেয়েছো, আমরাতো কেউ জানিনা, তা এখন ফস ফস করে সব বলে দিচ্ছো কেন? "

কাসু বললো - " কাক্কা কেডো কহুন মইর‍্যা যাই তার ঠিক আচে? ! এই যে চুরির কতা স্বীকার গ্যালাম, তাতে আপনেও মাপ কইর‍্যা দিবেন, গোর আজাবও কম অইব্যো, ঠিক না কাক্কা!? "
হঠাৎ আবার গল্পের মোড় ঘুরে গেল এবারের ঈদের আলোচনায়।
কাসু একটু বেশি ফক্কর গোছের।
কাসু বলে উঠলো - " কাক্কা, এবারের ঈদের নাহাল ঈদ জিন্দেগীতে দেহি নাই। মসজিদে নামাজ পইড়্যা বাইর হয়্যা যেই হাজি সাব'রে জড়াইয়া ধইরব্যার গেচি, এহা বারে লাফাইয়্যা উটচে! জানো না? সরকার থনে কোলাকুলি নেষধ আচে!?
কাক্কা, মনে মনে হাসতি হাসতি প্যাটে খিল লাইগ্যা গেছিলো। এবা ঈদ কুনোদিন বাপের জন্মে দেইখচেন!?
কাসুর কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ হাশেম কাকার বাড়ির ভিতর থেকে কান্নার রোল শুরু হলো।

দৌড়ে সবাই সেদিকে চলে গেল।
জানা গেলো হাশেম কাকার আব্বা হোসেন আলী সরকার এইমাত্র মারা গেল!

বেচারার বয়স হয়েছিল আশি' বছর।
মতিন সাহেবের ছোট ভাই ইস্কুল মাস্টার সাইফুল বললো - " গাজিপুর থেকে হাশেম কাকার ছোট ছেলে বাসেত এসেছিলো ঈদের ছুটিতে। ওর নাকি গাজিপুরে থাকতেই জ্বর হইছিল। এখন করোনা হইছিল কিনা তাতো জানা যায় নাই, টেস্ট তো করা হয় নাই।
হাশেম কাকা তড়িঘড়ি করে বললেন --
"এসব কথাবার্তা রাখো। ইমাম সাব'রে খবর দেও। বাপজান হাটফেল কইর‍্যা মরছে। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়া দিক। বাদ আসর বাপজানের জানাজার নামাজ হবে।। "
_______________________

AD..

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়