Ameen Qudir

Published:
2020-04-09 15:45:44 BdST

একজন ডাক্তারের আত্মকথা: কিভাবে বিশেষজ্ঞ হলাম


লেখকের ছবি

অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার
বাংলাদেশের প্রথিতযশ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
প্রাক্তন চেয়ারপারসন , মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
__________________________

পাঁচ বছর পড়ে ডাক্তার হলাম। এর মধ্যে বিয়ে হলো; বাচ্চা হলো। ডাক্তারীর পড়া অনেক। একবারে (অর্থাৎ পাঁচ বছরে) পাশ করতে গেলে কি পরিমান সময় পড়তে হয় সেটা যাদের পরিবারে ডাক্তার আছে সবাই জানেন।
তারপর ইন্টার্নশীপ। শুধু রোস্টার ডিউটি আর রোস্টার ডিউটি। রাতের ডিউটিতে কার কাছে ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে যাই! মার দ্বায়িত্ব, স্ত্রীর দ্বায়িত্ব, সংসারের দ্বায়িত্ব এত কর্মঘন্টার মধ্যে সুষ্ঠুভাবে করি কিভাবে? সেই সাথে ছিল আর্থিক সমস্যা। বাচ্চার জন্য ন্যানী রেখে গাড়ী হাঁকিয়ে চলবো সরকম অবস্হা মোটেও ছিল না।


ইন্টার্নীর পরে উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সে চাকরী। স্বামীর চাকরী ঢাকায়। সেই সাথে ছোট বাচ্চা। কি অসুবিধার সম্মুখীন যে হলাম! দুবছর এভাবে পার করলাম। তারপর পোস্টগ্রাজুয়েশন কোর্সে ঢুকলাম। মনোরোগ বিদ্যা বিভাগে। বাসা ছিল মিরপুরে। সেখান থেকে যেতে হতো আইপিজিএমআর-এ। প্রথম পর্ব পাশ করবার পরে পোস্টিং হয় সিলেট মেডিকেলে পরে মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর্থিক সংগতি তেমন ছিল না তাই যাতায়াতের জন্য বাসই ভরসা। মিরপুর থেকে মিটফোর্ড যাওয়া আসা কতটা সময়ের ব্যাপার সহজেই অনুমেয়। পোস্টিং তখনো উপজেলায়; বেতন আনতে হতো সেখানে গিয়ে।FCPS-এর জন্য পড়বো না উপজেলায় গিয়ে বেতন নিয়ে আসবো? দশ মাস বেতন ছাড়াই থাকলাম। তারপরে বাড়ীর বৌ। একবারে পাশ না করলে দ্বিতীয় বার এভাবে সুযোগ পাবো কিনা কে জানে? এর মধ্যে শিশুকন্যাকে ভর্তি করেছি নার্সারীতে। কে তাকে নিয়ে যাবে স্কুলে? প্রায়ই স্কুল মিস যায়। স্কুলের এক আয়ার তো বদ্ধমূল ধারনা হলো মেয়ে আমার পাশ দিতে পারবে না। তবে মেয়ে আমার মেধাবী সেটা স্বীকার করতেই হয়।
পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে FCPS পাশ করলাম। প্রথম পর্বে ভাইভা সহ তিন বিষয়ের পরীক্ষা ছিল পর পর তিন দিন। সে সময় দুই দিনে মাত্র দুঘন্টা ঘুমিয়েছিলাম আমি। এখনো মনে আছে। আমাকে যে একবারেই পাশ করতে হবে। আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের এড়িয়ে চলতাম। বলা বাহুল্য সমালোচনা শুনতে হয়েছে অনেক। তস্য তস্য লতায় পাতায় আত্মীয়রা খোঁজ করে ডাক্তারের। এত বছর ধরে কি এমন পড়া?
বিশেষজ্ঞ হলাম। মাস ছয়েক পরে অফিসের পর তিন ঘন্টা করে ব্যক্তিগত চেম্বারে বসা শুরু করলাম। কিন্তু রোগী তো আসে না! তবে আমি ঠিক তিন ঘন্টা চেম্বারে বসে থাকি। বই পড়ি, গবেষনার কাজ করি, সায়েন্টিফিক পেপার লিখি। এভাবে কতদিন যে গিয়েছে! আবার মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়া, কোচিং, বাসায় সময় দেয়া কত কি? এমন বাসা দেখিনি যেখানে রান্না বান্না সব বুয়ার হাতে- এমন কথা যে কতবার শুনেছি!
যখন একটু প্রতিষ্ঠিত হলাম, আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখলাম, দেখি বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। সংগ্রাম আর যুদ্ধ করতে করতেই তো পার করে দিলাম জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। জীবনকে উপভোগ করা এনজয় করা কি সেটা বুঝতেই সময় পেরিয়ে গেল।
এখন পরিনত বয়সে এসে দেখি নিজের চাহিদা অনেক কম। রোগীকে সময় দেয়ার জন্য যদি সংখ্যা সীমিত করতে চাই তাতে অসন্তোষ; বেশী রোগী দেখে সময় কম দিলে তাতেও অসন্তোষ। একবার কেন মনোরোগের জন্য ওষুধ খেতে হবে বুঝিয়ে বলার পরে রোগী না বুঝলে আমি বললাম: এই ডায়াগনোসিস লিখে দিলাম। আপনিতো শিক্ষিত মানুষ। চিকিৎসা দেখুন ইন্টারনেটে। অমন কেন বললাম? রোগী কমপ্লেইন করে গেল অভিযোগ বক্সে। কোথায় যাবো আমি? আমি যদি একজন রোগীকে আধ ঘন্টা সময় দিই তবে তিন ঘন্টায় মোট ছয় জন রোগী দেখতে পারবো। আমার আপত্তি নেই তাতে। কিন্তু কত কর্মঘন্টা আমি ব্যায় করবো রোগী দেখার জন্য?
আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বৃদ্ধ পিতা-মাতা এদের কি আমার সান্নিধ্য চাওয়ার অধিকার নেই?
কন্যা আমার শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পন করলো; আমি স্ট্রাগল করছি। বাবার মৃত্যু হলো; আমি স্ট্রাগল করছি। মার মৃত্যুর সময় বলা যায় আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। তখন আমি অধ্যাপক।
আমার কন্যা আজ বিদেশে। তাকে তার পাওনা সময় আমি দিতে পারিনি। পিতা-মাতা-স্বামী-সন্তান...পেশার ব্যস্ততার কারনেই সবসময় তাদের পাশে থাকতে পারিনি। মার মৃত্যুর পরে আফসোস করে বলেছিলাম- কেন আমি সব ছেড়ে প্রতিদিন মার পাশে এক ঘন্টা করে বসে থাকলাম না! সেই কষ্ট আজো আমায় পীড়া দেয়। আজ কিছুটা হলেও অপরাধবোধ হয়।

পরিশেষে
আমার কন্যা। যথেষ্ট মেধাবী। কিন্তু ডাক্তারী পড়লো না। বলে মা তোমার তো কোনো রিক্রিয়েশন নেই! সিনেমা দেখা, নাটক দেখা, কবিতা-গানের অনুষ্ঠানে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে যাওয়া....পর্যাপ্ত রেস্টও তো নিতে পারো না। আমি বলি: কেন রে? এই যে রোগীদের সেবা করছি। তারা ভালো হয়ে কত দোয়া করে। জানিস রোগীরা গাছের লাউ, বেগুন, খেজুরের গুড়, গরুর দুধ এগুলোও আনে। তারা কষ্ট পাবে বলে তাদের ঐ ভালোবাসার উপহারগুলো আমি ফিরিয়ে দিই না। তাদের ঐ আন্তরিকতা আমাকে ছুঁয়ে যায়; তাদের হাসিমুখ গুলো আমার মনে শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। এ যে কি স্বর্গীয় অনুভূতি বুঝিয়ে বলবার নয়!

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়