Ameen Qudir

Published:
2020-03-25 15:40:53 BdST

করোনা, লক ডাউন এবং উৎসবমুখর বাঙালি


আনোয়ার হোসেন বাদল
কথাসাহিত্যিক
---------------------------------------------------

করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ যা স্তব্ধ করে দিয়েছে গোটা পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষকে। তথ্য প্রযুক্তি আর জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার এই দিনে এমন ভয়ঙ্কর মহামারি দু'দিন আগেও কেউ কল্পনা করেনি। আজ সামান্য এক অনুজীবের কাছে পৃথিবীর সমস্ত পরাশক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, আস্তিক নাস্তিক সবাই অসহায়। উত্তম ফয়সালার জন্যে মানুষ মাত্রই এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায় পৃথিবীতে এরকম ভয়ঙ্কর মহামারি এটাই নতুন নয় বরং প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই চলে এসেছে এমন ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ। মানুষ যখন থেকে ইতিহাস সংরক্ষণ করতে শিখেছে তখন থেকেই এসব আসমানী-জমিনী বালা বিদ্যমান ছিলো। পবিত্র কুররানে পাকসহ সকল ধর্মগ্রন্থে যুগেযুগে পৃথিবীতে নেমে আসা এইসব অভিশাপের কথা বলা আছে।

আজকের দিনে যে ভাইরাসটি চীন থেকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো তাতে বরং মৃত্যুর হার অতি নগন্য। তবে এর কন্ট্রামিনেশন বা ট্রান্সমিশনটা অতীতের যেকোন মহামারির চেয়ে ভয়ঙ্কররুপে বিস্তৃত।ইতোমধে ভাইরাসটি বিশ্বের ১৮৭ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে যাতে সরকারি হিসেবানুযায়ী অদ্যাবধি সাড়েতিন লক্ষেরর মতো মানুষ আক্রান্ত হয়ে তারমধ্যে ১৫০০০ এর মত মৃত্যুবরণ করেছে। ভাইরাসটি সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ছড়িয়েছে ইউরোপের ইটালী, স্পেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইরানসহ কয়েকটি ইসলামিক দেশে।

যে চীনদেশে ভাইরাসটির উৎপত্তি সেখানে ইতোমধ্যে এর বিস্তার বন্ধ হয়েছে। ভাইরাসটির কোন প্রতিষেধক না থাকায় একমাত্র প্রতিরোধই এর থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে চীনের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহ যেমন তাইওয়ান, কোরিয়া, হংকং, রাশিয়া শুধুমাত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমেই তাদের সংক্রমণ শূন্যের কোটায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

আজ অন্তত তিনমাস যাবৎ এই মহামারি ক্রমাগত বিস্তার লাভ করে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে যতোদূর জানি আমাদের দেশে এর বিস্তার এখন সামাজিকভাবে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে আছে। অর্থাৎ এক্সপ্লোর হতে খুব বেশি বাকী নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে যতোদূর খোঁজখবর রেখেছি তাতে ধারণা করছি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গোটা বাংলাদেশ স্তব্দ হয়ে যেতে পারে ভয়ঙ্কর সব খবরাখবরে, আসন্ন মহামারির নিষ্ঠুরতার ছোবলে।

করোনা নিয়ে তামাশা , প্যারোডি ও অন্ধত্বের প্রচার অবিরাম। ভিডিও লিঙ্ক::https://www.facebook.com/kowshik.kj/videos/2279818695454128/?t=9

 

আমরা শুরুতেই এটিকে রোধ করতে পারতাম। প্রতিরোধ খুব বেশি কঠিন ছিলোনা। কেন পারলাম না? কেন আমরা উদাসীন হয়ে থাকলাম? কেন আমাদের এতোটা অবহেলা? এসব প্রশ্নের জবাব সরকার দিতে পারবেন। কিন্ত সরকারের অন্তত ডজনখানেক মন্ত্রী-আমলার করোনা প্রতিরোধ ভুলে হাজার কোটি টাকার আতশবাজি খেলা আর করোনা সম্পর্কিত উদ্ভট সব বক্তব্যে গোটা জাতি যারপরনাই বিরক্ত। তাদের কথা বাদ দিন আসুন আমরা বরং করোনাকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু বিষয়ের উপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে আসি।

প্রথমতঃ করোনা একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় যা মহামারি আকারে চিনে সর্বপ্রথম ছড়িয়ে পড়ে। এই বিপর্যয়ে তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল থাকার কথা ছিলো। কিন্তু উল্টো আমরা চীনাদের মুসলিম বিদ্বেষী এবং কাফের বলে আখ্যা দিয়ে তাদের লানত দিতে থাকি। প্রচার করতে থাকি এটি চীনাদের উপর আল্লাহর গজব হিসেবে। বলতে থাকি যে পৃথিবীর কোন মুসলমান এতে আক্রান্ত হবেনা বরং কাফেরদের বিরুদ্ধে এটি আল্লাহ পাকের প্রতিশোধ। ফলত সাধারণ মানুষ আমাদের এসব কথায় বিভ্রান্ত হয়ে করোনা প্রতিরোধের স্বাস্থ্যসম্মত বিধি বিধান না মেনে আমাদের আবিস্কৃত কিছুদোয়া কালামের উপর নির্ভরশীল হতে থাকে।

দ্বিতীয়ত, আমরা করোনা বিষয়ক কীসব স্বপ্ন এবং এর প্রতিকারে উদ্ভট উদ্ভট সূত্র ইমাম মাহদীর আগমন,কেয়ামত ইত্যাদি নানান ফরমুলা বের করে নানাভাবে অপপ্রচার চালাতে থাকি। ফলত এদেশের ধর্মভীরু মানুষেরা বিজ্ঞানভিত্তিক প্রচারপ্রচারণায় মনোযোগ না দিয়ে রাস্তাঘাট, দোকানপাটসহ সামাজিক ও ধর্মীয় জমায়েতর ভীড় বরং বাড়িয়েই চলে।

মূলত কুসংস্কার আর অন্ধত্ব ভারতবর্ষের মানুষের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। সংগত কারনেই আমরা কখনও থানকুনি পাতা, কখনও ঝারফুঁক, দোয়াকালাম আবার বাঁশের পানি, গোবর-গোমূত্র ইত্যাদি সেবনে মুক্তি খুঁজি। বারবার হাত ধুয়ে, সেনিটাইজ্ড থেকে, গনবিছিন্ন থেকে ঘরের ভেতরে আবদ্ধ থেকে প্রতিরোধ করাটা বুঝিনা।

এই নিবন্ধটি যখন লিখছি তখন টিভির পর্দায় দেখছি শিরোনাম। সৌদিতে কারফিউ- মসজিদ বন্ধ, মিশরসহ বহু মুসলিম দেশে মসজিদ বন্ধ। ইরানের গন কবরে লাশ দাফনের লোক পাওয়া যাচ্ছেনা। মীরপুরে স্বাস্থবিধি না মেনে মসজিদে যাতায়াতকারী মুছুল্লীর মৃত্যু। প্রশ্ন হচ্ছে মসজিদ কী স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়েছে? না তা কিন্তু মোটেই নয়, করোনার এই আপদকালীন সময় অতিক্রমের পর সবকিছু খুলে দেয়া হবে। অথচ আমাদের দেশে দেখলাম কতিপয় মানুষ মসজিদ বন্ধ হলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার হুুমকিও দিচ্ছে। যেখানে পাবলিক গ্যাদারিং নিষিদ্ধ করছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, পৃ্থিবীর সব দেশে সকল উপাসনালয়সহ সকল প্রকার পাবলিক গ্যাদারিং বন্ধ ঘোষণা করেছে স্বস্ব দেশের মানুষ, আমাদের সরকার এসব যথায়থভাবে কার্যকর করার জন্যে সেনা মোতায়েন করেছেন সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক জমায়েত করে আমরা দোয়া অনুষ্ঠান করছি করোনা থেকে মুক্তির জন্যে।

১৭ মার্চ আমাদের সরকার যখন স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা দেয় তখনই আমি বলেছিলাম সকল প্রকার পাবলিক গ্যাদারিং এর মাধ্যমেও তো করোনা ছড়াতে পারে। অামি অবাক হয়ে দেখেছি আমার সেই পোস্টে কতোজন কতো বিচিত্রসব মন্তব্য করেছিলো। মূলত হাজার বছর ধরে আমরা কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের মধ্যে ডুবে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছি।

আমরা নিশ্চিত করেই জানি সৃষ্টিকর্তাই একমাত্র উত্তম ফয়সালাকারী কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে নিশ্চয়ই তিনি নিষেধ করেননি! আজ দেখলাম সরকার লক ডাউনের আগাম সতর্কতা দিলে 'ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে গাদাগাদি করে লোকজন গ্রামেগঞ্জে ফিরছে। গণসংক্রমণের এরচে বড় পদ্ধতি আর কী হতে পারে? নির্বোধদের কে বলবে এটা লক ডাউন, উৎসব পালনের জন্যে গণছুটি নয়!'

দু'একজন পাবলিক প্রতিনিধিকে দেখলাম তারা আরও এক ধাপ এগিয়ে ঢাকাবাসীকে গ্রমে চলে আসার জন্যে ফেসবুকে পোস্ট করে আহবান পর্যন্ত জানাচ্ছেন।
এসব দেখে শুনে মনে মনে ভাবি হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ? তবু গর্ব করেই বলি 'ইনহাস্ত ওয়াতনাম।'...... এইতো আমার জন্মভূমি।

আনোয়ার হোসেন বাদল

পটুয়াখালী
২৪/০৩/২০২০

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়