Ameen Qudir

Published:
2020-03-22 21:14:52 BdST

কোয়ারেন্টাইন, করোনা ও গুটি বসন্ত


আনোয়ার হোসেন বাদল
কথাসাহিত্যিক
----------------------------------------------------

আমার তিন বছর বয়সের সময় বাংলাদেশে অগণিত মানুষ গুটি বসন্তে মারা গিয়েছিলো। জন্মের আগের বছর মরেছে কলেরায়। তিন বছর বয়সে আমাদের গ্রামে একই বাড়িতে মারা গিয়েছিলো সতেরোজন। আমার নানীজানও সে বছরই মারা গিয়েছেন। তখনকার বসন্ত ও কলেরার জীবানু বা ভাইরাস আজকের করোনার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ ছিলো। মূলতঃ বসন্ত ঋতুতেই বঙ্গদেশে গুটি-বসন্তের মহামারি দেখা দিত আর গ্রীষ্মে আসতো কলেরা।

তারপর গড়িয়ে গেছে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি। বিবর্তিত এ সময়ের দৃশ্যমান পার্থক্য শুধু এই, তখনকার মানুষ তথ্য-প্রযুক্তি বা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এতোটা অগ্রগামী ছিলোনা। আজকের দিনে আগাম সতর্কতা আর প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারনে করোনার মতো বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ সংক্রমণেও সারাবিশ্বে এ যাবৎ অনুর্ধ দশ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, পক্ষান্তরে তখনকার সময়ে সম্ভবত পটুয়াখালীর মতো ছোট্ট একটি জেলায়ও মৃত্যুর সংখ্যা দশ হাজারের বেশি ছিলো।

সে ছিলো অনেকটা পিছিয়ে থাকা যুগ। গোটা পটুয়াখালী জেলায় ২/১জন ডাক্তার থাকলেও, হাসপাতাল ছিলোনা। চিকিৎসা ছিলো কবিরাজ নির্ভর, লতাগুল্ম ভিত্তিক আর ছিলো তাবিজ কবজ। তবু কেমন করে যেন সে সময়ের মানুষ হোম কোয়ারেন্টাইনটা শিখে গিয়েছিল। এক বাড়িতে বসন্তের সেই মহামারি দেখা দিলে অন্য সব বাড়ির মানুষ অটো কোয়ারেন্টাইন্ড হয়ে যেত। এমন কি গ্রাম থেকে গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।

এই অটো কোয়ারেন্টাইন হওয়াটা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যপার। তবে আন্দাজ করা যায় যে, চোখের সামনে অগনিত মানুষকে মরতে দেখে ভয়ে সবাই সিটিয়ে থাকতো। সুতরাং এই সিটিয়ে থাকাটাই ছিলো কোয়ারেন্টাইনের মত। মানুষ বাড়ি বাড়ি মুন্সী মৌলানাদের ডেকে দোয়া পড়াতেন। ফকির বা ওঝা-বদ্যি নিয়ে বাড়ি সাড়াতেন। হিন্দুরা পুজা দিতেন, সকলেরই ধারনা ছিলো মানুষের উপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আসমান থেকে ঐসব রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর।

আজ দুই দিন যাবৎ অনেকটা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি। আমার মা প্যারালাইজ্ড হয়ে এমনিতেই গত তিন বছর যাবৎ বিছানায় অনেকটা গৃহবন্দি কাটাচ্ছেন। মায়ের কাছে শুয়ে শুয়ে আমার নানীজানের সেই গুটি বসন্তে মৃত্যুর কাহিনীটি আজ আবার নতুন করে শুনলাম।

মায়ের ভাষায়, তখন এমনই ফাল্গুন মাস নানীজানের হয়েছিলো মুশুরি বসন্ত। বসন্তের নানান রকমফের। জল বসন্ত, গুটি বসন্ত, পানি বসন্ত, মুশুরি বসন্ত, লুতি বসন্ত ইত্যাদি। এ সবই ছিলো শীতলা নামের কল্পিত এক দেবীর অলৌকিক কারিশমা। হিন্দু পুরাণ মতে বসন্তের দেবী শিতলা আর কলেরার দেবী ওলাচণ্ডি। পাপী তাপী মানুষ বা সীমালঙ্ঘনকারী জনপদে নেমে আসতো আসমানী বালা, গজব বা আযাব। হিন্দুরা বলতো শিতলা আর ওলাবিবির কথা।

নানীর মুসুরি বসন্ত হয়ে তার চোখ একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে। তাকে আলাদা ঘরে মশারির তলে রাখা হয়েছে। তার খাবার একদম লিকুইড। মিস্টি আর লাউ ছিলো পথ্য। পরিবার বা আত্মীয় স্বজন কেউ তার কাছে আসবেনা। কবিরাজ অনাথ বন্ধু এসে উঠানে বসে রোগী না দেখেই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যেতেন। দিনের পর দিন বিচ্ছিন্ন থেকে থেকে অতঃপর নানীজান মারা গেলেন। আমার বড় খালা দেখতেই এলেন না আর আমার মাকে নিয়ে বাপজান নানু বাড়ির পশ্চিম পাশের ভিটায় এসে গলা উঁচিয়ে আমার সেজ মামা হাকিম মৌলানাকে ডেকে তাদের আগমনের হেতু জানান। হাকিম মামা ইতোপূর্বে বসন্ত থেকে বেঁচে উঠেছেন। সবাই বলছেন তিনি গুটিহারা, অর্থাৎ শীতলাদেবী তার প্রতি দ্বিতীবার তাকাবেননা। সেই হাকিম মামাই নানীর খেদমত করতেন। মামাকে জানান দিলে তিনি কোলে করে নানীজানকে নিয়ে বের হন। আমার মা দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নানীজানকে দেখে বাড়ি ফিরে যান। অতঃপর নানীজান ইন্তেকাল করলে তিন চন্দ্রমাসের পর আমাদের নিয়ে মা নানু বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পঞ্চাশ বছর পরও মা সেই শোক ভুলতে পারেননি। বলতে বলতে ঢুকরে কেঁদে ওঠেন মা।

করোনা ভাইরাসের এই দিনে চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নে গোটা বিশ্ব এখন মুঠোবদ্ধ। কিন্তু মানুষের অন্ধত্বের বিন্দুমাত্র অবসান ঘটেনি। মানুষ আজও করোনাকে সেই গুটি-বসন্ত বা কলেরার মহামারির মতই বলছে আসমানী গজব।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে শতবর্ষ পূর্বে যখন মানুষ ছিলো অশিক্ষিত, মূর্খ কিন্ত তাদের সেই মজ্জাগত কুসংস্কার থেকে মানুষের আদৌ মুক্তি ঘটেনি। আর তাই আজও তাবিজ, কবজ, থানকুনি, গোমূত্রে মিশে আছে শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলের বিশ্বাস। আজ যেখানে সরকারি বেসরকারি লক্ষ মানুষ চিৎকার করে বলছে সবাই ঘরের মধ্যে থাকুন, সেলফ কোয়ারেন্টাইন করুন। কিন্তু কেউ তা করছেন না।

মূলতঃ করোনা যতোই ভয়াবহ হোকনা কেন গুটি বসন্ত আর কলেরার মতো চোখের সামনে এখন পর্যন্ত কাউকে মরতে দেখছেনা। কী বিচিত্র মানুষের মন আর আচরণ! আজ বরং পত্রিকায় দেখলাম মজার এক কাহিনী। "সরকারি হুকুমে নবীগঞ্জে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা অষ্ট্রেলিয়া ফেরৎ এক প্রবাসীকে দেখতে উৎসুক জনতার ভীড়।"

হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এ জন্মভূমি!

পটুয়াখালী
২০/০৩/২০২০

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়