Ameen Qudir

Published:
2019-10-04 20:38:11 BdST

হজ পালনকালে কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা


ডা. তারিক রেজা আলী
সহযোগী অধ্যাপক, রেটিনা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা


______________________

পাকিস্তানীদের আমি এড়িয়ে চলতে চাই। বিদেশে যেখানেই দেখা হোক না কেন আমার চেষ্টা থাকে শত হস্ত দূরে অবস্থান নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে নিজের নিরাপত্তা বলয় তৈরী করা। তার কারণ, কেন যেন আমার সাথেই তাদের হামেশা বাক যুদ্ধ হয়, আমার চেহারায় এমন অবলা সুলভ কিছু আছে যে তারা নিশ্চিন্তে আমাকে ঘাটাতে সাহস পায়।

হজ্বে যাওয়ার আগে তাই খুব ভয়ে ছিলাম। ওখানে বুঁদ হয়ে থাকতে হয় শুধু আল্লাহর ইবাদতে, কারো সাথে যেন ঝগড়া না হয়, যেন না হয় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। তাই সাধারণত মাথা নীচু করে নিজ মনে হারাম শরীফে যেতাম। হোটেলের লিফট বা নীচের করিডোর কিংবা রাস্তায় শরীরি ভাষায় বুঝে নেওয়া যেত, ঐ লোকটা পাকিস্তানী। তারা লিফটে জোরে জোরে আওয়াজ করে কথা বলবেন, এ ওর সাথে আলাপ করবেন, হাসি-ঠাট্টাও করবেন। অবশ্যই উর্দুতে। আমি নিজ মনে তাদের উপস্থিতি অস্বীকার করতে চাইতাম। আমাকে কেউ উর্দুতে প্রশ্ন করলে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে ইংরেজিতে বলতাম, আপনি কি দয়া করে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করবেন, আমি আসলে বুঝি নি আপনি কি বললেন। বেশীরভাগ সময় প্রশ্নকর্তা আর এগুতেন না, আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম।

আমার বৌ আর ছেলে জানতো আমার এই দুর্বলতার কথা। তারাও আপ্রাণ চেষ্টা করতো আমি যেন কোন ঝামেলায় না জড়াই। এত কিছু করেও কয়েকবার শেষ রক্ষা হয় নি।

 

একবার এশার নামাজ শেষে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি, এক পাকিস্তানী আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে উর্দুতে বললেন, এখান থেকে সরে দাঁড়ান, আরো দুজন নামাজ পড়বেন। কেন যেন আর পারলাম না, ঘুরে যথেষ্ট বিনয়ের সাথেই বললাম, আমার তো শেষ, চলেই যাচ্ছি, আপনি ধাক্কা দিয়ে বলার দরকার কি? একটুতেই উত্তপ্ত হলো পরিবেশ। রেগে গিয়ে তোতলাতে থাকলো সেই লোক। ছেলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল, বাবা, কোন কথা বলার দরকার নেই। আরেকবার তাওয়াফ শেষ করে জমজমের পানি পান করব, বসে গ্লাসে পানি নিচ্ছি, এক লোক আমার মাথার উপর দিয়ে তার গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন ট্যাপের তলায়। কিছুই বললাম না। গ্লাস ভরে যখন তিনি চলে যাচ্ছেন, কারো ধাক্কায়ই হবে, বেশ খানিকটা পানি পড়লো আমার মাথায়, পরনের পাঞ্জাবি ভিজে গেল। অবচেতন ভাবে উপরে তাকালাম, যা ভেবেছিলাম, এক পাকিস্তানী। আমার তাকানোতে নিশ্চয়ই বিরক্তি ছিল, সে বলে উঠলো, কি হয়েছে, জমজমের পানিই তো পড়লো! ঠিকই তো, আমার তো খুশী হওয়ার কথা, আমি কেন বিরক্ত হচ্ছি!

এরকম টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা, বলে শেষ করা যাবে না। ছেলে হাসতো, বলতো বাবা, বেছে বেছে তোমার সাথেই কেন সমস্যা করে পাকিস্তানীরা? আমার সাথে তো হয় না! আমি নিরস বদনে জবাব দিতাম, আমিই হয়তো বা খারাপ লোক বাবা। একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। হজ্বের পরে দেশে ফিরে আসার কিছুদিন আগে হারাম শরীফে নামাজের জন্য বসেছি। খুব জায়গার অভাব, অসম্ভব ভীড়। পাশে এসে বসলেন এক লোক। আড় চোখে তার ব্যাগে পাকিস্তানের পতাকা দেখে তটস্থ হয়ে গেলাম। একটু পর তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি ভারতীয়? ইংরেজীতেই করলেন। জবাব দিলাম, না, আমি বাংলাদেশের নাগরিক। পরের প্রশ্ন, আমি কি করি। আবারো নির্লিপ্ত জবাব দিলাম, পেশায় আমি একজন চোখের ডাক্তার। তিনি বললেন তিনিও একজন ডাক্তার। একটু একটু করে আলাপ জমলো, আমি ঢাকার কোন জায়গাটায় থাকি, তিনি করাচীতে থাকেন সে সবও উঠে এলো। নিজ থেকেই তিনি জানালেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আমাদের দেশে। ১৯৭১ সালে তিনি ক্লাস টেনের ছাত্র ছিলেন ঢাকার মতিঝিল সরকারী স্কুলে। তার চাচা ছিলেন নবাবপুরের ব্যবসায়ী, চাচার বাড়ীতেই থাকতেন তিনি। এক পর্যায়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম ১৯৭১ সাল নিয়ে পাকিস্তানীদের কি চিন্তা? কি মনে করেন তারা? আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জবাব দিলেন, সাধারণ পাকিস্তানীরা জানেই না ১৯৭১ সালে তাদের বর্বরতার কথা। ২৫ শে মার্চের হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী তিনি। ২৬ শে মার্চ সকাল বেলায় মতিঝিল কলোনীর আশে পাশে নিজ চোখে দেখেছেন লাশের স্তুপ। মার্চ শেষে এপ্রিলে তাকে এবং পরিবারের সবাইকে সহ তার চাচা সেই যে ঢাকা ছাড়লেন, আর আসতে পারেন নি। অনেকক্ষণ চুপ থেকে আমি প্রশ্ন করলাম, একজন গর্বিত বাংলাদেশী হিসাবে আমার কি ধারণা থাকা উচিত পাকিস্তানীদের সম্পর্কে? জবাবে তিনি কিছু বললেন না। মাথা নীচু করে বললেন, আমার পূর্ব-পুরুষ ভারতের বিহারের অধিবাসী ছিলেন। আমি আমার জবাব পেয়ে গেলাম। নামাজ শেষে তিনি অপেক্ষা করলেন আমার নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। আমরা হাত মেলালাম। এই প্রথম অন্তর থেকে একজন পাকিস্তানীর সাথে।

আমরা বাঙ্গালীরা কতই না সহজ-সরল। ১৯৭১ সালের কর্মকাণ্ডে শুধুমাত্র লজ্জিত হওয়ায় কি সহজেই না আমরা ভুলে যেতে পারি অতীত ইতিহাস। বন্ধু হিসাবে মন থেকে মেনে নিতে পারি সে সময়ের শত্রু দেশের একজন কে।##

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়