Ameen Qudir

Published:
2019-07-01 20:45:00 BdST

বিভিন্ন অপরাধ সৃষ্টির প্রধান কারণ মাদক সেবন


 

 

 

ডা. ফাতেমা জোহরা
___________________________

মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচারবিরোধী ও এর অপব্যবহার এর আন্তর্জাতিক দিবস গেল সম্প্রতি । মাদক এমন একটি শব্দ যার মানে হল যে সকল দ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার নেতিবাচক অবনতি ঘটায় এবং এই দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি পায় তাকেই মাদক দ্রব্য বলে। আর যে ব্যক্তি এর উপর আসক্ত হয়ে পরে থাকে মাদকসেবী বলা হয়। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের সিংহভাগই সর্বনাশা মাদকের কবলের শিকার। যার প্রভাব শুধু মাদকসেবী নয় সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা ব্যহত এবং বিভিন্ন অপরাধ সৃষ্টির প্রধান কারণ।

বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, এই মরণ নেশা মাদকের কবলে কেবল তরুণরা নয় তরুণীরাদেরও মাদকাসক্তি গ্রাস করে ফেলেছে। যার ফলে বর্তমান সময়ে যুবকের মাদকাসক্তির কারণে সমাজে বিভিন্ন অপরাধ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নির্যাতন, পারিবারিক অশান্তি ও খুন খারাপিও ঘটে চলেছে। যা পারিবারিক, সামাজিক ও আইন শৃঙ্খলা অবনতির প্রধান কারণ উল্লেখ করাটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।যে ঘরে কোনো সন্তান মাদক নেয়, সেই ঘরে শুধু সেই সন্তানই আক্রান্ত হয় না; পুরো পরিবার আক্রান্ত হয়। শান্তি বিনষ্ট হয়। আত্মীয়-স্বজনও আক্রান্ত হয়।

মাদক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা মস্তিষ্ক এর সংস্পর্শ করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়।পারিবারিক অশান্তি ও কলহ,অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও বেকারত্বজনিত হতাশা,মাদকাসক্ত বন্ধু-বান্ধবের সংসর্গ ও প্ররোচনা, প্রেম ভালবাসায় ব্যঘাত, মাদক ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রলোভনের শিকার, কৌতূহল বসত ও সৌখিনতা ইত্যাদি কারনে মাদক গ্রহণ করে মানুষ।একজন মানুষ যখন মাদক নেয়, সে তখন ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। কিন্তু সে নিজে বোঝে না তার পরিবর্তনটা। মাদক মানুষের দেহ ও মানসিক ক্ষতি করে। ক্রমশ তাদের অস্বাভাবিক আচরণ ও বিশৃঙ্খলা তৈরী। এদের ক্ষিধে থাকা সত্বেও খেতে পারে না, ঘুম হয় না। হাসি-কান্নার কোন বোধ থাকে না। ধীরে ধীরে শরীরের ওজন হ্রাস পায়। কিছু কিছু মাদকদ্রব্য ও মাদকসেবী এইচআইভি ও হেপাটাইটিস-‘বি’র সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। ক্যান্সার, কিডনি ড্যামেজ, রক্তচাপসহ নানা অনিরাময়যোগ্য রোগের সৃষ্টি করে।

ইসলাম সকল প্রকার মাদক তথা নেশাদার দ্রব্য হারাম ঘোষণা করেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক নেশাদার দ্রব্যই মদ আর যাবতীয় মদই হারাম’। অথচ এই মাদকের ভয়ংকর থাবায় আজ বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানব সভ্যতা। এর সর্বনাশা মরণ ছোবলে জাতি আজ অকালে ধ্বংস হয়ে যচ্ছে। ভেঙ্গে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বৃদ্ধি পাচ্ছে চোরাচালানসহ মানবতা বিধ্বংসী অসংখ্য অপরাধ। মাদকাসক্তির কারণে সকল জনপদেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বেড়ে গিয়ে মানুষের জান-মাল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সমাজের অধিকাংশ অপরাধের জন্য মুখ্যভাবে দায়ী এই মাদকতা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মদ পান করো না। কেননা তা সকল অপকর্মের চাবিকাঠি’।অন্য হাদীছে এসেছে, ‘তোমরা মদ থেকে বেঁচে থাক। কেননা তা অশ্লীল কাজের মূল’।
প্রতিকার :
১. ইচ্ছাশক্তি : মাদক বর্জনের জন্য মাদকগ্রহণকারীর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। রামাযান মাস মুসলমানদের মাদক বর্জনের উপযুক্ত সময়। সারাদিন মাদক ছাড়া থাকতে পারলে রাতটুকুও থাকা সম্ভব। এভাবে এক মাস অভ্যাস করলে মাদক ত্যাগ করা সহজ হবে।
২. ইসলামের শিক্ষা : ইসলামের শিক্ষা ও বিধি-বিধান পুরোপুরি মেনে চললে মাদক বর্জন করা সহজ হবে।
৩. সামাজিক প্রতিরোধ : মাদক নিবারণের জন্য সমাজ ও স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। মাদক গ্রহণ করাকে ঘৃণার চোখে দেখা উচিত। সমাজপতিগণ নিজেরা মাদকমুক্ত থেকে এবং তাদের প্রভাব খাটিয়ে মাদক প্রতিরোধ করতে পারেন।
৪. মাদকমুক্ত এলাকা গড়ে তোলা : স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, অফিস, আদালত প্রভৃতি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে মাদক বর্জন করা প্রয়োজন।
৫. সচেতনতা বৃদ্ধি : শিশুকাল থেকেই ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে হবে। যাতে ইসলামের বিধি-বিধান সমূহ পালনে তারা আগ্রহী হয়। সাথে সাথে মহান আল্লাহ্র প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা তৈরী করতে হবে। যাতে আল্লাহ পাকের প্রতিটি কথা পালন করতে অভ্যস্থ হয়ে উঠে। মাদক গ্রহণের ক্ষতিকর বিষয় সম্বন্ধে শারীরিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিকগুলো তুলে ধরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদকের ক্ষতি ও অপকারিতা সম্বন্ধে অবহিত হলে এই বদাভ্যাস ত্যাগ করা ও এর প্রতি ঘৃণা জন্মানো সহজ হবে।

৬. চিকিৎসকদের উদ্যোগ : মাদক প্রতিরোধে চিকিৎসকগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন এবং জনগণকে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে অবগত করে তাদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন।
৭. আলেমগণের ভূমিকা : মসজিদের ইমামসহ সমাজের আলেমগণ ইসলামের দৃষ্টিতে মাদকের অপকারিতা সম্বন্ধে জনগণকে অবহিত করতে পারেন এবং মদ্যপায়ীদেরকে ছালাতের দিকে আহবান করে ন্যায়ের পথ দেখাতে হবে। যাতে করে তারা অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ছালাত অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে’ (আনকাবূত ৪৫)। আর ছালাত আদায়ের প্রতি যদি কেউ বিনয়ী হয় তাহ’লে তাকে নেশাদ্রব্য অবশ্যই ছাড়তে হবে।

বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হওয়ার কারণে মাদকের মারাত্মক ক্ষতি সর্বজন স্বীকৃত। ইউরোপীয় ও পাশ্চাত্য সভ্যতা মদ, নারী ও সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক বিশ্বে এ সভ্যতা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। অথচ ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর পূর্বেই সমাজকে সুসভ্য করার জন্য মাদক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলাম মানবতার রক্ষাকবচ। ইসলাম মানুষকে দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছে। ইসলাম মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে হেফাযতের জন্য মাদক বিরোধী আইন রচনা করেছে। একটি সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের জন্য সুস্থ মস্তিস্ক একান্তভাবেই কাম্য। মাদক মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তথা গোটা মানব সমাজের অকল্যাণ ও অমঙ্গল সাধিত হয়। আজ মাদকাসক্তি বিশ্ব মানবতার জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এটি অসংখ্য পাপকার্য, অপরাধ ও অসামাজিক কর্মের মূল।তাই একে লুকিয়ে না রেখে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এর নিকট চিকিৎসা ও পরামর্শ নিতে হবে।

___________________________

ডা. ফাতেমা জোহরা
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়