Ameen Qudir

Published:
2019-05-04 20:23:17 BdST

প্রথম কিস্তি ও দ্বিতীয় কিস্তি  লিঙ্ক একটি ভালোবাসার গল্প লেখার প্রচেষ্টা




দেবব্রত তরফদার
__________________________

বিলম্বিত লয় :

পড়ানোর ব্যাপারে জয়দীপের আগ্রহ ছিল এতটাই যে টিউশন শুরু করার আগে সে নিজেই বোঝেনি । মাধ্যমিক পাস করার পর বুঝলো এবার তার নিজের দায়িত্ব খানিকটা নিজেকেই নিতে হবে । কাজেই সম্পর্কে মামার ক্লাস ফাইভের মেয়েকে দিয়ে তার টিউশন জীবন শুরু । কিছুদিনের মধ্যে তার শান্ত ভোঁতা ছাত্রীটিকে ভালো লেগে গেল এবং শর্তের তুলনায় বেশি সময় ধরে পড়াতে শুরু করে । ফলও হলো স্বাভাবিক । আশার অতীত ফল হওয়ায় অভিভাবকও খুশি। পরবর্তী সময়ে পড়ানোর ক্ষেত্রে সে আর সিলেবাসের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেনি । পড়ার শেষে গল্প বলা বা ছাত্র ছাত্রীদের বাইরের বই এর যোগান দিত স্বতঃস্ফূর্তভাবে । এরকম ভাবে চলতে চলতে কলেজ পার হয়ে গেল । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে একদমই ছিল না । প্ৰথমত একশ কিলোমিটার দূর থেকে যাতায়াত করে পড়া , এবং অর্থসঙ্কট । মায়ের ইচ্ছের দাম দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে হয়তো । কিন্তু দুটি টিউশনের আশু প্রয়োজন । কি আর করা , শেষে পাড়ার এক বন্ধু নিয়ে গেল তার এক বন্ধুর বাড়িতে । জয়দীপের স্টোন ওয়াশের জামা কাপড়ের কারনে বন্ধুর একটু আপত্তি ছিল । কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে জয়দীপ বিলম্ব করছিল না , যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তার ভয়ে। বাড়িতে ছাত্রীর মা ছাড়া আর কেউ ছিলেননা । জয়দীপকে ছাত্রীর মায়ের পছন্দ হয়নি , তাঁর আচরণেই বোঝা যাচ্ছে । বাইরে বেরিয়ে বন্ধু বলে , এরা খুবই রক্ষণশীল তাই তোমার পোশাক ভদ্রমহিলার পছন্দ হয়নি। আসলে এই বন্ধুটির সঙ্গে পরিবারটির সম্পর্ক ভালো হওয়ায় ভদ্রমহিলা নিমরাজি হয়েছেন। জয়দীপের এই টিউশনটা মার গেলে চলবেনা কেননা আপাতত কোলকাতা যাতায়াত করে পড়লেও অন্তত দুটি তিনটি টিউশন করা দরকার , সপ্তাহে তিনদিন করে পড়ালে কিভাবে ম্যানেজ করবে কে জানে । একশ টাকার একটি টিউশন শুরু করেছে আর এটা ষাট টাকা। মন্দ হবে না কারন পাড়ার মধ্যেই , ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে পড়িয়ে বাড়ি ফেরা যাবে তাড়াতাড়ি। এখনো পার্ট টুর রেজাল্ট বেরোতে দু মাস বাকি তাহলে ভর্তির টাকাটা হয়তো জমিয়ে ফেলবে এরই মধ্যে ।
এভাবে উন্ছবৃত্তি করতে ভালো লাগে না জয়দীপের । সেই যে এগারো ক্লাসে ওঠার পর বাবা হাত তুলে দিলেন , তারপর থেকেই এই চলছে । অর্থচিন্তায় ঠিকমতো লেখাপড়াটাই করতে পারলো না সে। টাকার জোগাড় আর টাকার চিন্তা করতে করতে সময় কেটে যায়। আসলে তার কোনো স্বপ্ন নেই।

গ্রামে থাকার সময় বাবার হটাৎ মনে হলো ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য শহরে যাওয়া প্রয়োজন , সেইমতো ব্যবস্থা হলো কিন্তু কিছু বছর পরেই বাবার শরীর অসুস্থ আর পড়া বন্ধ হয়ে যায় যায় করতে করতে টিকে আছে কোনোক্রমে । মাধ্যমিকের পরেই আত্মনির্ভরশীল হবার চেষ্টা কাজেই টিউশন ছাড়া গত্যন্তর নেই । কিন্তু ফল যা হবার হলো উচ্চ মাধ্যমিক , পার্ট ওয়ান কোনো রেজাল্টই ভালো হয়নি। যাইহোক এই টিউশনটা আপাতত বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে । আজই বিকেলে যেতে হবে । ছাত্রীটি কেমন হবে কে জানে । ছোটদিকে বাড়িতে ফিরে কথাটা বলেই ফেলল। বিকেলে যখন রেডি হচ্ছে তখন ছোটদি হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পাজামা বার করে দিয়ে হেসে বললো , এটা পরে যা বোধহয় কাজ হবে ।
জয়দীপ কুন্ঠিতভাবে ওই বাড়িতে ঢোকে , এবং প্রথমেই গৃহকর্ত্রীকে জানিয়ে দেয় তার চা পানের অভ্যাস নেই । ক্লাস নাইনের ছাত্রীটি খাটের উপর বই খাতা সাজিয়ে বসে , অঙ্ক বই জোগাড় হয়নি । শ্যামবর্ণা রোগা ডাগর চোখের মেয়েটি। মায়ের কাছে পরিবার সম্পর্কে জানতে পারে। ভদ্রলোক গানের শিক্ষক , এককালে ক্ল্যাসিক্যাল গানের জগতে নাম ছিল। ছাত্র হিসেবে গানের শিক্ষা শুরু করেছিলেন কানাই দাস বৈরাগীর কাছে । পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীও একই গুরুর কাছে গান শিখতেন। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় ক্ল্যাসিক্যাল গান ভেসে গেছে , এখন শুধুমাত্রই গানের শিক্ষক , তবে শিক্ষক হিসেবে নাম আছে নদিয়া , মুর্শিদাবাদ এই দুই জেলায়। বাড়ির বড় ছেলেটি মেধাবী , কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে গবেষনারত এবং তার পরিবারের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা । ছোট ছেলেটি কোলকাতায় নামী তবলাবাদকের কাছে তালিম নেয় । জয়দীপের বন্ধুর বন্ধু এই ছোট ছেলে । জয়দীপের সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়ে গেল অচিরেই।
প্রথমেই জয়দীপ জানতে পারে ছাত্রীটি অঙ্কে যারপরনাই কাঁচা । প্রায় কোনো বছরই পাশ করতে পারেনা , সেবছরও পারেনি । অন্য বিষয়ে ভালোভাবে উৎরে যাওয়ায় ক্লাসে ওঠার বাধা নেই কিন্তু এবছর স্কুল থেকে অভিভাবককে ডেকে সাবধান করে দিয়েছে ।যেহেতু স্কুল থেকে সরকারি বই পাওয়া যায়নি তাই জয়দীপ বাড়ি থেকে পুরোনো বই নিয়ে গিয়ে পড়ানো শুরু করে । কিছুদিন পড়ানোর পরই তার মনে হয় যত দুর্বল ভাবা হয়েছিল আসলে তত দুর্বল সে নয়। জয়দীপ তার এই পেশাকে এতটাই ভালোবাসে যে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর বাইরে অন্য বিষয়ে বিচরণ করে। এর মধ্যে একটি হল তাদেরকে বাইরের বই পড়তে দেওয়া , আর পড়ার বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে গল্প করা। অদ্ভুত এই পরিবারটি । অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং কুসংস্কারে আবদ্ধ। এদের কান্ডকারখানা দেখে সে অবাক হয় , রাগও হয় তার । সে দেখেছে এবাড়ির দরজা জানালায় ঘন্টারাম লেখা । একদিন কৌতূহল বশত ছাত্রীটিকে জিজ্ঞেস করে । ছাত্রী অবাক কেননা তার শিক্ষক এটাও জানেননা । ঘন্টারাম নাকি মা শীতলার স্বামী , আর দরজা জানালায় ঘন্টারাম লেখা থাকলে মা শীতলা অর্থাৎ বসন্ত রোগ ঢুকতে পারবে না । তার রাগ হয় এবাড়ির গবেশনারত কৃষিবিজ্ঞানীটির উপর কেননা পরিবারের মানুষদের কুসংস্কারমুক্ত করার ব্যাপারে তার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে । পড়ানো চলতে থাকে , এরই মধ্যে একদিন কৃষিবিজ্ঞানী দাদার সঙ্গে পরিচয় হয় । দাদা বোনের পড়ার ব্যাপারে খোঁজ নেন। তারপর অঙ্কের বিষয়টি এসে পড়ে । জিজ্ঞেস করেন , ছাত্রী অঙ্কটঙ্ক পারছে তো ?
হ্যাঁ , মন্দ নয় -- জয়দীপের উত্তর ।
বলো কি , অবাক কথা শোনালে , যাক ভালো ভালো ।তারপর বোনের উদ্দেশ্য করে বলে , বুল্টি চালিয়ে যা। তার গলার স্বরে শ্লেষ ছিল । জয়দীপ তাকিয়ে দেখে শান্ত মেয়েটির ডাগর চোখ ছলছল । লজ্জা অপমানে আধোবদন । সে যেহেতু অঙ্কেরই শিক্ষক তাই নিজেও ছাত্রীর দাদার ব্যবহারে অপমানিত বোধ করে। সেদিন কিছু না বলেই বাড়ি চলে আসে । পরদিন ছাত্রীটিকে বলে , মৌপ্রিয়া বাড়ির সবাই মনে করে কোনোদিনই অঙ্কে তুমি পাস করবে না , আমি কিন্তু কখনই তা মনে করিনা কারন আমার কখনই তা মনে হয়নি। মেয়েটি বুঝতে পারে তার স্যারটি খুবই সিরিয়াস কেননা তিনি তাকে তুই সম্বোধন করেন এবং বাড়ির নামেই ডাকেন। সেও আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে । এরই মধ্যে পার্ট টু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে যায় এবং জয়দীপ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় পড়ানোর রুটিন কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় । এখন সে কলকাতায় ক্লাস করে সাতটার লোকালে ফিরে পড়িয়ে বাড়ি ফেরে। ইতিমধ্যে এরাও নতুন বাড়ি করে উঠে গেল অন্যপাড়ায় যারফলে একটু অসুবিধা হয় আর কি । একদিন পড়ানোর সময় হঠাৎই ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করে জয়দীপ , তোদের বাড়িতে কোনো বই দেখিনা কেন ?
কি বই ?
কেন , পাঠ্যবইএর বাইরের বই ।
গল্পের বই ? মা বলেছে গল্পের বই পড়া খারাপ , মেয়েরা গল্পের বই পড়লে খারাপ হয়ে যায় ।
জয়দীপ ভাবে হাসবে না কাঁদবে , এরা কোন কোন অন্ধকারে পড়ে আছে । তার করুণা হয় মেয়েটির জন্য ।পরদিনই নিয়ে যায় শ্যমাদাস দের লেখা রুনু সিরিজের একটি বই । তারপর বুল্টির হাতে দিয়ে বলে , বইটা পড়বি আর পড়ার পর মাকে পড়তে দিস । এর পরদিন যখন পড়াতে যায় জয়দীপ , গিয়ে দেখে ছাত্রীর চোখমুখ ফোলা , বোধহয় কেঁদেছে । জিজ্ঞেস করে , কি হয়েছে তোর ? মেয়েটি নিজেকে সামলাতে পারেনা , চোখ মুছে বলে , বইয়ে রুনুর ঘটনা কি সত্যি ? জয়দীপ এবার বুঝতে পেরে হেসে ফেলে , ও তুই রুনুর জন্য কাঁদছিস । তারপর পড়ার বাইরে অনেক গল্প হয় । মেয়েটিও ধীরে ধীরে মেলে ধরে নিজেকে । তার মনে অনেক প্রশ্ন , অনেক জিজ্ঞাস্য । এই শুরু ,তার পর অল্প দিনের মধ্যে তার পড়া হয়ে যায় , দুরন্ত ঈগল , নীল ঘূর্ণি , পথের পাঁচালি , ইতি পলাশ , কোনি , এই সব বই । জয়দীপকে ছাত্রীর খিদের কাছে রাস টানতে হয় , হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা এসে গেল । সে বার বার অঙ্কের কিছু চ্যাপ্টার বেছে নিয়ে প্র্যাকটিস করায় । অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন হটাৎ বুলটি বলে , আমি বোধহয় এবার পাস করবো অঙ্কে ।
জয়দীপ হেসে ফেলে , করবিই তো , কিন্তু তোর কেন এমন মনে হলো ?
নতমুখী মেয়েটি বিড়বিড় করে বলে , আগে পরীক্ষার আগেই জানতাম পাস করবোনা তাই ভয় হতো না কিন্তু এবার টেনশন হচ্ছে ।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পড়ে জয়দীপ দেখে কিছু জানা প্রশ্ন ভুল করলেও পঞ্চাশ ষাট পেয়ে যাবে । খাতা বেরোলে দেখা যায় চুয়ান্ন পেয়েছে । আর আর সব বিষয়েই আগের থেকে উন্নতি করেছে । বাড়িতে সেদিন ছিল উৎসবের পরিবেশ । তার সবজান্তা দাদাটিও খুব খুশি । জয়দীপের পিঠ চাপড়ে বলে , অসাধ্য সাধন করেছ তুমি । তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে , মাস্টারকে কাল দুপুরে নেমন্তন্ন খাইয়ে দাও । জয়দীপের পুরোনো কথা মনে পড়ে । সে বলে , পরীক্ষা আমি দিইনি , দিয়েছে আপনার বোন। আমার প্রাপ্য তো মাসের প্রথমেই পেয়ে যাই , আপনারা আনন্দ করুন। তার রুঢ় ব্যবহারে বাড়ির সবাই একটু অবাক হয় কিন্তু বুল্টি পরদিন জয়দীপকে বলে , আপনি ঠিক কথাই বলেছেন দাদাকে ।
এই নতুন বাড়ির উল্টোদিকের গলিতে মামার চেনা একটি পরিবারে নতুন টিউশন নেয় জয়দীপ। মেয়েটি বুল্টির স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে । এপাড়ায় আসার পর ওরা দুজনে একই সঙ্গে স্কুলে যায় । তখন জয়দীপকে নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা শুরু হয় , জয়দীপ এটা ভালোই বোঝে । নতুন ছাত্রীটি লেখাপড়ায় অমনোযোগী , বাড়ির খুবই অদূরে , জেদি এবং সব ব্যাপারে অধিকার ফলাতে ওস্তাদ । সে একদিন ঘোষনা করে , বুবাইদা তুমি বুল্টিকে বই দাও আমায় দাও না কেন ? মামার বন্ধুর বাড়ির সুবাদে এবাড়ির সবাই তাকে ডাকনামে ডাকে । আর চাঁদের পাহাড় বইটি শম্পার একমাসেও পড়া না হওয়ায় , ফেরত দেবার সময় বলে , গল্পটি আমায় বলে দিও । একদিন বুল্টি জিজ্ঞেস করে জয়দীপকে , শম্পা কি আপনাদের আত্মীয় ?
কেন , না তো , জয়দীপ অবাক হয় ।
না ও তো আপনাকে তুমি করে ডাকনামে ডাকে ।
ও , আচ্ছা , আসলে ওর বাবা আমার মামার পরিচিত তাই প্রথম থেকেই ও বাড়ির সবাই আমাকে ডাকনামেই ডাকে।
এর পর আর একদিন বুল্টিকে পড়াতে গিয়ে দেখে মুখভার , জিজ্ঞেস করে , কি ব্যাপার , মুখভার কেন ?
কেন আপনি শম্পাকে একটা টিয়াপাখি দিয়েছেন ?
ও , এই ব্যাপার । গত সপ্তাহে গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার সময় দেখি পাড়ার একটি ছেলে নারকেল গাছের কোটর থেকে দুটো টিয়ার বাচ্চা ধরেছে । তারই একটা নিয়ে আসি পোষার জন্য। কিন্তু বাড়িতে এনে দেখি দুটো বেড়াল ওটাকে ধরার জন্য তাক করছে । তাই ছোটদি বললো , কারো বাড়িতে এটাকে দিয়ে আয় । তখন মনে পড়লো শম্পাদের বাড়িতে একটা ফাঁকা খাঁচা দেখেছিলাম। তাই ওকে পাখিটা দিই ।জয়দীপের টিয়াবৃত্তান্ত শুনে বুলটি বলে , কেন আমাকে দেওয়া যেত না , আমি বাবাকে বলে একটা খাঁচা কিনতে পারতাম না ।
জয়দীপের মধ্যে এক পেশাদার শিক্ষক জেগে ওঠে , সে বলে , ঠিক আছে ফাইনালে অঙ্কে আশি পেলে স্পেশাল গিফট ।
মেয়েটির মুখে আলো খেলে যায় , কি দেবেন ?
সেটা এখন বলা যাবে না।
এর কিছুদিন পরের ঘটনা । জয়দীপকে মাঝে মধ্যেই গ্রামের বাড়ি যেতে হয় রসদ আনার জন্য । আসার পথে রাস্তায় পড়ে কুকুড়দহ বিল । বর্ষায় পদ্মফুলে আলো হয়ে থাকে । এবার ফেরার সময় দেখে কচুরিপানার মধ্যে একটি ছেলে ডিঙি নিয়ে মাছ ধরছে । একটু অনুরোধ করতেই একবোঝা কমলকলি তুলে দেয় । ও মাঝেমধ্যেই নিয়ে আসে এ সময়ে । সন্ধ্যাবেলায় পড়ানোর সময় এক গোছা পদ্মের কুঁড়ি নিয়ে ছাত্রীবাড়ি , এই ভেবে যে পদ্মের কুঁড়ি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কিনা । বুল্টির চোখে এক অপার্থিব আলো দেখেছিল জয়দীপ । আর শেষে পড়ানোর হটাৎই বুল্টি বলে , ফুল কি আপনি শুধু আমাকেই দিলেন ?
হ্যাঁ , কেন ?
আপনি নিশ্চয় শম্পাকে দেবেন না ।
জয়দীপ চুপ , তারপর ভাবে তাকে নিয়ে দুজনের ঝামেলাটা বন্ধ করতে হবে । এই সুযোগ , আর শম্পার মতো গুন্ডা মেয়েকে কিছুতেই মোটিভেট করা যাবে না । তাই বলে , কেন দিলে কি হবে ?
আপনি ওকে একবার টিয়াপাখি দিলেন তো ।
কেন কি হয়েছে তাতে , আর ওকে টিয়াপাখি দেবার কারণটাও বলেছি । তারপর একটু থেমে বলে , তোকে এরকম ভাবতে আমার কষ্ট হয় । আর দাঁড়িয়ে থাকেনি ।কিন্তু পরে ভাবে , মেয়েটাকে না কাঁদালেও হতো , এতটা রুঢ় হওয়া উচিত হয়নি । ওরা ওদের বয়স অনুযায়ী আচরণ করেছে কিন্তু ও নিজেই ছেলেমানুষি করে ফেলল।
এমনিতেই জয়দীপের শরীরটা ছিল খারাপ , সকালে উঠেই গ্রাম থেকে পঁচিশ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এসে রেস্ট পায়নি । রাতে ধুম জ্বর । ওরা ভাড়া থাকে একটা ঘর , টালি ছাওয়া বারান্দা আর পাশেই টালির একটা রান্নাঘর । দিদিরা ঘরে থাকে । আর ও থাকে বারান্দায় , একটি তক্তাপোষে তার রাজত্ব। চারদিকে বই ছড়ানো , রাতে শোবার সময় বইপত্তর সরিয়ে শোবার জায়গা করে নেয় । এই বাড়িতে ইলেকট্রিক কানেকশন নেই । এতদিন হ্যারিকেন চলতো ইদানিং পাশের বাড়ি থেকে লাইন টেনে একটি একশ পাওয়ারের ডুম জ্বলে। রাতে জ্বর আসলেও দিদিদের আর বিরক্ত করেনি । সকালে আচ্ছন্ন অবস্থায় দেখে ছোটদি , মাথায় জল টল ঢেলে জ্বর নামানো হয় । একবার জ্বর আসলে সহজে ছাড়ে না জয়দীপকে । পাড়ার ডাক্তার দেখিয়ে কিছু কাজ হয়নি । জ্বর ওঠানামা করছে , সারা শরীরে বিষ ব্যাথা । তৃতীয় দিন বিকেলেও সে আচ্ছন্নের মত পড়ে ছিল। আধো ঘুমের মধ্যে মনে হয় কারা যেন তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে । ছোটদির কথাও যেন কানে আসে । কপালে শীতল স্পর্শ পেতেই ধড়মড়িয়ে উঠে দেখে বুল্টির ছোটদা সুমন্ত আর পিছনে বুল্টি । সে বইপত্তর সরিয়ে বসার জায়গা করে দেয় । সুমন্ত বলে , তুমি দুদিন পড়াতে যাওনি আমরা সবাই চিন্তা করতে শুরু করলাম তোমার কি হয়েছে তা ভেবে । দ্বিতীয় দিন তুমি পড়াতে না যাওয়ার পর বোন কান্নাকাটি শুরু করে । রাতে খায়নি , শুধু বলছে স্যার আর আমাকে পড়াতে আসবে না । আজ স্কুলে যায়নি । আমি বললাম যে খোঁজ নিয়ে আসছি তা জেদ করে আমার সঙ্গে আসলো।
জয়দীপ হেসে ফেলে , কিরে কেন যাবোনা পড়াতে , জানিসনা তুই আমার একটা চ্যালেঞ্জ ,মাধ্যমিকে তোকে অঙ্কে লেটার পাইয়ে আমার ছুটি। নতমুখী বালিকাটির ডাগর চোখ জলে টলোমলো । ছোটদি হটাৎ জড়িয়ে ধরে তুলে নিয়ে যায় । সুমন্ত রা আর একটু থেকে চলে যায় , সন্ধ্যা হয়ে আসছে ।
পরের সপ্তাহ থেকে আবার জয়দীপের ইউনিভার্সিটি আবার সেই শম্পা আর বুলটিকে পড়িয়ে বাড়ি ফেরা । পড়িয়ে যখন ফিরে আসছে তখন হঠাৎ বুলটি বলে , আমি পদ্মকুঁড়ির ডাটাগুলোকে জলে ভিজিয়ে রেখেছিলাম , টাটকাই ছিল , ওর থেকে অর্ধেক শম্পাকে দিয়েছি।
জয়দীপ হেসে বলে , ভালো করেছিস ।
পরদিন পড়াতে গেলে বুলটি বলে , আমাদের বাংলা দিদি একটি রচনা লিখতে দিয়েছেন , তুমি জীবনে কি হতে চাও । সবচেয়ে ভালো লেখাটা প্রার্থনার পর স্কুলে সব ছাত্রীদের সামনে পাঠ করা হবে ।
ভালো তো , তোর বাংলা ইংরেজি স্যারের সঙ্গে কথা বল।
বলেছি তো , উনি দু তিনটি বই এনে দিয়েছেন , আমার ভালো লাগেনি সেই ডাক্তার , শিক্ষক , সেবিকা , সমাজসেবক । সবাই এইসব লিখবে । আমি অন্যরকম লিখতে চাই।
তা লেখ না , অসুবিধে কোথায় ?
আমি নতুন কিছু ভাবতে পারছি না , আপনি লিখে দিন।
আমি কেন , তোর বাংলা স্যারকে বল , আমার ওসব লেখা টেখা আসেনা , জানিস না অঙ্ক , একাউন্টেন্সি আর ইকোনমিক্স নিয়েই কেটে গেল ।
না আমি জানি আপনিই পারবেন ।
তোর এত ভরসা কোথা থেকে আসছে ?
কেন পড়ার পর আপনি কতো গল্প করেন , আমি জানি আপনিই পারবেন।
ঠিক আছে , দেখি চেষ্টা করে , তোর আবার পছন্দ হয় কিনা দেখি।
পরদিন জয়দীপ ফুলস্কেপ কাগজে একটি লেখা মেয়েটির হাতে দেয় । পড়তে পড়তে জয়দীপ দেখে কিশোরীটির মুখে বিভিন্ন আলোছায়া খেলা করে । অনেক্ষন পর পড়া শেষ হয় । মুগ্ধ এবং কিছুটা বিহ্বল , আমি জানতাম আপনি অন্যরকম কিছু লিখবেন কিন্তু এরকম কিছু ভাবিনি। যদি আমার লেখা সবার চাইতে ভালো না
হলেও আমার আফসোস নেই।
জয়দীপ লিখেছিল আমি মানুষ হতে চাই।
বাধ্য ছাত্রীটির চোখে মুগ্ধতা , আজ একটু বেশি প্রগলভ । বলে , আজ আর পড়তে ভালো লাগছে না ।
জয়দীপ কলকাতা থেকে ফিরে ছিল ক্লান্ত , তাহলে বাড়ি যাই , অনেক কাজ আছে । অমনি ব্যাগ থেকে খাতা আর অঙ্ক বই বেরিয়ে আসে । জয়দীপ হেসে খাতা টেনে নেয়।
অনেকদিন জয়দীপ যখন পড়াতে ঢোকে বুল্টি তখন রেওয়াজ করে । ক্ল্যাসিক্যাল কোনো রাগ হবে । জয়দীপের এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই । তবু অপূর্ব সুন্দর গলা আর সুরের মূর্ছনায় সে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে । অনেক সময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছু সময় , এই লুকোছাপার কারনে তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে । আর দরজায় সামান্য শব্দ হলেই সুরের ঝর্ণাধারার গতিরুদ্ধ । একদিন কৌতূহলবশে জিজ্ঞেস করে , তুই কবে থেকে গান শিখিস ?
কেন , চার বছর বয়স থেকে ।
অনেক কিছু শিখে ফেলেছিস ?
না না কিছুই শিখিনি ।
আমি ক্ল্যাসিক্যাল গানের কিছু বুঝিনা কিন্তু মনে হয় তুই বেশ ভালো শিখেছিস , জয়দীপ হেসে বলে।
এরকমই এক দিনে মৌপ্রিয়া গোস্বামী মানে বুল্টি বলে ফেলে তার বাবা সুবিমল গোস্বামী সম্পর্কে কিছু কথা । উনি ছোটবেলা থেকে কানাই দাস বৈরাগীর কাছে গান শিখতেন , পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ছিলেন ওনার সমবয়সী এবং সতীর্থ । দুজনেই ছিলেন সমান প্রতিভাধর । এর পর দুজনেরই পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে গান শিখতে যাবার কথা ছিল । কিন্তু সে সময়ে সুবিমল বাবুর বাবা মারা যাবার পর সতেরো বছরের ছেলেটিকে সংসারের চাকা ঘোরানোর জন্য গানকেই পেশা হিসেবে নিতে হয় । গান গাওয়া আর হলো না । আজয়বাবু এমন জায়গায় উঠে গেছেন যে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি।শোনা যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্ৰথম সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কথা উল্লেখ করেন । এই অভিমানেই সুবিমলবাবু অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেননি।
বদ্ধ পরিবেশ হালকা করে দেবার জন্য জয়দীপ বলে , তুই তো অজয়বাবুর কাছে গান শিখতে পারিস আর আমরা ভবিষ্যতে টিকিট কেটে মৌপ্রিয়া গোস্বামীর গান শুনতে যাবো ডোভারলেনে ।

 

 দ্বিতীয় কিস্তি  লিঙ্ক 

https://daktarprotidin.com/column/3890/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A7%A8

 

https://daktarprotidin.com/column/3890/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A7%A8

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়