Dr. Rejul Hasan

Published:
2022-04-23 20:10:06 BdST

সিস্টেম


ডা. তারিক অনি

 


ডা. তারিক অনি
রেজিস্ট্রার, জেনারেল সার্জারী
সানশাইন কোস্ট ইউনিভার্সিটি হসপিটাল
সানশাইন কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া
_____________________

ইমার্জেন্সী তে এক ডায়াবেটিক রোগী এসেছে। তার পা এ পচন ধরেছে। সে একই সাথে ধূমপায়ী। সে ডায়াবেটিস এর ঔষধ ঠিকমতো নেয় না, ধূমপান ও ছাড়েনা। আমাকে রেফার করা হল। আমি রেগুলার ওয়ার্ক আপ আর ইনভেস্টিগেশন সাজেস্ট করে বললাম, “ফ্লুইড এন্টিবায়োটিক শুরু কর, আমি এসে দেখে এডমিট করবো।”

কাজের চাপে পরবর্তী চার ঘন্টা আমি রোগী দেখতে পারলাম না। রোগী বিরক্ত হয়ে নিজেকে নিজে ডিসচার্জ করে চলে গেল।

আবার দুই ঘন্টা পর রোগী ইমার্জেন্সীতে হাজির হল। আবার আমার কাছে রেফার করা হল, আমি জানালাম দেখবো। কিন্তু আবারো সে আমার প্রায়োরিটি লিস্টের একদম শেষ সারিতে।

আরও দুই ঘন্টা পর ইমার্জেন্সী থেকে আবার ফোন। তখন আমি থিয়েটারে সার্জারীতে। ওই অবস্থায় নার্স কানের সামনে ফোন ধরলো। ইমার্জেন্সী জানালো, রোগী আবার ও চলে যেতে চায়। আমি বললাম, “অস্ট্রেলিয়া একটি ফ্রী কান্ট্রি। চলে গেলে কাগজ সাইন করে চলে যাক। তবে তাকে জানিয়ে রাখো সে যদি আবার ও ফেরত আসে তাহলে সে আবার ও লিস্টের নীচে চলে যাবে এবং বেশি সময় অপেক্ষা করবে এর থেকে একটু কষ্ট করে অপেক্ষা করা ভালো।” যাই হোক রোগী থাকলো।

আমি প্রায় দশ ঘন্টা পর রোগী দেখতে গেলাম। লো সোসিও-ইকোনমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের রোগী। বাম পা পচন ধরেছে। দেখেই বোঝা যায় যত্ন নেই, তার উপর ধূমপান নেশাপাতি করে, ডায়াবোটিস অনিয়ন্ত্রিত, ঔষধ নেয়না। একদিন তার পুরো পা কাটা যাবে কোন সন্দেহ নেই অথবা সে মারা যাবে।

আমি রোগী দেখলাম। প্ল্যান বললাম। সরি বললাম অনেকক্ষণ তাকে অপেক্ষা করানোর জন্য। সে মহা ক্ষিপ্ত। সে হাসপাতাল কে স্যু করবে, আমাকে স্যু করবে, চিল্লাচিল্লি শুরু করলো। গালাগাল করে ‘এফ’ শব্দ উচ্চারণ করলো।

আমি হাসি দিয়ে বললাম, “সরি বন্ধু, আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি কিন্তু তুমি এবিউজ করছো, যেটা এই হাসপাতালে জিরো টলারেন্স। তুমি মরণাপন্ন না, সো, আমি তোমাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিচ্ছি। আমি সরি তোমাকে সাহায্য করতে পারলাম না।”

আমি কম্পিউটারে ছোট নোট লিখে সিকিউরিটি ডেকে রোগীকে বের করে দিলাম।

এরপর কি হল জানিনা। আজকের শিফটের শুরুতেই হ্যান্ডওভার পেলাম, সেই রোগী আবার ফেরত এসেছে, অলরেডী ঘন্টা চার অপেক্ষা করছে।

আমি হাসিমুখে তাকে দেখতে গেলাম। আবারো সরি বললাম সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য। সে আবার ও ক্ষিপ্ত। তবে এবার আগের থেকে তেজ একটু কম। এবার সে ক্ষোভের সাথে জানালো সে সিস্টেম নিয়ে খুব অখুশি, হাসপাতালের ব্যবহারে অখুশি, সে ইমার্জেন্সীর ডাক্তার নার্সের উপর অখুশি, আমার উপর অখুশি। সে কম্প্লেইন করতে চায়। আমি হাসিমুখে তাকে কম্প্লেইন পেপার এবং হটলাইন নম্বর দিলাম, কম্প্লেইন করতে বললাম। সে জানালো সে আমার নামেও কম্প্লেইন করবে, আমি আমার নাম পদবী দিলাম।

আমি আবারো সরি বললাম, জানালাম কেন আমার দেরী হয়েছিল, এবং তার কি অগ্রহণযোগ্য আচরণের জন্য তাকে গতকাল হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

আমি তাকে জানালাম যে কম্প্লেইন করা তার অধিকার। তবে আমার ইন্সিওরেন্স বেনেফিট অনুযায়ী তার কম্প্লেইন যদি আমার পারফরম্যান্স রেকর্ড এফেক্ট করে তাহলে সেটা প্রটেক্ট করার জন্য আমার ইন্সিওরেন্স লয়ার তার নামে অটোমেটিক “ফলস এলিগেশন” আনার জন্য মানহানীর মামলা করবে- যেটা হেরে গেলে তার বড় অংকের জরিমানা হতে পারে।

তবে আমি তাকে আবারো সরি বললাম এবং জানালাম যে তার সাথে আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই, এটা তার বিরুদ্ধে নয় বরং অস্ট্রেলিয়ান হেলথ সিস্টেম এবং আমার প্রাকটিস কে সুরক্ষিত করার জন্য। সব ডাক্তারই ইনসিওরেন্স নিয়ে কাজ করে।

তাকে আরও জানালাম যে ওয়েটিং রুমে তার চিৎকার গালাগাল এবিইজ ক্যামেরায় এবং বেশ কয়েকটি নার্সিং ডকুমেন্টে রেকর্ডেড আছে, তার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বরং বিপদে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ এসব তার পার্সোনাল রেকর্ডে স্থায়ীভাবে থেকে যাবে।

রোগী চুপসে গেল। এদেশে সবাই সিস্টেম বোঝে। সে মন খারাপ করে আমার সামনেই কেদে ফেললো। তার সাফারিং এর কথা জানালো। তার জব নেই, কমপ্লেক্স সোস্যাল এবং ফ্যামিলি কন্ডিশন, তার উপর ড্রাগ এলকোহল এসব সমস্যায় সে জর্জরিত, সে আর টানতে পারছে না। আমার সামনে একটু আগে হম্বিতম্বি করা লোকটি এখন আমার সামনে সম্পুর্ণ পরাজিত।

আমি বিজয়ের কোন আনন্দই অনুভব করলাম না। বরং নিজেকেই পরাজিত মনে হল। ডাক্তার হয়ে রোগীকে পরাজিত করে কাঁদিয়ে ফেলার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। আমি বিশ্বাস করি, মানুষকে পরাজিত হওয়ার জন্য তৈরী করা হয়নি। বরং তাকে তৈরি করা হয়েছে বিশ্বজয় করার জন্য।

আমি প্রফেশনাল সিম্প্যাথী দেখালাম। সাপোর্ট অফার করলাম। রোগীকে এনগেজ করলাম, কমিটমেন্ট নিলাম যে ট্রীটমেন্টের সাথে সে কন্টিনিউ করবে। তার পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হল। তাকে বিশদ কাউন্সেলিং করা হল যে অনিয়ন্ত্রিত জীবন চালিয়ে গেলে একসময় সে হারিয়ে যাবে জীবনের স্রোতে। একগাদা রেফারাল হল, এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, পোডিয়াট্রিস্ট( পা এর যত্ন বিশেষজ্ঞ), ডায়াবেটিক এডুকেটর, সোস্যাল ওয়ার্কার, কাউন্সেলর ইত্যাদি …

আমি আজ খবর পেলাম রোগীটি অপারেশন না করেই আবারো হাসপাতাল থেকে তার নিজস্ব জগতে ফিরে গেছে। আমি আশ্চর্য হলাম না। এরকম দেখতে দেখতে আমি অভ্যস্ত। সে নিশ্চিত স্মোক করছে, ড্রাগ নিচ্ছে এবং ঔষধ খাচ্ছে না। আমি জানি সে একদিন ঠিক ই ফেরত আসবে। আসতেই হবে। মানুষকে বিশ্বজয় করার অসীম ক্ষমতা দিয়ে পাঠানো হয়েছে সেই ক্ষমতা অবহেলায় পায়ে ঠেলে অনিয়ম করে নষ্ট করার সুযোগ দিয়ে পাঠানো হয়নি। সে তার অনিয়মের জন্য প্রকৃতির কাছে পরাজিত হয়ে ফেরত আসবে।

হয়তো ইমার্জেন্সীতে এসে হৈ চৈ করবে, কোন ডাক্তার-নার্স কে এবিউজ করবে এবং কিকড আউট হবে। হয়তো আবার বোধোদয় হলে ফিরে আসবে, তখন হয়তো সে আরও বেশি অসুস্থ অথবা মরণাপন্ন। হয়তো আমিই তাকে আবার দেখবো এবং নোট লিখবো, “নট ফর সার্জারী, ফর কমফোর্টেবল মেজারস অনলি! “

প্রতিটি ডেথ হাসপাতালে রিভিউ হবে। রিভিউয়ারের চোখে ঠিক ই পড়বে এই রোগীটি বারবার হাসপাতালে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছে। হয়তো সেখান থেকে কোন আপডেট আসবে। অডিট এ দেখা যাবে সে চিৎকার চেচামেচি করার জন্য হাসপাতাল থেকে বিতাড়িত হয়েছে। আবার অডিটর নোট করবে ডাক্তার-নার্সরা তাকে বেস্ট ট্রীটমেন্ট অফার করেছে যেটা সে নেয়নি। হয়তো এখান থেকে আরো স্ট্রং কোন সাপোর্ট সিস্টেম ডেভেলপ হবে। কোন এক কনসালটেন্ট তার রিভিউ নোট এ লিখবে শেষ সময়ে তাকে ব্যাথাহীন শান্তির মৃত্যুর দেওয়ার সব চেষ্টা হাসপাতাল করেছে, তার সৎকার এবং ফ্যামিলি সাপোর্টের ব্যপারটা সরকার দেখেছে। সিস্টেম হয়তো তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে।

এটা একটা চক্র। সিস্টেমের চক্র। এই বিদেশ বিভুইয়ে প্রতিটি জীবন মূল্যবান, সেই সাথে সিস্টেম খুব মূল্যবান। জীবন কে বাচানোর জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে। একই সাথে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিস্বাধীনতা দেওয়া আছে, তবে সেই স্বাধীনচেতা কেউ যদি সিস্টেমকে নষ্ট করতে চায় সেখানে সিস্টেমকে প্রটেক্ট করা আছে। আমরা ডাক্তাররা এই সিস্টেমে রোবটের মত কাজ করি। রোগী সিস্টেমের মধ্যেই চিকিতসা নেয়, চিৎকার করে, কাঁদে অথবা মৃত্যুবরণ করে। এটাই সিস্টেম !

“মানুষ কি আর এমনি বটে
যার চরণে জগৎ লুটে, 
এই না পঞ্চভুতের ঘাটে
খেলিতেছে নিরঞ্জন ।।

মানুষ ধর মানুষ ভজ,
শোন বলিরে পাগল মন ।।”
(বাউল রশিদ উদ্দিন)

##

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়