Dr. Aminul Islam

Published:
2021-04-06 17:59:28 BdST

নিজের পরিবার সদস্যদের হত্যা, আত্মহত্যার আরও যেসব ট্রাজেডি


সুব্রত নন্দী

কানাডা থেকে 

-------------------------------------

আজ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস সংলগ্ন উপশহর অ্যালেনে( Allen) বসবাসরত একটি বাঙালি পরিবারের বাড়িতে ৬ টি মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারনা করছে একই পরিবারের দুই টিনএজ সহোদর ভাই একের পর একজন করে তাদের দাদি, মা, বাবা, বোনকে হত্যার পর নিজেরা আত্মহত্যা করে। পুলিশ তাদের রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট থেকে জানতে পারে যে তীব্র বিষন্নতায় আক্রান্ত দুইভাই প্রথমে নিজেরাই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের আত্মহত্যার জন্য পরিবার কষ্ট পাবে এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তারা এইকাজটি করে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টরন্টোর মারখাম সিটিতেও অনুরূপ ঘটনায় প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে প্রথমে তার মা'কে হত্যা করে , তারপর দাদীকে। এরপর সে বসে ভিডিও গেম খেলতে থাকে এবং অপেক্ষারত থাকে কখন তার বাবা ও বোন কাজ থেকে আসবে। রাত ১১ টায় বোন ফিরে এলে বোনকে তৎক্ষণাৎ হত্যার পর আধা ঘন্টার মধ্যে বাবা ফিরে এলে বাবাকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রে তার বন্ধুদের সে ফোন দেয়, 'আই হ্যাভ স্লটারড অল অব মাই ফেমিলি মেম্বার'স।' কিছুদিন আগে ছেলেটির ৪০ বৎসরের উইথআউট প্যারল সহ যাবত জীবনের কারাদণ্ড হয়।

২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বাঙালি পরিবারের দুই ভাই মিলে তাদের বাবা মা'কে হত্যা করে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কানাডার একাধিক বাঙালি পরিবারে টিন এজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এইসব ঘটনার পিছনে কি মনস্তাত্বিক অসুস্থতা কাজ করছে? সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের ভাল ভাল চাকুরি ছেড়ে দিয়ে যারা যুক্তরাষ্ট্র কানাডাতে আসছেন সেই সন্তানদের সঙ্গে কেন তাদের সম্পর্কের এই দুরত্ব? কেন নিজের বাবা মা'কেই সন্তানরা হত্যা করছেন?

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করছেন এসবের পিছনে থাকে
বিষন্নতা ( depression) নামের ভয়ন্কর এক ব্যাধি। আমাদের প্রজন্মের ব্যবধানকে আমরা স্বীকার করতে চাই না, তাদের সঙ্গে সবসময়ই একটা সম্পর্কের ব্যবধানকে আমরা টিকিয়ে রাখি শাসন করার অজুহাতে। পারিবারিক দাম্পত্য কলহ, ডিভোর্স, গায়ে হাত তোলার ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ানদের জন্য একটি পরিচিত দৃশ্যপট। এখান থেকে সন্তানদের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তার মনোভাব তৈরি হয়ে যায়। আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির দেশে এসে তাদের মুলস্রোতে মিশতে দিতে চাই না। ধর্মীয় রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে তাদের মধ্যে জীবনকে উপভোগ করার গুরুত্বপূর্ণ অংশের যবনিকাপাতকে তারা মেনে নিতে চায় না। তারপর থাকে সন্তানদের উপর অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ। সবাইকে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উচ্চ শিক্ষিত হতেই হবে, না হলেই ভর্সনা,তিরস্কার, তুলনা। অমুকের ছেলে এইটা পড়ে, তুমি কেন পার না? স্বাভাবিকভাবেই সন্তানদের মধ্যে তখন সৃষ্টি হয় হতাশার অন্ধকার। ভেতরে ভেতরে সে ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে যায়। পুন্জিভূত হতাশা থেকে আসে আত্মহত্যার চিন্তা। পরিবারের প্রতি আক্রোশ, ঘৃণা ও প্রতিশোধের জিঘাংসা। টরন্টোর ঐ পরিবারের ঘটনাটি ছিল তেমন ছেলেটিকে জোর করে বাবা মা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পাঠায়। পরপর তিন সেমিস্টার সে ফেল করে ঘরে বসে থাকত। এরপর তার উপর আসে ভর্সনা ও তিরস্কারের চাপ। এই চাপ হতে নিষ্কৃতি পেতেই সে এই জঘন্যতম কাজটি করে বসে।

আমরা কেন আমাদের সন্তানদের বন্ধু হতে পারি না? কেন তাদের কষ্টের কথাগুলো অথবা চিন্তা চেতনাকে মুল্য দিয়ে তাদের সঙ্গে সহভাগ করি না? কেন সবাইকেই উচ্চ শিক্ষিত হতেই হবে? কেন তাদের উচ্চ শিক্ষিত হবার চাইতে তাদের একজন ভাল মানুষ হবার পথকে আমরা অভিনন্দিত করি না? প্রত্যেকটি মানুষের এক একটি আলাদা ট্যালেন্ট থাকে। তারা সেটার উপর নির্ভরশীল থেকেই নিজেদের জীবিকাকে বেছে নেয় । হোক সে একজন ব্যাবসায়ী, হোক সে একজন ট্রাক ড্রাইভার, অথবা ওয়েল্ডিং অপারেটর। এটা পশ্চিমা সংস্কৃতির দেশে কোন অসম্মান নয়। একজন ডাক্তারের স্বামী এখানে কারখানার সুপারভাইজার, তাতে কি? প্রত্যেক মানুষের এখানে সম্মান আছে। অর্ধ শিক্ষিত হলেও সে অচ্ছুত কেউ নয়, সে কাজ করে খায়, চুরি তো করেনা, ঘুষ তো খায় না। তারও বাড়ি আছে ঘর আছে, আশ্রয় আছে, সমান মাপের চিকিৎসা আছে, গাড়ি আছে , তো সমস্যাটা কি? কেন আমরা সেই বৃটিশদের সামন্তবাদী চিন্তা নিয়ে আমাদের প্রত্যেক সন্তানদের অন্যের উপর প্রভুত্ব করার জন্য তৈরি করতে চাই? এখানে খোদ প্রধানমন্ত্রীও জনগনের চাকর, কেউ কারো বস বা প্রভু নয়। আমার এই প্রশ্নগুলোর মধ্যেই এইসব ভয়ন্কর সামাজিক অপরাধ গুলোর উত্তর আছে।

আসুন আমরা আমাদের সন্তানদের বুকে তুলে নিয়ে তাদের বোঝার চেষ্টা করি, তাদের বন্ধু হয়ে যাই।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বক্তব্য

 

প্রফেসর ডা সুলতানা আলগিন
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
কনসালটেন্ট ওসিডি ক্লিনিক, জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা


কেন এই ট্রাজেডি, জীবনগুলো বাঁচানো যেত যেভাবে
-----------------------------------

কিছু দিন একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশী পরিবারের দুই মনোরোগীকে ভিডিও কনসালটেশন করেছি।
তারা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা দীক্ষা প্রতিষ্ঠায় উন্নত পরিবার।

 

কিন্তু ৫ সদস্যর পরিবারের ২ নবীন মেধাবী সদস্য এখন সারাক্ষণ অন্ধকারে থাকে। তারা অালোতে অাসতে চায় না।

তারা বিশ্বাস করে, এটা ভীষণ ভালো পথে। লেখা পড়া তারা অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তারা বিভিন্ন গায়েবী অাওয়াজ শোনে। তারা গায়েবি নির্দেশ পায়।
সেই গায়েবি নির্দেশ মোতাবেক তারা অন্ধকারে জীবন যাপন শুরু করেছে।
ও-ই রোগীদের পিতামাতা ডক্টরেট। বড় চাকুরী বাকুরী করেন। তারা কনভিন্সড ছিলেন, তাদের ২ সন্তান অন্যজগতের এলেম পেয়েছে। এটা অতি সৌভাগ্যর ব্যাপার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডক্টরেট ডিগ্রি ধারী। অথচ সেই উচ্চশিক্ষিত পিতা মাতা তাদের সন্তানদের অস্বাভাবিকতা পাত্তা দেন নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন হাসপাতালে মানসিক রোগ চিকিৎসা করান নি।
বরং সন্তানের অস্বাভাবিকতার মধ্যে অলৌকিকতা খুঁজে পেয়েছেন।
তারা বাংলা দেশের একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ র মাধ্যমে প্রথম ধারনা পান, তাদের সন্তানরা মানসিক রোগী।
বলা যায়, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের প্রতি সদয় হয়ে তারা অামার শরণাপন্ন হন।
অামি ভিডিও কনসালটেশন চেম্বার এ বসে ভিডিওতে তাদের চিকিৎসা দেই। রোগীদের সঙ্গে কথা বলি। কি ধরনের মানসিক রোগ, তা চিন্হিত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিই।

নিয়মিত ফলোআপ চিকিৎসা নিচ্ছে তারা।
দুই সন্তান অনেকটা সুস্থ। কাজে কর্মে মনে দিয়েছে। অফিস করছে।
অাশা করি, নিয়মিত ফলোআপ চিকিৎসা নিলে তারা জীবনভর সুস্থ জীবন যাপন করবে বলে অামি অাশাবাদী মানসিক রোগ চিকিৎসক হিসেবে।
মনে রাখতে হবে, এই দুটি মানসিক রোগীকে ভালো থাকতে হলে দীর্ঘদিন ফলোআপ চিকিৎসা নিয়মিত নিতেই হবে। বাদ দেওয়া যাবে না।

সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলা দেশি পরিবারটির ট্রাডেজিতে ভীষণ ভাবে মর্মাহত বোধ করি। শোক জানাই।
কেন তারা অাত্মঘাতী হল, এখনো সঠিক কারণ জানা যায় নি।

শুধু অাফসোস হচ্ছে, অাশঙ্কা হচ্ছে, এই সবাইকে হত্যা করে অাত্মঘাতী দুই সন্তানও মানসিক রোগী ছিলো কিনা।
যদি তারা, তাদের পরিবার বিষয়টি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা বাংলা দেশের কোন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কনসালটেশন নিতেন, নিশ্চয়ই পরিবারটি এই মর্মান্তিক ট্রাজেডি থেকে রক্ষা পেত। মনোরোগ চিকিৎসকরা তাদের জীবন রক্ষা করতে পারতো।
মনে রাখতে হবে, পরিবারে মানসিক রোগী থাকলে লুকোবেন না। দেশে বিদেশে যেখানে থাকুন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। তাকে দেখান। নিজে বাঁচুন।মনোরোগীদের অসুখ থেকে বাচিয়ে সুস্থ জীবন নিশ্চিত করুন।

 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশী চিকিৎসক অধ্যাপক ডা সেজান মাহমুদ এক বিশ্লেষণে বলেন,

টেক্সাসে একটি বাংলাদেশি পরিবারের ছয় জন খুন। মূলত দুই ভাই মিলে পরিবারের সবাইকে গুলি করে হত্যা করে, তারপর নিজেরা সুইসাইড করে। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন, সুইসাইডাল বিহেভিয়ার মূলত কারণ। কী নিদারুন ট্রাজেডি, কী কষ্টকর কাহিনি। ছেলেটির সুইসাইড নোট পড়ছি আর চোখ ভিজে আসছে। চারপাশে বিষন্নতা মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশের কাউকে বিষন্ন মনে হলে বা আত্নহত্যার কথা বললে সিরিয়াসলি নিন। ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিন।

আমি নিজের চোখে দেখি এমনকি শিক্ষিত, চিকিৎসক, প্রফেশনালরা কীভাবে সামাজিক সস্তা প্রতিযোগিতায় নামে, তার প্রভাব পড়ে নিজেদের ওপরে, শিশুদের ওপরে। এইসব টক্সিক লোকজন থেকে দূরে থাকুন। বিত্ত বা সামাজিক প্রতিপত্তির সস্তা প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। মানুষ কে ভালবাসার মধ্যেই মানব জীবনের সার্থকতা! সকলের কল্যান হোক!

পুনশ্চ: সেইসঙ্গে আমেরিকার মুনাফালোভি অস্ত্র কোম্পানিগুলো পিস্তল বন্দুক সহজলভ্য করে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে। যা এখন জনস্বাস্থ্যের জন্যে হুমকি।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়