Dr. Aminul Islam

Published:
2020-10-17 16:34:50 BdST

অজ্ঞান বাবু


 


ডা. সুকুমার সুর রায়
___________________________________


বিশ্বের সকল এনেস্থেসিওলোজিস্টকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই।
অপারেশন টেবিলে একজন সার্জনকে আমরা সবাই চিনি।
অপারেশনের সফলতা, ব্যর্থতা, রোগীর ভাল, মন্দ
সবকিছুর জন্য আমরা সার্জনকেই জানি।
সকল দায়ভার
সার্জনকেই বহন করতে হয়।
আসলে কি তাই?
অপারেশন টেবিলে আরও একজন বা একদল লোক, নিরবে,নিভৃতে কাজ করে থাকেন।
সার্জনের উপর যেমন নির্ভর করে অপারেশনের সফলতা ও ব্যর্থতা, তেমনি এই নিভৃতচারি চিকিৎসকদের উপর নির্ভর করে একটি সফল অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়া, নির্ভর করে রোগীর জীবন ও মৃত্যু এবং তা শুধু অপারেশন টেবিলেই সীমাবদ্ধ নয়, অপারেশন প্রক্রিয়া শুরুর আগে থেকে শেষ হওয়ার পর পর্যন্ত তার কার্যক্রম বিস্তৃত থাকে।
এনারাই অজ্ঞান বাবু নামে পরিচিত (পরিহাস করে ডেকে থাকেন চিকিৎসক বন্ধুরা) , আসলে এনারা এনেস্থেসিওলোজি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী অবেদনবিদ (Anaesthesiologist) ।
নিভৃতচারী বললাম এই কারনে যে, ওনারা সার্জন বা অন্য চিকিৎসকের মত সাধারনের সংস্পর্শএ আসেন না। ওনারা অপারেশন থিয়েটারে ঢোকেন অনেকের অগোচরেই, সকল দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন, অপারেশন শেষে সার্জন যখন বের হয়ে যান তার পরেও
অবেদনবিদ,রোগীর সকল শারীরিক স্থিতিশিলতা নিশ্চিত করে ও টি থেকে সকলের অগোচরে বের হয়ে যান। অবশ্য অপারেশন থিয়েটারে সার্জন, অবেদনবিদ,ও অন্যান্য সবাই মিলে একটি সুন্দর বাদ্যদলের ( Musical team) মত কাজ করেন।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সার্জনই ফ্রন্টে থাকেন,
রোগী এবং তার নিকটাত্মীয়দের সাথে কথা বার্তা বলেন,মোটামুটি সব ক্ষেত্রে টিম লিডার ও মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে থকেন।
তাই অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়ায় অবেদনবিদের ভূমিকা গৌন ও সাধারন্যে অনেকাংশে অজ্ঞাতই থেকে যায়।
দেখা যাক কি করেন একজন অবেদনবিদ, বা তার কি ভূমিকা?
অপারেশন প্রক্রিয়া শুরুর আগেই একজন অবেদনবিদ রোগীর শারীরিক ফিটনেস (physical assessment)
আছে কিনা তা দেখে নেন।
শারীরিক ভাবে যোগ্য বিবেচিত হলে, রোগীকে অজ্ঞান করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পুর্বেই একটা সম্মতি পত্রে স্বাক্ষর নিয়ে রাখতে হয়।
ঝুঁকি আছে বলেই এই সম্মতিপত্রের( consent) ।
ব্যবস্থা। অবশ্য আধুনিক অবেদনবিজ্ঞানে ঝুঁকি নাই বললেই চলে ।
প্রথমেই শিরায় একটি চ্যানেল ( I.V channel) তৈরী করা হয় যাতে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দ্রুত শিরার মাধ্যমে পুশ করা যায় এবং প্রয়োজনীয় তরল ও লবন সমুহের সরবরাহ নিশ্চিত থাকে( Life line) ।
রোগীকে অজ্ঞান করা হয়, তার মানে এই সময় আসলে কি ঘটে!?
জেনারেল এনেস্থিসিয়া হল এমন এক অবস্থা যেখানে একজন মানুষ 'কোমায়' গেলে যে অবস্থা হয় হুবহু সেই অবস্থা ইচ্ছাকৃত ভাবে ঘটানো হয়।
মুলত ;
৪ টি ঘটনা ঘটে ::
-------------------------
১) - Amnesia -- স্মৃতিশক্তির বিলোপ।
২) Muscle paralysis -- মাংশপেশীর অবশতা।
৩) Analgesia -- বেদনার অনুভূতিহীনতা।
৪) Sedation -- গভীর ঘুম।
এই ৪টি ঘটনার সমন্বিত রুপকেই আমরা 'অজ্ঞান' অবস্থা বা এনাস্থেসিয়া বলে বুঝে থাকি।
এই অবস্থা ঘটানো হয় কিছু ওষুধ পত্রের মাধ্যমে যার কিছু শিরার মধ্যে দিয়ে কিছু আবার গ্যাস আকারে সরাসরি ফুসফুসের মধ্যে প্রয়োগ করা হয়।
* প্রথমে একটি ওষুধ দিয়ে গভীর ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয় সেকেন্ডের মধ্যে!
ঘুম পাড়ানী মাসি পিসীর মত ঢিমাতালে নয়।
* দ্বিতীয়ত আর একটি ওষুধ ( muscle relaxant)
দিয়ে সকল মাংশপেশী অবশ করে দেওয়া হয়।
* তৃতীয়ত যেহেতু মাংশপেশী অবশ হয়ে যায়, রোগীর
শ্বাস প্রশ্বাসও বন্ধ হয়ে যায়, তাই তার কৃত্তিম শ্বাস
প্রশ্বাসের জন্য দ্রুত একটি প্লাস্টিকের নল ( Endo -
tracheal tube) ল্যারিংগোস্কোপের সাহায্যে শ্বাস -
নালীতে স্থাপন করা হয়।
* চতুর্থত শ্বাস নালীতে স্থাপনকৃত টিউবটির বাইরের
অংশ এনাস্থেসিয়া মেশিনের একটি অংশের সাথে
সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে কৃত্তিম শ্বাস
চালু করা হয়, একই সংগে প্রধানত ৩ ধরনের গ্যাস,
অক্সিজেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ও হ্যালোথেন
পরিমানমত সরবরাহ করা হয়।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি মিনিটখানেক সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়।
কৃত্তিম শ্বাস পরিচালনা করতে হয় দুই ভাবে :
ক) ভেন্টিলেটর মেশিনের সাহায্যে, স্বয়ংক্রিয় ভাবে।
খ) ভেন্টিলেটর না থাকলে, ম্যানুয়ালি, অর্থাৎ অবেদনবিদ হাতে ব্রিদিং ব্যাগ চেপে চেপে শ্বাস চালু রাখেন, তার মানে হলো,আপনার ফুসফুস একজন অবেদনবিদের হাতের মুঠোয় থাকে!
৩ ধরনের গ্যাসের কাজ :
১) অক্সিজেন - জীবন রক্ষা করে।
২) নাইট্রাস অক্সাইড - বেদনা নাশক।
৩) হ্যালোথেন - চেতনানাশক।
রোগীর শরীরের সাথে একটি পালস- অক্সিমেট্রি মেশিন সংযুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে রোগীর হ্রদপিন্ডের গতি ও রক্তের অক্সিজেন এর মাত্রা মনিটরিং করা হয়।
যতক্ষন অপারেশন চলে ( ঘন্টার পর ঘন্টা) ততক্ষন এই অজ্ঞান অবস্থা বজায় রাখতে হয়, পাশাপাশি তার শারীরিক অবস্থাও ফিট রাখতে হয়।
অজ্ঞান করার শুরুতেই শ্বাস বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি হ্রদপিন্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে (cardiac arrest) ।
সেই অবস্থাতেও অবেদনবিদ কার্ডিয়াক ম্যাসেজ দিয়ে হার্ট পুনঃ চালুর চেষ্টা করেন, অধিকাংশ সময় সফল হন, কোন কোন ক্ষেত্রে সফল হন না।!
অস্ত্রোপচার শেষ হবার পরে আবার জ্ঞান ফিরিয়ে দেবার পালা।
এবার অন্য একটি ওষুধ প্রয়োগ করা হয় যা মাসুল রিলাক্সেন্টের বিপরীত( Reverse) ।
এই ওষুধে মাংশ পেশি আবার তার শক্তি ফিরে পায়, ফলে সে স্বাভাবিক শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে, এই অবস্থায় একজন অবেদনবিদ দক্ষতার সাথে অচেতন অবস্থা থেকে চেতন অবস্থার সমন্বয় সাধন করেন।
ধীরে ধীরে তার সমস্ত এনেস্থেটিক ওষুধ বন্ধ করা হয়।
এন্ডোট্রাকিয়াল টিউব খুলে দেওয়া হয়।
রোগী স্বাভাবিক শ্বাস নিচ্ছে কিনা তা মনিটর করা হয়, তার চোখ খুলতে বলা হয়, তার জিহ্বা দেখাতে বলা হয়, ঢোক গিলতে বলা হয়, এমন কি তার কথাও শোনা হয়।
তার পর আবার তাকে বেদনা নাশক ও ঘুমের ওষুধ দিয়ে পোষ্ট অপারেটিভ রুমে অথবা স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এই যে অচেতন করা ও চেতনায় ফিরিয়ে আনা এই প্রক্রিয়াকে একটি বিমানের টেক অফ ও ল্যান্ডিং এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
একজন দক্ষ পাইলট যেমন দক্ষতার সাথে টেক অফ ও ল্যান্ডিং করে আমাদের ভ্রমন নিরাপদ করেন, তেমনি একজন দক্ষ অবেদনবিদ আমাদের জীবনের সবচাইতে সংকটজনক সময়ে তার দক্ষ হাতে আমাদেরকে অচেতন করেন আবার চেতনায় ফিরিয়ে আনেন।
চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হাজারো অবেদনবিদ কে
জানাই সশ্রদ্ধ স্যালুট ।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়