Ameen Qudir

Published:
2020-04-09 17:15:20 BdST

করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই


সেরীন ফেরদৌস 

_______________________

করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই
করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তির লাশ থেকে বাতাসে ভাইরাস ছড়ায়? কেউ কাছে গেলে, ছুঁলেই কি তিনি আক্রান্ত হবেন? পাড়া বা মহল্লার কবরস্থানে কবর দিলে সেই কবর থেকে কি আপনা-আপনি বাতাসে পুরো এলাকায় ভাইরাস ছড়াবে?

না। এগুলোর কোনোটাই ঘটবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই নিশ্চিত করেছেন যে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাইরাস ছড়ানো বা কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না।

করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের শেষকৃত্য সম্পাদন করা নিয়ে নানা দেশেই বিভিন্ন রকমের সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক স্থানেই করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির গোসল, জানাজা, দাফনে সমস্যা তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও নিজেদের এলাকায় কবর দিতেও বাধা দেওয়া হয়েছে। ভুল ধারণা এবং ভুল প্রচারণার কারণেই এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটেছে। এটা সত্য, করোনায় মৃত্যুবরণ করা কারো শেষকৃত্যে বেশি মানুষের সমাগম নিরুৎসাহিত করা হয়। সেটি করা হয় পার্সোনাল ডিস্টেন্সিং নিশ্চিত করতে, যাতে শেষকৃত্যে যোগ দিতে এসে অনেক মানুষের জটলায় ভাইরাসটি আরও ছড়িয়ে না পড়ে।

তাহলে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছুই কি নেই! না নেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের গবেষকরা তাই

বলছেন। থাইল্যান্ডের ডিপার্টমেন্ট অব মেডিকেল সার্ভিসেসের ডিরেক্টর ড. Somsak Akhasilp ব্যাংকক পোস্টকে বলেছেন, হোস্ট (মানব শরীর) মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের ভেতরে থাকা ভাইরাসেরও মৃত্যু ঘটে। সে আর বংশবৃদ্ধি করতে পারে না।

এখন পর্যন্ত পাওয়া নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও নিশ্চিত হয়েছে করোনাক্রান্ত লাশের শরীর থেকে ভাইরাস বাতাসে এমনি এমনি ছড়িয়ে পড়ে না! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবেই বলেছে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ থেকে অন্য কেউ করোনায় আক্রান্ত হ্ওয়ার একটি ঘটনাও ঘটেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এই ভাইরাসটি এয়ারবোর্ণ (বায়ুবাহিত) নয় যে বাতাসে উড়ে উড়ে এদিক-ওদিক যাবে! এটি কেবল সর্দি, কাশির ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়! মৃত ব্যক্তি যেহেতু হাঁচি বা কাশি দিতে পারে না ফলে ড্রপলেট আসার সুযোগও থাকে না। আর ড্রপলেট না বেরোলে ভাইরাস ছড়াবে কিভাবে!

অনেকের মনেই হয়তো বা উদ্বেগ আছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ থেকে পিলপিল করে ভাইরাস বের হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে কি-না। গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন, সেরকম ভয়ানক কিছু ঘটে না! এ সবই মানুষের মনের দুঃশ্চিন্তা মাত্র। কেউ লাশের গায়ে হাত ছোঁয়ালেই তার হাতে ভাইরাস লেগে যাবে না! মানে, চামড়ার ওপর কোনো জীবাণু স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেগে থাকে না বা ঘোরাঘুরি করে না। লাশের নিজে থেকে ভাইরাস ছড়ানোর কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য জ্বর বা কলেরায় মৃত ব্যক্তির লাশের শরীর থেকে রক্ত অথবা পায়খানা বেরিয়ে শরীর মাখামাখি হয়ে গেলে খালি হাতে তা ছুঁতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে।

করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃতদেহ সৎকার বা শেষকৃত্য সম্পাদনের জন্য একটি নির্দেশিকাও তৈরি করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। গত ২৪ মার্চ নির্দেশিকাটি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ ও প্রচার করেছে। সংস্থার গবেষণা ও নির্দেশিকা অনুযায়ী, সাবধানতা অবলম্বন করে লাশের শরীর স্বাভাবিকভাবেই সাবান-পানি দিয়ে গোসল করানো যায়, কাফনের কাপড় পরানো যায়, প্রিয়জনকে দেখানো যায় এবং গোরস্তানে দাফন বা চিতায় পুড়িয়ে ফেলা যায়। তারা বলেছেন, বৈজ্ঞানিকভাবে নিজের সাবধানতা ছাড়া অযথা ভয়ের কোনো কারণই নেই!

একটি বিষয় পরিষ্কার করি। করোনা ভাইরাস শুধু ফুসফুসটাই আক্রান্ত করে। জীবিত রোগীর নাক-মুখ থেকে বের হওয়া হাঁচি-কাশি-থুথু, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, কাছাকাছি ছোঁয়াছুঁয়ির মাধ্যমে জীবাণুটি একজনের কাছ থেকে আরেকজনে ছড়ায়। জীবিত করোনা রোগীর বেলায় যা সত্যি, লাশের বেলায়ও তা সত্যি। শরীরের চামড়া ভেদ করে কোনো জীবাণু বাইরে আসে না। আবার লাশটি হাঁচি-কাশিও তো দেবে না আপনার মুখের ওপর! তাহলে? জীবাণুগুলো একটি মৃতদেহের অভ্যন্তরে আটকা পরে মাত্র! মৃত ব্যক্তির ফুসফুসের ভেতরেই সেগুলো আবদ্ধ হয়ে থাকে। শরীরের অন্যান্য জায়গায় যেমন হাত-পায়ের ভেতরের মাসলে তা থাকে না। আরও একটি জিনিস বোঝার আছে, তা হলো, ভাইরাস সবসময় জীবিত প্রাণীর দেহের জীবিত কোষে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করে। মৃত কোষের ভেতরে সেও মৃত ভাইরাস।

তবে কথা আছে। হ্যাঁ, ফুসফুস থেকে রক্তপ্রবাহে যেতে পারে ভাইরাসটি, বা দেহ থেকে বের হওয়া অন্যান্য তরল পদার্থের ভেতরে কিছুক্ষণ সময়ের জন্য থাকতে পারে। যেমন, লাশের পায়খানা বা নাক থেকে গড়িয়ে পরা রক্ত, মুখের লালায় কিছু সময়ের জন্য ভাইরাসটি জীবিত থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে মৃতদেহের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা এই তরলপদার্থ খালি হাতে স্পর্শ করে সেই হাত নাক-মুখ-চোখে না নিলেই এই ভাইরাস সংক্রমণের কোনো আশংকা থাকে না।

করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ এর শেষকৃত্যের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কতগুলো করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে:

১. যে বা যারা মৃতদেহটি নাড়াচাড়া করবেন তাদের অবশ্যই হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে প্রয়োজনীয় পিপিই (গ্লাভস, মাস্ক, গগলস/শিল্ড, গাউন) পরে নিতে হবে।

২. মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের ছিদ্রগুলো অথবা কাটা জায়গা (মুখ, নাক, পায়ুপথ, কান, ইনজেকশন পয়েন্ট ইত্যাদি) তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ বা কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে।

৩. সব ধরনের বাড়তি জিনিস যেমন; মাস্ক, অক্সিজেন, ক্যাথেটার, আইভি অথবা গহনাপত্র ইত্যাদি খুলে ফেলতে হবে। এগুলো খোলার পর যথাযথ গার্বেজ বা গহনাগুলো সঙ্গে সঙ্গে সাবানপানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এসময়ে রোগীকে বারবার নাড়াচাড়া না করা ভালো।

৪. লাশকে একটি পরিষ্কার কাপড় বা পলিথিনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং দাফনের আয়োজন করতে হবে।

৫. লাশ যারা দেখতে আসবেন, তারা কেউ লাশ ধরলে সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলবেন।

৬. গোসল এবং দাফনের জন্য যাদের লাগবে তাদের জন্য দরকারি পিপিই (গ্লাভস, মাস্ক, শিল্ড ইত্যাদি) জোগাড় করে রাখতে হবে।

৭. যার যার সংস্কৃতি এবং রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য করার আয়োজন করতে হবে। পরিবার অথবা ধর্মীয় ব্যক্তি লাশ গোসল বা দাফনের কাজ করতে পারবেন। লাশের শরীর ভালোভাবে ধোয়া, চুল-নখ কাটা, শেভ করা ইত্যাদি যত্ন নিয়ে করতে হবে। যারা এগুলো করবেন, তারা চাইলে গাউন বা এপ্রোন পরে নিতে পারেন। তা না থাকলে নিজের স্বাভাবিক কাপড়-চোপড়ও থাকতে পারে। পরে তারা নিজেরা ভালো করে সাবান দিয়ে গোসল করে নেবেন ও নিজেদের কাপড়গুলো গরম পানিতে ৩০ মিনিট সেদ্ধ করে ধুয়ে নেবেন।

৮. লাশের পরনের কাপড়-চোপড় পুড়িয়ে না ফেললেও চলে। ব্লিচ ব্যবহার বা কড়া সাবান দিয়ে গরম পানিতে আধাঘন্টা সেদ্ধ করে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নেয়া যেতে পারে।

৯. লাশ বিছানা থেকে কবর পর্যন্ত নামিয়ে রাখতে যত কম সম্ভব মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাকিরা ১-২ মিটার দূর থেকে দেখবে পুরো প্রক্রিয়া। আত্মীয় ও দর্শকরাও নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখবেন।

লাশ নিয়ে যা যা করা যাবে না:

১. লাশের শরীরে জীবাণুনাশক দেবার দরকার নাই। লাশকে কোনো ব্যাগের ভেতরও ঢোকাবার দরকার নাই। তবে যদি শরীর থেকে অন্য কোনো কারণে অনেক তরল (রক্ত, পায়খানা) ক্রমাগত গড়িয়ে পরতে থাকে, তবে ব্যাগ লাগতে পারে।

২. লাশকে চুমু খাওয়া চলবে না। লাশের চারপাশে অনেক লোকের ভিড় করা যাবে না।

৩. লাশের দর্শনার্থীদের মধ্যে কোভিড-১৯ সিম্পটমসহ কেউ থাকবেন না। যদি নিতান্ত থাকতেই চান, তবে অবশ্যই তাকে মাস্ক পরতে হবে যাতে অন্য সবাইকে অথবা ওই স্থানে ভাইরাস না ছড়ায়।

৪. লাশ বহন করার জন্য কোনো বিশেষ গাড়ি লাগবে না। অন্য সময়ে যে গাড়ি ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতেই চলবে।

৫. লাশের গোসল ও শেষকৃত্যের জন্য প্রস্তুত করতে বাচ্চা, অসুস্থ ও বয়স্কদের নিয়োজিত করা যাবে না। যদি কারো বয়স ৬০ বছরের বেশি হয় এবং ইমিউন সিস্টেমের দুর্বলতা থাকে, তিনি কোনোভাবেই লাশটি সরাসরি ছোঁবেন না।

৬. লাশ যেমন তেমন করে অযত্নে ফেলে রাখা বা কবর দেয়া যাবে না।

করোনা ভাইরাস একটি নতুন জীবাণু। গবেষকরা প্রতিনিয়তই এর গতিবিধি এবং প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তারা নিশ্চিত করেছেন এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ হুমকির বা আতংকের কিছু নয়।

সেরীন ফেরদৌস: প্রবাসী সাংবাদিক ও কানাডায় কর্মরত নার্স

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়