ডেস্ক

Published:
2021-06-24 15:56:31 BdST

শোক এপিটাফ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চির তরুণ তপন বড়ুয়ার জন্য কাঁদছে ক্যাম্পাস



ডেস্ক

_____________________

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কৃতি মুখ ডা. তরুণ তপন বড়ুয়া।
সদা সপ্রাণ, চির তরুণ নবীন তরুণ বড়ুয়া।
হঠাৎই চলে গেলেন তিনি। তাঁর প্রস্থানে শোকাভিভূত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

অশোক তরুণকে নিয়ে সিএমসির বিশিষ্ট লেখক, চিকিৎসকদের দুটি শোকলিপি প্রকাশ করা হল।

সুলেখক

ডা. আহমেদ শরীফ শুভ লিখেছেন
মৃত্যুহীন প্রাণ...... শিরোনামে স্মৃতি শোক গাঁথা।
তিনি লিখেছেন,
#
তরুণ তপন বড়ুয়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমার ৭ বছরের জুনিয়র। সংগত কারণেই ক্যাম্পাসে আমাদের পদচারণা হয়েছে ভিন্ন সময়ে। কিন্তু গত ৮ - ১০ বছরে কয়েকদফা সিএমসি অন ফেইসবুক আড্ডার কারণে ক্যাম্পাসে আমাদের দেখা হয়েছে, পরিচয় হয়েছে, যোগাযোগ হয়েছে, যোগাযোগ রেখেছি। আমাদের আড্ডাগুলোতে ও ছিল একজন অন্যতম সংগঠক। নিরলস পরিশ্রম করে যেত। কখনো লাইমলাইটে আসার অভিপ্রায় বা প্রচেষ্টা দেখিনি। যখন যে কাজে ডেকেছি তাৎক্ষণিক সাড়া পেয়েছে। জেনেছি, ছাত্রজীবনে সে 'সন্ধানী'র একজন দক্ষ সংগঠক ছিল। পেশাগত জীবনেও জড়িত ছিল নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে। কিছুটা চুপচাপ ধরণের হলেও আমাদের সিএমসি অন ফেইসবুক আড্ডাগুলোতে ছিল প্রাণবন্ত। নির্ভেজাল, অমায়িক ও পরোপকারি একজন অনুজপ্রতিম বন্ধু। শেষ দেখা গত বছর ১১ই জানুয়ারি, সিএমসি অন ফেইসবুক আড্ডায়।
কিছুদিন পর জানলাম ও নন-হজকিন লিম্ফোমায় আক্রান্ত। তারপর শুরু হল রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অবশেষে হার মেনে এই তরুণ বয়সেই (বর্তমানের প্রেক্ষিতে আমি ওর বয়সটাকে তরুণই বলবো) তরুণ গতকালচলে গেল আমাদের ছেড়ে । তারপর থেকেই বুকের মধ্যে একটা অসীম শূন্যতা ভর করে আছে।
ছাত্রজীবনে কিংবা কর্মজীবনে সে যেমন সমাজকে দিয়ে গেছে তার সাধ্যমতো, চলে যাওয়ার সময়ও সে এই সমাজকে দিয়ে গেছে তার শ্রেষ্ঠ উপহার। তরুণ মরোনোত্তর চক্ষুদান করেছে কোন এক অন্ধের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য আর মরদেহ দান করে গেছে তার প্রিয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগের জন্য, যেন আগামী প্রজন্মের চিকিৎসকরা তার দেহ ব্যবচ্ছেদ করে এনাটমি শিখতে পারে। মানবসেবার কী অনন্য পরাকাষ্ঠা! তরুণ আসলেই এনেছিল 'সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ'...। তার এই নিঃস্বার্থ দানের জন্য এই শোকের মধ্যেও গর্বে আমাদের উচ্চতা বেড়ে যায়, বুক ফুলে উঠে। এই প্রকৃয়ায় পাশে থাকার জন্য তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে আসে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ পরিবারে আমরা এক গভীর ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। জাগতিক প্রস্থান তরুণকে আমাদের সে বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। আমাদের এই অনুজপ্রতিম সজ্জন বন্ধুটির জন্য এক পৃথিবীর ভালোবাসা।
তরুণ, যেখানেই থাকো, ভালো থেকো, আনন্দে থেকো, ভালোবাসায় থেকো। ##


সিএমসি ৩৮ ডা. নাসির জুয়েল শোক এপিটাফ এ লিখেছেন,

ওহ তরুণ দা!

---------------------

১.

তখন সবে অশ্বত্থ বট নারকেলের গন্ধমাখা মফস্বল শহর থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমার তখন দিন-কাটেনা-মন-মানেনা অবস্থা। এরই মধ্যে,আমার সেই আধো-বিষণ্ণতার দিনে, সাগরিকা সিনেমার কেদার দা'র সাথে পরিচয় হলো।কেদার দা এই অর্থে যে, তিনি ক্যাম্পাস ছেড়েছেন তবু ছাড়েননি,এমন।কেদার দা এই অর্থে যে, সর্ব মানবের সব ব্যর্থ জীবনের গল্প তিনি শোনার জন্য সদা উৎকর্ণ। সবাই তার কাছে যায় শুধু নির্ভার হতে। সদা-শিব, সদা-প্রসন্ন।

ভালোবেসে ফেললাম তরুণ দা'কে।

কিছুদিনের মধ্যেই ভালোবাসাটা পারস্পরিক হয়ে উঠল।গহন।

আমাদের তখন আধো মন পাঠে,আধো-মন বিশ্ব-উদ্ধারে।

রাতদিন আতি পাতির আড্ডায়,ফুটপাতে,শিল্পকলায়,মুসলিম হলে, ঝাল বিতানে,প্রবর্তকের পাহাড়ে,ফুলকিতে,শহিদ মিনারে,হাজারি লেনের মাছের কানকা,কাঠালের ভুতি চাপা পুতিগন্ধময় গলিতে, মিতালি হোটেলে,আঁলিয়স ফ্রাসেস এ একরকম আনন্দবিহারের কাল।

তরুণ দা সংসারি মানুষ।বয়সের বিস্তর ফারাক আমাদের। তবু সময়ের অভাব নেই তার সংসারে। কারণ, মনে হতো,তার ভালোবাসার সমস্ত মানুষদের নিয়েই তার সংসার।

সবার সাথেই তার বাৎসল্যের সম্পর্ক। মনে পড়ে,একবার সন্ধানী'র কী একটা নাটকে,নাম মনে নেই, আমাকে প্রধান চরিত্রটা করতে বললেন।

-অভিনয় তো পারি না,তরুণ দা।

-অভিনয় করা লাগবেনা। আবৃত্তি করার সময় যেমন ডুবে যাস,অমন ডুবে গেলেই হবে।

বললাম, অভিনয় টভিনয় দু'একবার করবার চেষ্টা করেছি।সব হয়,শুধু হাত দুটোকে নিয়ে যে কী করব,বুঝতে পারিনা।বাড়তি মনে হয়।

-তুই হাত দুটো আমার কাছে জমা রাখবি। কেউ বুঝতেই পারবে না,কারণ নাটক হবে রেডিওতে।

নাটক করতে যেয়ে পেলাম মহান লাভলী আপাকে।আমার বিপরীতে। আনন্দ হলো।

এবং আনন্দ সংক্রামক। পরের বছরও নাটক হলো।

বিপরীতে আমার বন্ধু কংকা। এবং,এবছরও তরুণদা'র কাছে আমার অপ্রস্তুত হাতদুটো জমা রেখে আবার অভিনয় করলাম।

প্রতি বছর একই নাটক হয়।তরুণ দা বললেন,নতুন নাটক লেখ।লিখলাম। নতুন গান লেখা হলো(এই আলোতে আমরা জেগেছি/অন্ধকারে পারাবারে প্রদীপ জ্বেলেছি. ..)।

আমার বন্ধু ইফতেখার দারুণ সুর করল।

আশ্চর্য এই,লক্ষ্য করলাম,প্রতিবারই আমার অপ্রস্তুত লাজুক হাতদুটোকে তরুণ দা'র কাছে জমা রাখতে হয়। অভ্যাস হয়ে গেল।ভালোবাসার অভ্যাস। আর ফিরিয়ে নেয়া হলোনা। রয়ে গেল তার হাতের গভীরে।

আজ তিনি চলে গেলেন।আজ থেকে তরুণ দা নেই হয়ে গেলেন,চীরকালের জন্য।

২.

তরুণ দা, জানি, যে ঘরে আপনি ঘুমিয়ে আছেন,চীরকালের জন্য তার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের শোক, সন্তাপ কিছুই সেখানে পৌঁছুবেনা আর। জানি, আপনার কান অব্দি আমাদের ব্যর্থ জীবনের কথা আর পৌঁছুবেনা।

কিন্ত শেষ কথা তো হলোনা আমাদের।

আমাদেরকে বলতেন,'এই পৃথিবীটা আমাদের।এর সমস্ত ধুলিকণায় সমস্ত মানুষের সমান অধিকার। '

জিজ্ঞেস করা হলোনা, এই বিলক্ষণ বিপ্রতীপের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা এখনও এই স্বপ্ন দেখব কিনা।

চলে গেলেন না বলে!!

৩.

আপনার কোনও ছবি নেই আমার কাছে।এই ছবিটা দিলাম।

কিন্ত এ- তো জানি,এ- তো জানি আমরা সবাই,আপনি ছবির চেয়েও কান্তিময়। আর এ-ও জানি আর কোনোদিন দেখা হবে না আমাদের।

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়