Ameen Qudir

Published:
2017-02-05 21:36:42 BdST

কজন লোক প্রফেসর সমমর্যাদার সচিবের কলার ধরার সাহস রাখে?





ডা. মুশতারী মমতাজ মিমি
_____________________________


অবশ্যই পড়ুন এবংএকটু ভাবুন,বিবেচনা আপনার।
আমাদের ডাক্তারদের প্রধান দূর্বলতা হলো আমরা লাগাতার কর্মবিরতিতে যেতে পারিনা। কোন অন্যায়ের প্রতিবাদে যদি কর্মবিরতি নিয়েও থাকি তবে আধাবেলা অথবা একবেলার জন্য।এবং এ সময় কোন মূমূর্ষু রোগী রোগী আসলে শেষমেষ তাকে বাঁচাতে মানবতার খাতিরে ডাক্তারদের হাত এগিয়ে আসবেই। সেজন্যই কেউ আমাদের আন্দোলন তোয়াজ করে না। জানে চোখের সামনে কেউ চিকিৎসা না পেয়ে মরে যাবে এটা কোন ডাক্তারই বসে বসে দেখবে না।


একই বিসিএস করা অন্য ক্যাডারদের সাথে নিরাপত্তারক্ষী থাকে,তাদের রুমে ঢোকার জন্য পারমিশন দরকার হয় কিন্তু ডাক্তারদের রুমে ঢুকতে পারমিশন লাগে না।উপরন্তু রোগী রোগীর সাথে তোয়াজ করে কথা না বললে মার খেতে হয়।
নারী দের শ্রদ্ধা করুন বলে বলে সবাই মুখে ফেনা তুলবে কিন্তু একজন নারী ডাক্তারকে মারার সময় একবার ভেবেও দেখবে না।

কিছুদিন আগে শুনেছিলাম এক কিশোরীর পলিসিষ্টিক ওভারী ধরা পড়েছিলো।এটা মেয়েদের ডিম্বাশয়ের একটা রোগ।এই রোগের চিকিৎসায় মেটফরমিন দেয়া হয়। এই একই ওষুধ আবার ডায়াবেটিসের রোগীকেও দেয়া হয়।অর্থাৎ একই ওষুধ দুই রোগের চিকিৎসাতেই কার্যকর। ডাক্তার আল্ট্রাসনো রিপোর্ট দেখে রোগীকে মেটফরমিন প্রেসক্রাইব করেন। রোগীর বাবা ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে গেলে দোকানদার তাকে বলে তার মেয়ের ডায়াবেটিস নেই,তাকে ভুল ওষুধ দেয়া হয়েছে। একথা শোনার পর কিছু না যাচাই করেই ওই ডাক্তারের চেম্বারে ভাংচুর করা হয়।
একটু এদিক ওদিক হলেই রোগী ফার্মেসী ওয়ালা,আত্নীয়-স্বজন,সাংবাদিকদের কথায় ডাক্তারদের গুষ্টি উদ্ধার করে দেবে।একবারও ভাববে না যাদের কথায় নেচে নেচে ভাংচুর করবে তাদের মেডিকেল জ্ঞান কতদূর!


ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে পয়জনিংয়ের রোগী মরা মরা অবস্থায় হাসপাতালে আসবে। ডাক্তারী চিকিৎসা হলো তার অবস্থা উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত Atropin ইন্জেকশন দিতেই থাকতে হবে।কখনো কখনো শ'য়ের উপরেও দেয়া লাগতে পারে।রোগী সুস্থ হলে সমস্যা নাই।কিন্তু দেরীতে খারাপ অবস্থায় মারা গেলে দোষ হবে ডাক্তার আর ইন্জেকশানের। নাম হবে ভুল চিকৎসায় মারা গেলো রোগী। খবরের কাগজে বড়বড় শিরোনামে ডাক্তারের কসাইপনার কথা বলা হবে।

কিডনি নষ্ট তাই ফেলে দেয়ার প্রয়োজন হলে রোগী বলবে ডাক্তার কিডনি চোর।

বছরের পর বছর গাঁজা,হেরোইন খেয়ে ফুসফুস শেষ করে নিয়ে আসবে। তাড়াতাড়ি অসুখের উন্নতি না হলে ডাক্তারের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেবে। যেনো ডাক্তার তাকে বলেছিলো নেশা কর!

একজন ডাক্তার রোগ নিয়ে বছরের পর বছর রোগ নিয়ে পড়াশোনা করে। আশেপাশের দরদীদের থেকে যে রোগসংক্রান্ত জ্ঞান ডাক্তারের সহস্রগুণ বেশী হবে এটা কেউ মানবে না।আগে মারধর তারপর অন্য কথা।আমাদের হাতে কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই।এটাই আমাদের অক্ষমতা।



একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা,জজ,ম্যাজিট্রেট কিংবা সচিব কোন রাস্তা দিয়ে গেলে ঘন্টাব্যাপী রাস্তা ক্লিয়ার করা হবে।কিন্তু মেডিকেলের একজন প্রফেসর ইমার্জেন্সি পেশেন্ট কল পেয়ে ছুটলেও তাকে রাস্তার জ্যামে আটকে থাকতে হবে। দেরীর জন্য রোগী মারা গেলে রোগীর লোক প্রফেসরের কলার ধরবে। কিন্তু কজন লোক প্রফেসর পদের সমমর্যাদার একজন সচিবের কলার ধরার সাহস রাখে?


আমাদের দূর্ভাগ্য এটাই যে একজন ধনী কোটিপতির গলাও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে নরম থাকে কিন্তু একজন দিনমজুরের কন্ঠ ডাক্তাদের উপর চড়া হতে পারে যে কোন সময়।সমাজ তাতে সায় দেয়।চেম্বারের দরজায় দুজন বন্দুকধারী পুদিশ দাঁড়ানো থাকতো তবে আমাদের গায়ে হাত তুলতেও রোগী ভাবতো!কিন্তু আমরা কিনা মানবতার সেবক।আমরা সেবা দেব,মারও খাবো।আমাদের কেন কোন নিরাপত্তা থাকবে?

একজন গায়ক আধাঘন্টার কনসার্টের জন্য লাখ লাখ টাকা নেবে,উকিল কেস লড়াইয়ের জন্য ইচ্ছেমতো নেবে,ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইন প্লান করতে লাখ লাখ টাকা ডিমান্ড করবে। এমনকি বাজারের একজন টিভি কিংবা মোবাইল মেকানিক হাজার টাকা পারিশ্রমিক নেবে সমস্যা নাই কিন্তু দুই যুগ হাসপাতাল আর বইয়ে মুঁখ গোঁজা পৌড় ডাক্তার 500 টাকা ভিজিট নেবে এটাই সবার চোখে লাগবে। মানুষের কাছে শরীরের দামই বোধহয় সবচেয়ে কম।একটা গাড়ি ঠিক করতে মজুরী 5000 হোক কোন কথা হবে না তাতে কিন্তু শরীর ঠিক করতে ভিজিট দেবে তাতেই যতো কথা।


সবকথার এক কথা-আমরা মানবসেবক। বলি সৃষ্টিকর্তা কি কেবল ডাক্তারকেই মানবসেবা করতে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন?অন্যদের দ্বায়িত্ব নেই? আমাদের বাড়িগাড়ি থাকা যাবেনা।সরকারী বেতনটুকু নিয়ে খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে চলতে হবে আমাদের।তাইলেই সবাই খুশি ।কিন্তু অন্যসবাই দুনিয়া কিনে নিলেও কারো খারাপ লাগবে না।

তারপরেও কিন্তু ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প,ফ্রি হেলথ ক্যাম্প,বিনামূল্যে অপারেশন এসব ফ্রি সার্ভিসিং আমরাদেই দিয়ে থাকি।যত বড় খারাপ ডাক্তারই হোক পুরো পেশাজীবনে হাজার হাজার ফ্রি চিকিৎসা সে অবশ্যই দেয়।আপনার কাশি হোক ,জ্বর হোক,মাথা ব্যথা হোক কিংবা সর্দি-চুলকানি হোক আপনি কিন্তু আপনার পরিচিত ডাক্তারকেই আগে ফোন দিয়ে ওষুধ নেন।

তবুও কথাচ্ছলে সুযোগ পেলে সেই বন্ধুটিকেই আপনি কসাই বলবেন।একজন অন্য পেশার পরিচিত মানুষকে সারাজীবন আপনার কাজে নাও লাগতে পারে কিন্তু একজন পরিচিত ডাক্তারকে কখনো না কখনো আপনার প্রয়োজন পড়বেই। সেটা একবার প্রেশার মাপার জন্যে হলেও।

আপনার হয়তো মারাত্নক কোন ছোঁয়াচে কোন রোগ হয়েছে আপার সব আপনজন আপনাকে ফেলে গেলেও একজন ডাক্তার ঠিকই আপনার চিকিৎসার ভার নেবে। আপনার কোন কাছের মানুষ মৃত্যুর সাথে লড়াই করলে তার সাথে সহযোদ্ধা হিসেব শেষ লড়াইটা ডাক্তাররাই করে। একজন মানুষ যখন ডাক্তারের চিকিৎসায় ভালো হয় তখন সে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ডাক্তারের উছিলায় ভালো হয় এবং যখন কেউ মারা যায় সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় ভাক্তারের চেষ্টাকে ব্যর্থ করেই মারা যায়। জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে।ডাক্তাররা দু ক্ষেত্রেই উপলক্ষ মাত্র। কারো মৃত্যু যদি উপরওয়ালা লিখে রাখেন ডাক্তার কেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষও সেটা আটকাতে পারবে না।এই চরম সত্যটা সবার মাথায় থাকা উচিত। একজন ডাক্তার যদি কখনো কোন ভুল চিকিৎসাও দিয়ে ফেলেন সেটা তার অনিচ্ছাকৃত দেয়া।আপনার কিংবা আপনার রোগীর সাথে তার কোন শত্রুতা নেই।ডাক্তারও মানুষ।খানিকটা ভুল যে কারোই হতে পারে।


,ঈমাম শেখের চাকরি,সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর মতো বড় বড় ঘটনার আড়ালে শামারুখ মেহজাবিনের মৃত্যু,ডাক্তারদের চেম্বার ভাংচুর, প্রশ্নপত্রে ডাক্তারদেরকে ছোট করা কিংবা গতকালের ডিএমমসির সিনিয়র আপুকে মারধর,আজকের শিশু হাসপাতালের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে হয়রানির মতো ঘটনা গুলো ধামাচাপা হয়ে যাবে। আমরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপনাদের রোগ ভালো করার কাজে লেগে থাকবো।আমাদের কথা কেউ বিবেচনা করবে না আমরা যতই চিৎকার করি।

আমারা ক্ষমতা চাই না।সেবার বিনিময়ে কেউ যেন আমাদের অপমান না করে,সত্যতা যাচাই না করে অযথা হয়রানি না করে আর যেনো আমাদের অনিরাপত্তায় ভুগতে না হয়।এটুকুই আমাদের চাওয়া।যথাযথ
কতৃপক্ষ এটুকু নিশ্চিত করলেই হবে।

আমরা ডাক্তাররা আলাদা কোন প্রজাতি নই।রক্ত-মাংসের সাধারণ মানুষ।আপনার আশেপাশের অন্যান্য মানুষের মতোই আমাদের যোগ্য সম্মানটুকু আমাদের দিন।আমরা আপনার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত পাশে আছি।

____________________________

লেখক ডা. মুশতারী মমতাজ মিমি

Studied Bachelor of Medicine and Bachelor of Surgery(MBBS) at Rangpur Medical College

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়