ডা কামরুন লুনা

Published:
2021-04-09 22:23:45 BdST

ডা: এম এ হাছান চৌধুরী: একজন অন্তর্মুখী যোদ্ধার গল্প


 

ডা: এম এ হাছান চৌধুরী ও লেখক 

 

ডা. কামরুন লুনা

---------------------------------

ডা: এম এ হাছান চৌধুরীকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। চট্টগ্রামে সে নিজ নামেই পরিচিত ।
চার বছর আগে তার যখন Bangladesh Tropical Medicine Institute (BITID) তে পোস্টিং হয়, আমি খুব মন খারাপ করেছিলাম (যদিও আমার আব্বা বলেছিলেন, জয়েন করে ফেলতে বলো, ও র ভালো লাগবে) । কারন আমি ওঁকে খুব ভালো করে চিনি।
সে একজন আপাদমস্তক শিক্ষক । তার রোগী দেখা , চেম্বার, গবেষনার কাজ , হাসপাতাল সব একদিকে ।
তার ছাত্র পড়ানো, বিশেষ করে পোস্ট গ্রেজুয়েট শিক্ষা কার্যক্রম অন্যদিকে ।
এই ছাত্ররা তার হ্রদয়ের সাথে কানেক্টেড । তার চিন্তা চেতনায় তাঁরাই বিরাজ করে সারাক্ষন । ওর মেডিসিনের ছাত্রদের অনেকের সাথেই আমার ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ আছে, আমি জানি ওরা তাঁকে কি ভালোবাসে ।
আমার মনেহলো, BITID তে সে fish out of water feelings নিয়েই বাস করবে। কারন সেটা মেডিকেল কলেজ নয়। কোন ছাত্রছাত্রী সেখানে নেই।

আমার ধারনা ভুল প্রমানিত হলো। সে ছাত্রদের ভুলে না গেলেও মেডিকেল কলেজ কে ভুলে গেলো ।
সে যখন BITID তে জয়েন করে, তখন সেখানে শুধু আউটডোর চালু ছিলো। কেউ এই হাসপাতালের নাম টি ও জানত না। ট্রপিকাল মেডিসিনের একটা হাসপাতাল , একটা টীকাদান কেন্দ্র পর্যন্ত ছিলোনা ।
সে প্রথমেই একটি EPI কর্ণার স্থাপন করলো ,
আশাপাশে পডে থাকা জিনিষ পত্র দিয়ে খুব গুছানো এনিমেল হাউস বানালো ।
পুরা হাসপাতালের বাউন্ডারী করলো ।
লোকাল একজন দাতার সহায়তায় রোগীদের পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বিশাল পানির ROS মেশিন বসালো।
এক রকম খডকুটো কুড়িয়েই স্যাম্পল কালেকশন আমব্রেলা বানালো ।
বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ডাক্তারদের ডেকে হোক , খবর দিয়ে হোক, গবেষনার জন্য, তাদের থিসিস গুলো এখানে করার জন্য সে তাক ছাত্রদের ডেকে নিতো সব সময় ।
সব শেষে , সেই আউটডোর হাসপাতাল কে ১০০ বেডের একটি ইনডোর করে দিলো , (যদিও অনেকটুকু সুবিধা থাকা স্বত্তেও এখানে ভর্তি রোগী র কোন বেড ছিলো না) ।
পুরা হাসপাতাল রেডি হলে, সেই ত্রিপুরা পাড়ার মিসেলস আউটব্রেকের ঘটনা তারা খুব ভালো ভাবেই সামাল দিলো ।

এর পর এলো এই কোভিড পিরিয়ড । ওরা প্রথম থেকেই তৈরী ছিলো । চট্টগ্রাম এটাই প্রথম একমাত্র হাসপাতাল , যেটা অনেকদিন পর্যন্ত করোনা টেস্ট এবং করোনা চিকিৎসা পাশাপাশি চলছিলো। এটার শক্ত অবস্থান ছিলো বলেই , চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসায় তেমন হতাশা দেখা যায়নি।

কি দিন গেছে তার আমি জানি , রাত নেই, দিন নেই, মিটিং , ফোন , ওয়েবিনার , পুলিশ , ডিসি , ডিজিএফআই , পিপিই কালেকশন , স্যানিটইজার , এম্বুলেন্স , অক্সিজেন , এক্সরে মেশিন । স্যাম্পল কালেকশন, টেস্ট কিট যোগাড় ।
ডাক্তারদের, নার্স , স্টাফদের খাবার , কোয়ারেনটাইন এর যোগাড় , লক ডাউনে সবাই ঘরে বসা , তার দিন হয়ে গিয়েছিলো ২০ ঘন্টার । কাজ আর কাজ । সন্ধ্যা হতে শুরু হতো ফোনে পরিচিত দের চিকিৎসা দেয়া , টেস্ট রিপোর্ট সব জায়গায় পাঠানো ।
ও র ডাক্তার , নার্স , স্টাফ সর্বোপরি পুরো টিম ওঁকে ভালোবেসে জান দিয়ে খেটেছে ।
এই হাসপাতাল রেডি ছিলো বলেই , কোভিড পিরিয়ডে এত কাজ করতে পেরেছে । সরকারের সফলতা হিসেবে এটা দাঁড়াতে পেরেছে ।
কাজ করতে গিয়ে আমরা দুজন করোনাক্রান্ত ও হয়েছি । আবার সবার দোয়ায় সুস্থ হয়েছি ।

সে আজীবন অন্তর্মুখি। পিছন থেকে চুপিচুপি কাজ করেই অভ্যস্ত ।সবাই যখন টেলিভীষনে টক শো করে করোনা যোদ্ধা হয়েছিলো, সে তার স্বল্প আয়োজনে , স্বল্প অস্ত্রে মাঠে নেমেই যুদ্ধ করেছে এবং নি:শব্দে, যা শুধু আমি দেখেছি ।কারণ ওর ছিটা তো আমার উপরও পড়েছে ।
কেউ কেউ তো আমার সাথে পরিচিত হয়ে, আমাকে ব্যবহার করে ঢুকেছে সেখানে, ওদের ডাটা ব্যবহার করে গবেষনা পত্র ছাপিয়েছে, ওর নাম দেয়া দুরে থাক, ওর পারমিশনও নেয়নি। একটা হাসপাতাল এর ডিরেক্টর এর পারমিশন ছাডা তার ডাটা কেমনে নেয়। তারা কেমন জ্ঞানী। ও কিছুই বলেনি । এমনই অন্তর্মুখি সে ।

ওর ডাক্তার রা আমাকে ফোন দিয়ে বলতো , আপা স্যার অসুস্থ , হুটহুট করে পিপিই ছাডা করোনা ওয়ার্ডে ঢুকে যান , নিষেধ করবেন , আপা স্যারের সেক্রেটারী কিন্তু কোভিড পজিটিভ, সাবধানে থাকতে বলবেন ।
আপা, স্যার আজকে মাস্ক খুলে বাইরে চলে এসেছেন । এতো ভালোবাসার প্রতিদান আমরা কেমনে দিবো ।

তারপরও আমার ইচ্ছা ছিলো , ও চলে আসুক মেডিকেল কলেজে । বেশীদিন চাকরী নেই , শেষ বছর টা তার প্রিয় ছাত্রদের সাথেই কাটাক । শিক্ষক হিসেবেই রিটায়ার করুক । সবাই দোয়া করবেন এই ইন্ট্রোভার্ট যোদ্ধার জন্য , ও যেন সুস্থ থাকে । আরো মানুষের সেবা করতে পারে।

ও একজন ছাত্রের (যিনি নিজেও মেডিসিন স্পেশালিস্ট) একটা লেখা তার পারমিশন ছাড়াই এখানে এড করে দিলাম ।

(কোভিড মহামারীর ভয়াবহ দশা চলছে, দ্বিতীয় স্তরের লকডাউনও চলছে। এছাড়াও দেশের নানা ঘটনায় মনটা বিষণ্ণ।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আজ আমাদের কর্মস্থল, আধুনিক "বিআইটিআইডি"র রূপকার পরিচালক, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক এম এ হাসান চৌধুরী স্যারের আকস্মিক বদলীর খবরে মনটা খুবই ভারী হয়ে গেল। আজ সকালে অফিসে এসে মাত্রই এই খবরটা পেলাম।

সরকারী চাকুরীতে বদলী, অবসর ইত্যাদি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা হলেও আজকে স্যারের বদলী বিআইটিআইডি পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা একপ্রকার অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম!

এই বদলী স্যারের ইচ্ছানুযায়ীই হয়েছে, স্যার আবারো গত কয়েক বছরের প্রশাসনিক পদ থেকে উনার প্রিয় পেশা ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের শিক্ষকতায় ফিরে গেলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

স্যারের আজকের দেওয়া বক্তৃতা অনুসারে বলতে হয়, "জীবনে ইমোশন ও সাইন্স পাশাপাশি চলে। কখনও যেকোনো একটা আরেকটাকে অতিক্রম করে যায়। কোভিডের এই পরিস্থিতিতে সাইন্স বলে একটু দূরে, জটলামুক্ত থাকতে। কিন্ত, আজকে আমার বদলী উপলক্ষ্যে সবার জমায়েতে ইমোশন জিতে গেছে, আমি অভিভূত... "

পরিশেষে, স্যারের চাকুরী জীবনের বাকি সময়টুকু ভালো কাটুক, এটাই প্রত্যাশা।)

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়