ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-05-19 20:04:12 BdST

অপরিকল্পিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং খোঁড়া পায়ে উসাইন বোল্টের গতি প্রত্যাশা



ডা.সাবিহা চৌধুরী স্বস্তি

_____________________


শেয়াল আর কচ্ছপের দৌড়ে সবসময়ই কচ্ছপকেই জিততে দেখেছি আমরা।কারণ সে ধীর হলেও পরিশ্রমী আর দৃঢ়চেতা।
এই করোনা যুদ্ধে ডাক্তারদের এক্সপোজারের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল কচ্ছপের গতি।কিন্তু নীতি নির্ধারকরা হতে চাইলেন শেয়াল।উনারা মনে করলেন সব ডাক্তারদের মাঠে নামিয়ে দিলে আমরা করোনাকে মাঠ থেকে দ্রুত হটিয়ে দিতে পারবো।হলো এর উল্টো! খুব সম্ভবত আমরা চিকিৎসক সংকটে পড়তে যাচ্ছি শীঘ্রই এবং এটাই হওয়ার কথা যখন আপনি উচ্চমাত্রায় সংক্রমক একটি প্যান্ডেমিক রোগের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ছাড়া অথবা মনগড়া পরিকল্পনা নিয়ে এগোবেন।
কথায় কথায় উন্নত দেশগুলোর সাথে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তুলনা দেয়া মানায় না।এই মুহূর্তে করোনা মোকাবেলায় প্রত্যেকটা দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা,অর্থনৈতিক অবস্থা, পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা মাথায় রেখে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিকল্পনাও হবে ভিন্ন।
৪৫ হাজার আই সি ইউ থাকা ৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার ইতালি কিভাবে মহামারী মোকাবেলা করছে তার সাথে ১ হাজার আই সি ইউ থাকা প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার (ইতালির তিনগুণ) বাংলাদেশের তুলনা দেয়াটা আহাম্মকি বৈ কি কিছুনা।
আমাদের চিকিৎসক সংখ্যা অপ্রতুল,আই সি ইউ সংখ্যা অনেক কম,ভেন্টিলেটর তার চেয়েও কম।এই সীমিত রিসোর্স নিয়ে আমরা এ যুদ্ধে জয়ী হতে পারবো কিনা সেই প্রশ্নের চেয়ে বড় প্রশ্ন কতদিন টিকে থাকবো আমরা যুদ্ধে?আমরা যদি অপরিকল্পিতভাবে আমাদের এই সামান্য রিসোর্স ব্যবহার করে ফেলি হয়তো সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন সব চিকিৎসক হবেন রোগী, আর হাসপাতালে ঝুলবে তালা,বাড়িগুলো হবে লাশের স্তুপ ।খুব নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে কথাগুলো।ইতালি,স্পেন,যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মত উন্নত স্বাস্থ্যসেবার দেশ যখন হিমশিম খায় মহামারী মোকাবেলায় তখন আমাদের জন্য নিকট ভবিষ্যতে এই চিত্র খুব বেশি অবাস্তব নয়।
এখনো আমাদের বেশিরভাগ হাসপাতালে যথাযথ রোস্টারে (সাতদিন ডিউটি করে পরবর্তী ১৪ দিন কোয়ারিন্টিনে থাকা)ডিউটি শুরু হয়নি, সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসা চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরাও অনেক জায়গায় কোয়ারিন্টিনের অনুমতি পাচ্ছেন না।মারাত্মক আত্মঘাতী পলিসি এটি।এর মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে জনগণকে ধোঁকা দেয়া যাচ্ছে যে চিকিৎসক হাসপাতালে আছেন,কিন্তু গাইডলাইন অনুযায়ী যে চিকিৎসককে কোয়ারিন্টিনে থাকতে হবে তাকে অন ডিউটি রেখে আর যাই হোক মহামারী মোকাবেলা করা যায় না।
আবার গাইডলাইন মানার ক্ষেত্রে আমরা ভীষণ চুজি,যেটা পছন্দ হয় মানছি যেটা হচ্ছে না তাতে ধীর গতিতে আগাচ্ছি। ডব্লিউএইচও এর নির্দেশনা হচ্ছে টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট। যখন বিপুলসংখ্যক টেস্ট হবে কমিউনিটিতে লক্ষণ ছাড়া রোগের বাহকরা টেস্টের মাধ্যমে আলাদা হয়ে যাবেন।সুতরাং হাসপাতালের করোনা ইউনিট ছাড়া অন্য ইউনিটে N-95 বা সমতুল্য পর্যায়ের মাস্কের প্রয়োজন পরবে না যেটা ডব্লিউএইচও গাইডলাইনে বলা আছে।
আমাদের নীতি নির্ধারকরা প্রথম শর্তটি না মেনে মানছেন দ্বিতীয়টি।ফলাফল কমিউনিটিতে লক্ষণ ছাড়া বাহকের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, তারা হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে সেবা নিতে যাচ্ছেন আর N-95 মাস্ক,ফেস শিল্ড,গগলস অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া রোগী দেখে আক্রান্ত হচ্ছেন বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী।
আমরা যদি কোভিন ১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং অন্য সাধারণ সেবা দেয়া হাসপাতালের চিকিৎসক দের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দেখি তাহলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। কোভিড ১৯ বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সুরক্ষা ব্যবস্থা সাধারণ হাসপাতালগুলোর চেয়ে সংগত কারণেই ভালো,ফলাফল এইসব হাসপাতালে শতভাগ কোভিড ১৯ রোগীর সংস্পর্শে থেকেও চিকিৎসকরা কম আক্রান্ত হচ্ছেন।এখন পর্যন্ত ৫জন চিকিৎসক সরাসরি কোভিড ১৯ চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্ত মোট চিকিৎসক আক্রান্ত ৩২৪+ (সূত্র : বিডিএফ)। তাহলে বাকি সবাই কিভাবে আক্রান্ত হলেন? না, কমিউনিটি থেকে না,বরং তারাও করোনা রোগীর রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়েই আক্রান্ত।ভাইরাসের বাহকরা উপসর্গ গোপন করে বা কোনো উপসর্গ ছাড়াই হাসপাতালে অন্য চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। অপ্রতুল টেস্টের কারণে আমরা এই বাহকদের আলদা করতে পারিনি বরং পলিথিনের গ্লাভস আর গেঞ্জি কাপড়ের মাস্ক সরবরাহ করে একরকম নগ্নভাবে চিকিৎসকদের পাঠিয়ে দিয়েছি ভয়ংকর মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে।
শুধু তাই নয়,ঢাল তোলোয়ারবিহীন এই সম্মুখ যোদ্ধাদের সামান্য উৎসাহ আমরা দিতে পারছি না।বরং অসহায়ের মত যখন তারা জানাচ্ছেন আমাদের সুরক্ষা পোশাকের সংকট,যা আছে তা ত্রুটিপূর্ণ,তখন তাদের দেয়া হচ্ছে কারণদর্শাও নোটিশ।অথচ যাদের দুর্নীতির কারণে কোটি টাকার পিপিই কেনার পরও ডাক্তাররা পাচ্ছেন পলিথিন আর গেঞ্জির মাস্ক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাও না, সেইসব দুর্নীতিবাজ অসাধুদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যায়নি।
কিছুদিন আগে কুয়েত মৈত্রীর ৬ জন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো,অথচ তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিয়মিত ডিউটি শেষে কতৃপক্ষের অনুমতিতেই কোয়ারিন্টিনে ছিলেন। টানা কাজ করে গাইডলাইন মেনে কোয়ারিন্টিনে যাওয়া ডাক্তারকে যখন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বহিষ্কারের নোটিশ ধরিয়ে দেয়া হয় তখন সকল চিকিৎসক শঙ্কিত,অপমানিত এবং অনিরাপদবোধ করেন। মহামারীতে সামনে থেকে লড়ে যাওয়া যোদ্ধারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
সুরক্ষার অভাবে শারীরিকভাবে দুর্বল,শোকজ আর বহিষ্কারের ভীড়ে মানসিকভাবে বিধস্ত চিকিৎসকদের দিয়ে সর্বোচ্চ সেবাটা চাইলেও আদায় করা সম্ভব না।
পিপিই,শোকজ,বরখাস্তের ভীড়ে নতুন প্রহসন প্রণোদনা। সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে না,সম্মান দেয়া হচ্ছে না,উৎসাহ দেয়া হচ্ছে না,শর্তযুক্ত প্রণোদনার কথা বলে সৃষ্টি করা হচ্ছে বিভক্তি।
এই মুহূর্তে সরকারি হাসপাতাল,বেসরকারি হাসপাতালের পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু সরকারি আর বেসরকারি চিকিৎসকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা উচিত হবে না।কারণ রোগীর সেবা দিতে গিয়েই উভয়পক্ষ আক্রান্ত হচ্ছেন আর এরজন্য প্রধানদায়ী টেস্ট সল্পতা। টেস্টের অভাবে রোগী চিহ্নিত হওয়ার আগে সরকারি বেসরকারি সব জায়গায়ই যাচ্ছেন। বরং সরকারের সুষ্ট পরিকল্পনার অভাবে অনেকে সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা না পেয়ে বেসরকারিতে ভর্তি হয়ে সেবা নিচ্ছেন।মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচানোর চেষ্টার বিনিময়ে চিকিৎসক হয়েছেন আক্রান্ত। আর আমরা শুরুতেই তাদের বিভক্ত করছি,বেসরকারি বলে শর্ত জুড়ে দিচ্ছি। মাত্র ৮৬ হাজার রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের এই দেশে এই বিভক্তি বিলাসিতার শামিল। রাষ্ট্র বেসরকারি চিকিৎসকদের প্রণোদনা বা কাজের অনুপ্রেরণা দেয়া থেকে বিরত রাখতে চাচ্ছেন এখন এই চিকিৎসকরা যদি ব্যক্তিগত সুরক্ষা আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে চিকিৎসাপ্রদান থেকে বিরত থাকেন তাহলে রাষ্ট্র কি পারবে মাত্র ২০-২৫ হাজার সরকারি চিকিৎসক দিয়ে মহামারী সামাল দিতে??
প্রণদোনায় বিভক্তির আগে এই বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন ছিল,এটি চিকিৎসকদের উদ্দীপ্ত করবে না বিভক্ত।

ডা.সাবিহা চৌধুরী স্বস্তি
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

AD..

 

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়