Ameen Qudir

Published:
2019-10-21 20:28:51 BdST

৫০ বছরে কোটি রোগীর জীবন রক্ষা ও রোগমুক্তি দিয়েছে যে মেডিকেল কলেজ


 

শর্মিষ্ঠা দাস
চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
__________________________

নানাবিধ হট্টগোলের ভিতরে আমরা নিঃশব্দে পেরিয়ে যেতে চলেছি বর্ধমান জেলার এক ঐতিহাসিক সূচনার সুবর্ণ জয়ন্তী! ‘১৯৬৯ সাল আর বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ’—এই শিরোনামকে বড় হরফে মনে রেখে, আমরা বরং আরও ৬২ বছর পিছনে ফিরে যাই। ব্রিটিশ শাসন। বর্ধমান এস্টেটের মহারাজাধিরাজ তখন বিজয়চাঁদ মহতাব। ব্রিটিশ আনুগত্য বজায় রেখেও, মানুষের কল্যাণে তাঁর কাজ, প্রজাদের ভালবেসে তাঁর কাজের সাক্ষ্য আজও রয়ে গিয়েছে শহর জুড়ে, শহরবাসীর হৃদয় জুড়ে। এমন রাজার কাছে নিজেদের প্রয়োজনের কথা নির্ভয়ে বলাই যায়। কলকাতায় তখন তিন তিনটে মেডিকেল কলেজ। আধুনিক চিকিৎসা মানুষের হাতের নাগালে এসে গিয়েছে। অথচ বর্ধমানের ধারে কাছে কোনও হাসপাতালই নেই প্রসব অথবা গুরুতর রোগীদের জন্য। ১৯০৭ সালের ১৩ জুলাই বর্ধমানের কিছু মানুষ জমায়েত হলেন। এক গণ কনভেনশনের মাধ্যমে সমস্যাটা তুলে ধরলেন ও দাবি জানালেন, একটি হাসপাতাল চাই। তাঁরা তখন জানতেন না, কি সুদূরপ্রসারী এক কর্মকাণ্ডের প্রদীপ জ্বালা হয়ে গেল সেই দিন! যিনি রাঁচী শহরে ছেলেদের হস্টেল আর আর্ট কলেজের জন্য সেই সময় চল্লিশ হাজার টাকা দিচ্ছেন, সেই মহারাজা বিজয়চাঁদ ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তৎক্ষণাৎ কাজ শুরু করে দিলেন।

১৮৭ শয্যার হাসপাতালের উদ্বোধন হল ১৯১০ সালের ৯ নভেম্বর। নাম ফ্রেজার হাসপাতাল। বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন মহারাজ বিজয়চাঁদ। সেই হৃদ্যতা রইল হাসপাতালের নামেও। এ সব সেই সময়ের কথা, যখন ঔপনিবেশিক আধিপত্যে ভারতবাসী প্রাচীন দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা আর আধুনিক পশ্চিমী চিকিৎসার মধ্যে গ্রহণ-বর্জনের দোটানায় ভুগছে। বর্ধমানের ‘গ্রামীণ’ মানুষেরা কিন্তু আধুনিক মনের পরিচয় দিয়ে এসেছেন বরাবর। তাঁরা শুধু হাসপাতালে সন্তুষ্ট থাকলে না। ১৯২১ সালে চালু হল ‘রোনাল্ডসে মেডিক্যাল স্কুল’। তখন বাংলার গভর্নর আর্ল রোনাল্ডসে। এই মেডিক্যাল স্কুল রমরমিয়ে চলেছে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। চিকিৎসকেরা এখান থেকে বিজ্ঞান সম্মত ধাত্রীবিদ্যায় শিক্ষা নিয়ে প্রসূতি মায়েদের দাইয়ের হাত থেকে ‘বাঁচালেন’। স্বাধীনতার পরে ‘ভোর কমিটি’র সুপারিশ অনুযায়ী দেশে অভিন্ন ডাক্তারি শিক্ষা চালুর উদ্দেশ্যে মেডিক্যাল স্কুলটি বন্ধ করতে হল।


ফ্রেজার হাসপাতালটি কিন্তু রয়ে গেল। নাম বদলে হল ‘বিজয়চাঁদ হাসপাতাল’। সেই শতাব্দী প্রাচীন লাল হলুদ অট্টালিকা আজও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের গর্ব। বড় বড় থাম আর উঁচু সোপান পেরিয়ে উপরে তাকালে মনে পড়বেই সেই রাজার কথা। মেডিক্যাল স্কুলের জায়গায় মেডিক্যাল কলেজ তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল বিধান রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন। সম্ভবত পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাস্তবায়িত হতে কিছু দেরি হয়ে গেল।

অবশেষে এল পঞ্চাশ বছর আগের সেই দিন। ১৯৬৯ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চালু হল বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের প্রতিটি ইটে যাঁদের অসামান্য অবদানের কথা লেখা আছে তাঁরা হলেন, জিতেন্দ্রনাথ মিত্র, মহারাজকুমার অভয়চাঁদ, চিকিৎসক নরোত্তম সামন্ত, চিকিৎসক শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, চিকিৎসক শৈলেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সে সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ননী ভট্টাচার্য। সেই প্রথম ব্যাচের ছাত্র আজকের এক প্রতিষ্ঠিত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রহমানের স্মৃতিচারণে ধরা আছে সেই সময়ের কথা। প্রি-মেডিক্যাল ক্লাস হত কোথায় শুনলে আজকের দিনে অবাক হতে হয় বই কি! বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন ছিল। নাম ছিল ‘হল ব্রিক বিল্ডিং’। সেখানে নড়বড়ে চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চিতে বসে চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ নিতেন ৫০ জন ভাবী ডাক্তার। হস্টেল নেই । ছাত্রদের থাকার ঠিকানা ছিল ১৫৯ জিটি রোড, মেহেদিবাগান। সেই বাড়ি আর নেই ।

প্রি-মেডিক্যাল পাশের পরে প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। পরের পাঠের কোনও পরিকাঠামো নেই তখন পর্যন্ত। তাঁদের কিছুদিনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল কলকাতার বিভিন্ন কলেজে। খুব অল্প সংখ্যক থেকে গেলেন বর্ধমানেই। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল সুদৃশ্য ক্যাম্পাস, লাইব্রেরি, লেকচার থিয়েটার, আধুনিক ল্যাবরেটরি—আর যা লাগে চিকিৎসক গড়তে। ইতিমধ্যে ১৯৭৬ সালের ৪ অগস্ট কলেজের দায়িত্বভার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গিয়েছে। এসে গিয়েছে এমসিআই স্বীকৃতি। সেই ১৯৬৯ সালের প্রথম ব্যাচের ছাত্ররা, অজস্র কাঁকর বিছানো পথ পেরিয়ে, ডাক্তার হয়ে বেরলেন প্রায় ন’বছর পরে ১৯৭৮ সালে। এর গাঁথনিতে নিষ্ঠা ও ভালবাসা মিশিয়েছেন সে আমলের পড়ুয়া ও অধ্যাপকেরা। সারা বিশ্বে যাঁর মেডিসিনের পাঠ্যবই পড়ানো হয়, সেই ডেভিডসনের প্রিয় ছাত্র, চিকিৎসক সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, ডেভিডসনের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করে বিলেত ছেড়ে চলে এসেছিলেন, নিজের শহরের মেডিক্যাল কলেজে পড়াবেন বলে। আমরা সেই মাস্টারমশাইয়ের মুখে শুনেছি সে কথা।

শ্যামসায়রের পাড়ে, ৭৯ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ চিকিৎসা মানচিত্রে নিজেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত ‘অনাময় সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল’। বছরে এই হাসপাতালে শুধু প্রসবই হয় পঁচিশ হাজার! প্রতিদিন ভোরে প্রায় দাঁত মাজার জিনিস সঙ্গে নিয়ে এসে, বর্হিবিভাগে দেখানোর জন্য লাইন দেন রোগীরা। দূর দূরান্তের চার পাঁচটি জেলা জুড়ে এই হাসপাতালের পরিষেবা। এখানে স্নাতক স্তরে ১৫০, স্নাতকোত্তর ১৫২ জন চিকিৎসক তৈরি হচ্ছেন প্রতি বছরে। সঙ্গে নার্সিং কলেজ, চিকিৎসা কারিগরি সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে পড়ানো তো আছেই।

ভারত ও বিশ্বের খ্যাতনামা অনেক চিকিৎসকের হাতেখড়ি এখানেই। ইন্টারন্যাশনাল ডার্মাটোলোজি অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি এই কলেজের প্রাক্তণী চিকিৎসক কৌশিক লাহিড়ী। আমরা যাঁরা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ধূলিকণা গায়ে মেখে চিকিৎসক হয়েছি, হয়তো অজান্তে এক সময়ে নতুন কলেজ বলে ‘অকুলীন’ হীনমন্যতায় ভুগতাম। এতগুলি বছর পেরিয়ে, সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেখি সব ধূলিকণা কখন স্বর্ণরেণু হয়ে জ্বলজ্বল করছে! # আনন্দ বাজার পত্রিকার সৌজন্যে প্রকাশিত।

 

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়